(শিরোনামটা আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের একটা আত্মজৈবনিক বই থেকে অনুপ্রাণিত।)
আমাদের বকক/২৫ ব্যাচের শশী একদিন বলছিলো, ওর বাবা ওকে ক্যাডেট কলেজে দেবার প্রধান কারন ছিলো এখানে কোন রাজনীতি নেই। কোন দল নেই বলে একদলের সাথে অন্যদলের কোন কোন্দল ও নেই। বুয়েট’র এখন যে বাজে দশা, তাতে রাজনীতির অভিজ্ঞতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে শশী ভালো ঝামেলায় পড়ে গেছে মনে হয়। তবে রাজনীতি না থাকলেও আমরা যখন কলেজে পড়তাম মজা করবার জন্য কিছু দল আমদানী করে রাজনীতি করেছিলাম। পুরো ঘটনা বলি। কলেজে থাকতে মাথায় এতো অদ্ভুত আইডিয়া কিভাবে আসতো তা এখনো রহস্য। আমাদের যাহীনের সহজাত প্রতিভা ছিলো কার্টুন আঁকার। আরো কয়েকজন ছিলো যারা শখের বশে কার্টুন আঁকতো। একদিন এই কয়েকজন মিলে একটা ক্লাবের মত বানালো, নাম দিলো “কার্টুন নেটওয়ার্ক” তাঁদের একটা প্রকাশনাও বের হলো। খুবই অসাধারন একটা জিনিস দাঁড় হয়েছিলো।ওই সংখ্যা’টা আমি এখনো খুব ‘মিস’ করি। সত্যিকথা বলতে আমাদের সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলো ওঁদের আঁকা দেখে। এরপর একটা হই চই পড়ে গেলো। সবাই দেখা গেলো গোপন প্রতিভার অধিকারী। বেশ কিছু নতুন সংগঠন ও তৈরী হয়ে গেলো। এই মুহুর্তে কয়েকটা নাম মনে পড়ছে। “গরীব-ই-গরীব”, “আলতা সাহিত্য বাসর”, “দুর্বল লীগ”, “ডোন্ট টক” এমন আরো কিছু নাম। আমাদের আওয়ামী-বিএনপি রাজনীতির একটা নোংরা সংস্কৃতিও আমদানী করলাম। কেউই দেখা গেলো নিজের দল ব্যাতীত অন্য দলগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করছেনা। পাল্টা-পাল্টি লেখালেখি, কলাম প্রকাশ এগুলো শুরু হয়ে গেলো। তবে লেখালেখিকে সবাই আপন করে নিয়েছিলো এই ঘটনায়। যেমন গরীব-ই-গরীবের সদস্যদের কেন নোকিয়া এন সিরিজের ফোন থাকবে? এটা কেউ মেনে নিতেই পারলো না। প্রতিবাদে শুরু হলো কলাম লিখে বা কার্টুন একে ক্লাসে প্রকাশ করা।
যারা ক্লাসে লেখালেখি করে তাঁদের দল ছিলো “আলতা সাহিত্য বাসর”। আমিও সাহিত্য বাসরেই ছিলাম। সমস্যা হলো দলে প্রকৃত লেখক খুব বেশী ছিলোনা। আমাদের আহমেদ (আমাদের ব্যাচ’র CP) লেখালেখি বেশ ভালো করতো। কিন্তু আহমেদ সাধারনত সবার গুডবুকে থাকতে চাইতো। আমরা (সবাই চেয়েছিলো)যখন আহমেদকে বললাম সাহিত্য বাসরে যোগ দেবার জন্য সে “ধরি মাছ; না ছুঁই পানি” নীতি অবলম্বন করে পার পেয়ে গেলো।আমাদের আব্দুল্লাহও (শরীয়তউল্লাহ হাউসের হাউস প্রিফেক্ট)একই কাজ করলো। সাহিত্য বাসরের সভাপতি ছিলো মেহেদী। তখন মেহেদী দৈনিক একটা উপন্যাস লেখে। উপন্যাস কিছুই না; হালকার চেয়েও হালকা প্রেম-কাহিনী’র সাথে নিজের ঘনিষ্ট দুই-একজন বন্ধুর (সাধারনত ‘মারুপ’র নামই থাকতো) নামে কয়েকটা চরিত্র মিশিয়ে একটা খিচুড়ী। ওই ঘনিষ্ট ২-১জন ছাড়া সেই উপন্যাস পড়ে মজা পাবার কোন কারন ছিলোনা। নিজের দলের লোক কিছু বলতেও পারতাম না। পরবর্তীতে মেহেদীর বইও বের হয়েছে। বই কেমন হইছে সেটা মনে হয় না বললেও চলছে। ইদানীং মেহেদী টিভি নাটক লেখছে। আমাকে ওর লেখা নাটকে সুযোগ দেবার কথা। দেখি দেয় কিনা? সাহিত্য বাসরের আরেক লেখক ছিলো লাইমুন। ও’র সম্পর্কে শুধু একটাই কথা বলবো। লাইমুনের লেখা কোথাও ছাপা হয়নি, নইলে সবাই বলতো; বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস মুলত প্রেমে ব্যর্থতার ইতিকথা।
