ডেড পোয়েটস সোসাইটি! ওহ ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন !

ফাইনাল এক্সাম চলছে। তাই মোটামুটি বিজি ছিলাম বেশ কয়েকদিন ধরে… নেক্সট পরীক্ষার আগে ৫ দিন গ্যাপ। এত দিন গ্যাপ থাকলে আর যাই হোক, পড়াশুনা জিনিসটা করা হয় না ! সেইটা সেই ক্লাস সেভেনেই বুঝে গেছি। তাই সময় কাটাতে একটা মুভি দেখতে বসলাম। Dead Poets Society … রবিন উইলিয়াম আছেন মুভিতে। বোধহয় ইথান হকের ব্রেক থ্রু মুভি ছিল এটা । মুভি দেখা শেষ করেছি অনেকক্ষণ হলো.. এখনো কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে আছি বলে মনে হচ্ছে। কথা হলো ,আমি এখন কোনো রিভিউ লিখতে বসিনি। এই মুভি নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক রিভিউ আছে , কেউ চাইলেই এক ক্লিকে সেখান থেকে পড়ে আসতে পারেন। আমি আমার কিছু অনুভূতি শেয়ার করতে এসেছি।
যারা মুভিটা দেখেছেন তারা জানেন যে রবিন উইলিয়ামস মুভিতে একজন অনুপ্রেরণাদায়ী শিক্ষক ছিলেন। তিনি একটা রক্ষনশীল আবাসিক স্কুলের ছেলেদের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। মূলত তিনি ছাত্রদের মাঝে কবিতার আসল সৌন্দর্য তুলে ধরার চেষ্টা করতেন । তিনি সবাইকে আউট অফ দা বক্স চিন্তা করতে বলতেন। তার এই শিক্ষণ পদ্ধতি ও একটা দুর্ঘটনা এবং সেই ঘটনার শোক কে শক্তিতে রূপান্তর করাই এই মুভির মূল উপজীব্য বিষয়। এখন যে কারনে মুভিটা আমাকে বেশি স্পর্শ করেছে তার মূল কারন হলো , মুভির অনেক ঘটনাই আমার নিজের জীবনের সাথে মিলে গেছে। আমিও মুভির ক্যারেক্টার দের মতো জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছি একটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেই ক্লাস সেভেন থেকে এইচএসএসসি পর্যন্ত। ব্লগে যারা আছেন তারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি একটা ক্যাডেট কলেজের কথা বলছি। অনেক নিয়ম , অনেক ফর্মালিটিস। মুভিতে দেখানো রবিন উইলিয়ামস এর মতো কোনো শিক্ষক কখনো আমরা বোধ হয় পাইনি। আমাদের স্যার রা ক্লাস রুমে শিক্ষাদান এর পাশাপাশি আরো অনেক কাজে বিজি থাকতেন। সবার মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের বোর্ড পরীক্ষায় জন্য ভালো করে প্রস্তুত করে তোলা। এতে দোষের কিছু যে নেই তা স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই..
যাই হোক, আমরা যখন ক্লাস ইলেভেনে , তখন নতুন একজন শিক্ষক আসলেন। ধরে নেই মুভির রবিন উইলিয়ামস এর মতো তার নামও “মিস্টার কিটি” .. বাংলার শিক্ষক। স্যার ক্লাস শুরু করতেন খুব নিচু গলায়। কথা বুঝতে সমস্যা হতো অনেক। ৫ মিনিটের মাঝেই তার কণ্ঠস্বরের ভলিউম বেড়ে যেত.. শুরু করেছিলেন “হৈমন্তী” পড়ানোর মাধ্যমে। ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তার জগতটা উলোট পালোট হতে শুরু করলো। স্যারের ক্লাস গুলো কখনো টেক্সটবুকে আটকে থাকতো না। সামনে বই খুলে আমরা স্যারের সাথে কল্পনার রাজ্যের সফরে বের হয়ে যেতাম। চলে যেতাম বঙ্কিমের সময়ে। পথ হারানো পথিকের পথ খুজতাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা গুলো চোখ বন্ধ করে ফ্যান্টাসির সাথে মিলিয়ে দেখতাম। অনিমেষের মতো বিপ্লবী প্ল্যাকার্ড নিয়ে কলকাতার পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম। কিশোর আমাদের মনে হানা দিলো ভূমিসুতা, মাধবীলতা, অলি রা ! ভাবতাম শেষের কবিতার অমিত-লাবণ্য এর কথা.. সবকিছু ঘটতো স্যারের ক্লাসেই। বেল দিলেই আমাদের এই ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটতো। কিশোর আমরা তখন সত্যিকার অর্থেই কল্পনাবিলাসী হয়ে উঠলাম। কলেজ লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করে ক্লাসিক বই গুলো পড়া শুরু করলাম। রাত বিরাতে মৃদু ডিম লাইটের আলোতে বসে কল্পনার আরেক কিশোরীর কথা ভেবে দু কলম কবিতাও লেখা শুরু করলাম। সেই কবিতা যখন দেয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তখন আনন্দে লাফিয়ে হাউজ গরম করে ফেলতাম। স্যার ক্লাসে এসে নানা কাহিনী বলে আমাদের রিয়েকশন চেক করতেন। জিজ্ঞেস করতেন এরপর কি হওয়া উচিত। পরে বুঝেছি যে ওগুলো সব ছিল স্যারের নিজেরই লেখা গল্প।
আর এদিকে আমাদের পাঠ্যবইয়ের উপর ধুলো পড়তে শুরু করলো। পরীক্ষা চলে আসলো। সিলেবাস এর অগ্রগতি সম্পর্কে খোজ নিতে এসে ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র শিক্ষক আবিস্কার করলেন আমরা পুরো টার্ম ধরে এক হৈমন্তী তেই পরে আছি! এখনো শেষ করতে পারিনি। অথরিটি স্যারের এই পড়ানোর স্টাইল কে ভালো চোখে দেখলো না। তিনি নানা রকমের চাপের সম্মুখীন হওয়া শুরু করলেন। তাকে নানা রকমের এক্সট্রা ডিউটি দেওয়া শুরু হলো.. স্যার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি তার চাকরি স্থল বদলাবেন। এর মাঝেই স্যার বিসিএস এ ফাইনালি কোয়ালিফাই করে ফেললেন। মুভির মতো আমাদের বাস্তবের মিস্টার কিটি ও একদিন ক্লাসে এসে বললেন তিনি চলে যাচ্ছেন। তার নানা আক্ষেপের কথা বললেন। আমাদের কবিতা , সাহিত্য , উপন্যাসের সাথে সম্পর্ক রাখতে বললেন। মুভিতে যখন রবিন উইলিয়ামস চলে যাচ্ছিল তখন ডেড পোয়েটস সোসাইটির মেম্বার রা শত বাধা সত্ত্বেও ডেস্কের উপর উঠে দাড়িয়ে বলে উঠে,” ক্যাপ্টেন ! ওহ মাই ক্যাপ্টেন ! ” মুভির মিস্টার কিটি থ্যাঙ্ক ইউ বলে মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে পর্দা থেকে বিদায় নেন … বাস্তবের সাথে হয়তো মুভির বোধহয় এখানেই তফাৎ। মুভির ক্যারেক্টার দের মতো আমরা মুখ ফুটে তেমন কিছু বলতে পারিনি। স্যার চলে গেলেন। স্যারের মুখে হাসি ছিলো না কোনো। আমরা আমাদের জায়গায় থেকে গেলাম। নতুন স্যার এসে নেক্সট গল্প “বিলাসী” পড়ানো শুরু করলেন। সেই স্যার আমাদের বোর্ড পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা শুরু করলেন। ছোট প্রশ্ন, বড় প্রশ্ন ও ব্যাখ্যা পরানো শুরু করলেন। এরপর …… এরপর আর এরপর নেই ! জীবন বয়ে চললো। কেটে গেল প্রায় ৫ টি বছর।  আমরা কলেজ থেকে বের হয়েছি সেই ২০১০ সালে। স্যারের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি আর…