ক্লাসের যত শক্তিশালী ছেলে ছিলো তাদের সংগঠন ছিলো “দুর্বল লীগ”। আসলে এগুলো সবই ছিলো অল্প কয়েকদিন এর জন্য ফাজলামী করার একটা উপলক্ষ। একমাসের মধ্যেই সব শেষ। তবে কলেজ থেকে বের হবার পরও বহাল তবিয়তে টিকে আছে “কার্টুন নেটওয়ার্ক”। অনেকদিন হলো ওদেরঅনেকদিন হলো ওদের কোন প্রকাশনা নেই। “পালের গোদা” যাহীন কার্টুন বাদ দিয়ে লম্বা লম্বা ফেসবুক পোষ্ট লেখায় ব্যস্ত। এই লেখার মাধ্যমে ওদের একটা লেখার অনুরোধ জানালাম। আরেকটা সংগঠন ছিলো নাম “সি আর সি টি”। বড় করলে দাঁড়ায়, “চটি রীডার্স এন্ড কালেক্টরস টিম”।তখন নাইনে পড়তাম। ইফতেখার-হামীম’র হাত ধরে যৌবনের গান গেয়ে আমরা তখন এগিয়ে গেছি বহুদুর। প্রাপ্তবয়স্কদের বই ও স্টাপলার মারা ম্যাগাজিন তখন গোগ্রাসে গিলতাম। মুস্তাকিম এর আবার এগুলো পড়ার অভ্যাস অনেক পুরোন। আমরা যারা নতুন ওকেই শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিলাম। আরেকটা মজার জিনিস ছিলো। প্রতিবার ছুটি শেষ কলেজে আসার পর দুই রাত সোহরাওয়ার্দী হাউসে চটিপাঠের আসর বসতো। আসরের বক্তার নাম বলবোনা। কোন বই-ম্যাগাজিন ছাড়াই বক্তা তাঁর নিজের কাহিনী বলতো। মানে গত ভ্যাকেশনে সে কি “আকাম” ঘটিয়ে আসছে সেটার রসালো বর্ণনা। ৫-৬জনের একটা দল হা করে শুনতাম। সেই বক্তার প্রতি সবাই সেকি ঈর্ষা নিয়ে তাকিয়ে থাকতো। সবার চোখেই নিজের জীবন নিয়ে হতাশা ছিলো আর থাকতো একটা প্রশ্ন; জীবনটা এমন হলো কেন?? এই আসরে আমার চোখে একটা অসংগতি ধরা পড়তো। কয়েকদিন আগে জানলাম এটা আরো অনেকের কাছেই ধরা পড়েছিলো। ঘটনাটা হলো, ভ্যাকেশনে যাবার সময় বাসে যে ম্যাগাজিনের গল্পগুলো পড়তাম ঐ গল্পগুলোই শোনা যেত এই আসরে। একই কাহিনী, একই চরিত্র শুধু নায়কের চরিত্রে আমাদের ঐ বক্তা বন্ধু।
যাই হোক, যখন সবাই পড়তে শুরু করে এতই চাহিদা বেড়ে গেলো নতুন নতুন ‘যোগানদাতা’ আসতে লাগলো। একটা সংগঠন না করলে আর নয়। অবশেষে একাডেমী’র নিচতলার টয়লেটে ভোটাভুটির মাধ্যমে সম্পুর্ন গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হলো সি আর সি টি’র প্রথম কার্যকারী পর্ষদ।