আজ এত দিন পরে মুভিটা দেখে সেই সময়ের কথা মনে পরে গেলো। সাথে কিছুটা নস্টালজিয়া , আর কিছুটা আক্ষেপ। কারো যদি Dead poets society মুভিটা না দেখা থাকে, তাহলে রিকমেন্ড করলাম। দেখে ফেলুন সময় করে.. ধীরে স্থুরে। অনেক সময় নিয়ে। কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করুন। ভালো কাটবে ২ টা ঘন্টা। হতে পারে হুট করে নিজের জীবন কে একটু নতুন ভাবে দেখে ফেলতে পারেন। হয়তো নিজের অজান্তেই ফিসফিস করে বলে ফেলতে পারেন,”… carpe diem, seize the day boys, make your lives extraordinary.”

 

115Dead_Poets_Society

captain

Dead Poets Society

dead-poets-society-04

 

 

৪,৩২২ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “ডেড পোয়েটস সোসাইটি! ওহ ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন !”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    ছবিটা দেখেছিলাম কয়েকমাস আগে। যেকোন ক্যাডেটেরই এই ছবি ভাল লাগবে। খালি ক্যাডেট কেন, যেকোন কিশোর/কিশোরীরই ভাল লাগার কথা। অদ্ভুত সুন্দর একটা গল্প। ছবির ফিনিশিংটা হুট করেই হয়। খুব কষ্ট লাগে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।

    কলেজে বা ভার্সিটিতে এসেও এই রকম কোন শিক্ষক পাইনি এখনো। কলেজের নতুন দুয়েক জন স্যারের মধ্যে একটু একটু এই টাইপ মন মানুসিকতা থাকে। কিন্তু অথোরিটির চাপে পড়ে দিনকে দিন সবাই মার্ক বাড়ানোর মেশিনে পরিণত হন। এটা তাদের দোষ নয়, দোষ আমাদের পঙ্গু শিক্ষা ব্যবস্থার।

    আফসোস 🙁


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    ভাল লেখা !
    আমিও ক্যাডেট কলেজেই এ রকম দুজন টিচার পেয়েছিলাম।

    শাহজাহান স্যার বাংলার আর সাদিক স্যার ধর্মীয় শিক্ষার।

    সাদিক স্যার বাংলাদেশ বিরোধী ছিলেন।৭১ এ তিনি মির্জাপুর ক ক তে ছিলেন।যুদ্ধ শেষে একদল মুক্তিযোদ্ধা উনাকে জবাই করার জন্য নিয়ে যায়।তখন উনাকে অনেক অনুনয় করে বাঁচিয়ে আনেন মকক এর তৎকালীন গ্রন্থাগারিক পরে ইংরেজীর শিক্ষক (নাম ভুলে গেছি,আমার ব্যাচমেট শিরিণ,পারভিনের আব্বা)।
    সাদিক স্যার ৮৬-৮৮ তেও বলতেন,আমি পাকিস্তান বিভক্তির বিরোধী।পরের কথা জানিনা।তবে স্যারের যে গুনটির কথা বলব তা হলো উনি আমার মাঝে তথ্য খোঁজার তৃষ্ণা জাগিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

    শাহজাহান স্যার ও ছাত্রজীবনে শিবির করতেন (আমার কপাল !!!) ।
    এটা অনেক পরে জানতে পেরেছি।স্যার কখনোই তার এই মতাদর্শের কথা বলেন নাই।
    সাহিত্য,ইতিহাসদর্শন,নৃতত্ত্ব,ভ্রমণকাহিনী,কাব্য,পুরাণ... কত যে দিগন্ত উনি খুলে দিতেন আমাদের সামনে !
    শাহজাহান স্যারও অথরিটির সমালোচনা সয়েছেন সিলেবাস কমপ্লিট না করার জন্য।
    তোমাকে চিমটি...কমন পড়ছে।


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন
    • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

      শাহজাহান স্যার! জামাতপন্থী ছিলেন বোঝা যেতো, শিবির করতেন এ তথ্য জানতামনা।
      তবে ভীষণ নরম টাইপের মানুষ ছিলেন। প্রায় মেয়েদের মতো কোমল। সেই কোমল হৃদয় আর বাচনভঙ্গি দিয়েই তিনি একটু একটু করে আমাদের মগজধোলাই করার চেষ্টা করতেন। বাঙালি মুসলমানের জাগরণের কথা যখন বলতেন তখন পাকিস্তানের প্রতি উনার ভালোবাসাটা চেপে রাখতে চাইলেও পারতেননা।

      তখন বিষয়টাকে তেমন আমল দেইনি -- তবে আজ ভাবি উনার মতো পণ্ডিতেরা অনেক বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারেন অন্য যে কোন মানুষের থেকে। আজকের বয়সে পৌঁছে ছাত্রদের মগজধোলাইয়ের জন্যে উনার সুনিপুণ প্রচেষ্টার জন্যে উনাকে আমি আর শিক্ষকের অবস্থানে রাখতে পারিনা -- উনার পাণ্ডিত্যের জন্যে না, উনার স্নেহপূর্ণ হাসির জন্যেও না। এ বড় বেদনাদায়ক অনুভূতি।

      জবাব দিন
      • তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

        " উনার মতো পণ্ডিতেরা অনেক বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারেন অন্য যে কোন মানুষের থেকে"- শতভাগ সহমত নূপুর।

        কলেজে থাকতে জামাত শিবির /ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিলনা।
        একটা প্রবলভাবে ধর্মাচারী পরিবারে বেড়ে উঠেছি,তাই ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বললে সেটা আলাদা করে খেয়ালই করতাম না।কেম্নে যেন অটোফিল্টারড হয়ে যেতো।


        আমি চোখ মেললুম আকাশে
        জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

        জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      তৎকালীন গ্রন্থাগারিক পরে ইংরেজীর শিক্ষক
      মোদাচ্ছের আলী সিকদার স্যার।
      স্যারের ছেলেও বিসিসিতে পড়েছে।
      আর এক ক্যাডেট আপার সঙ্গে আখতার স্যারের বড় ছেলে বিসিসির ইকবাল ভাইএর সাথে বিয়ে হয়েছিলো।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      সিকদার স্যার ঘুরে ফিরে আমাদের তিন হাউজের হাউজ মাষ্টার ছিলেন।
      যতদূর জানি স্যার মারা গেছেন, খুব সম্ভবত মীরপুরের ঐদিকে স্যারের বাসা ছিলো।

      স্যার আমাদের কলেজে এসেছিলেন মির্জাপুর থেকে।
      তার কাছ থেকে দুটা জিনিস শিখেছিলাম
      ০১ আগষ্ট ভিজিট
      ০২ ম্যানুসক্রিপ্ট।


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।