আমার লেখার মান ভালোনা বলে আমি বোঝাতে পারছিনা যে সবাই এই সংগঠন নিয়ে কি পরিমানে সিরিয়াস ছিলো। গম্ভীর মুখেই সবাই সবার ভোট দিয়েছিলো। হামীম সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ছিলো। সকল সদস্যদের মধ্যে একজনের নাম বলাটা খুবই জরুরী। সে হলো নাজমুল। সি আর সি টি’র অতি গুরুত্বপুর্ণ এই সদস্য একইসাথে সোহরাওয়ার্দী হাউস মসজিদ কমিটি’রও সদস্য ছিলো। এসময় চটি পড়ার ব্যাপারটি একটি সাংগঠনিক রুপ পেল। নির্বাচিত সদস্যরা বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো। একদিন ঘোষনা এলো প্রতি টার্মে পার্বিক চটিগল্প রচনা প্রতিযোগীতার। এই প্রতিযোগীতার কথা আলাদাভাবে মনে থাকার কারন আমি এখানে একজন প্রতিযোগী ছিলাম। অসামান্য দক্ষতার বদৌলতে হামীম প্রথম ও হাউস মসজিদ কমিটির নাজমুল দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলো এটাও এখনো মনে আছে।
আমাদের ব্যাচের লেখালেখির শুরু প্রধানত ঐ সময়ে। পরবর্তীতে হয়তো লেখার মান আরো ভালো হইছে কিন্তু লেখা প্রকাশ করা একেবারে কমে গেছে। আমাদের কয়েকজন ব্যাচমেটের নাম না বললেই নয়। যেমন রবিউল, মুস্তাকিম, নাজমুল, হামীম (আগে ভালো লিখতো, এখন খুব বোরিং) যাহীন, নিলয়, রিয়াদ, সাকিব।এঁদের প্রত্যেকেই খুব ভালো লেখক ছিলো। কেন যেন ব্যাচের এইসব নিজস্ব ম্যাগাজিন, কলেজের কয়েকটা সাময়িকী ছাড়া বাইরে কেউ তেমন লিখলো না। বিশেষত নাজমুল আর মুস্তাকিমের রম্য লেখার প্রতিভা জাতীয় পর্যায়ে বিকশিত হওয়া উচিত ছিলো। আমাদের এক বন্ধু সারাদিন মোবাইলে কথা বলতো বলে নাজমুল তাকে নিয়ে লিখেছিলো “মোবাইলের গল্প”। জহির রায়হান’র “একুশের গল্প”র প্যারোডি। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি “মোবাইলের গল্প” বাংলাসাহিত্যের একটা সম্পদ ছিলো। গল্পটা এখন কোথায় আছে কে জানে? নাজমুল আবার কবিতাও লেখতো। ছদ্মনাম ছিলো ‘হাসান শওকত’। আধুনিক চটি কবিতার সাথে সাথে বিশেষ ধরনের কবিতা। যার প্রতি লাইনের প্রথম বর্ণগুলো একত্রে সাজালে আলাদা একটা অর্থবহ লাইন হতো। এখনো ভাবি কলেজে কি দিন গুলোই না কাটিয়ে আসছি। দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদে বছরদু’য়েক আগে কাজ করতাম। প্রথম দিন দলের নির্দেশক জিজ্ঞেস করলো বই পড়ি কিনা। যখন জানলো পড়ি, জিজ্ঞেস করলো, “নতুন কবি লেখকদের মধ্যে প্রিয় কে?” আমার উত্তর ছিলো, “কবি হাসান শওকত আর লেখক ফাইজুস মুস্তাকিম!”
দারুণ লিখেছ তুষার।
এককথায় অসাধারণ
চটি লেখক নাজমুলের সাথে কেউ ভুলেও আমাকে গুলিয়ে ফেলবেননা
নাজমুল নামের পোলাগুলা চটি সাহিত্যে সবসময়ই নামকরা 😉
জ্বী ভাইয়া প্রায় সব নাজমুল নামের ছেলেরাই 😀
প্রেসিডেন্ট হামীম আর আমি হামীম এক নই। :shy:
চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।
গল্পে উল্লেখিত মুসতাকীমের সাথে আমার কোন মিল নেই 😕 😕 😕
কেউ মিল খুঁজে পেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়মাত্র :grr: :grr: :grr:
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
এমন একটা লেখা লিখছিস যে মন্তব্য করার জন্য প্রাণ আইঢাই 😕 করতেছে আবার মনে হইতেছে এই যুগের পোলাপাইন হইলো বান্দর বিশেষ। :party:
যাই হোক শেষমেষ মন্তব্য কইরাই ফালাইলাম।
লেখা ভালো হইছে, বিষয়বস্তু খারাপ না। :duel: পুরাই কোপা।
যারাই পড়বে তারাই পুরা নষ্টালজিয়া হইয়া যাবে। 😀
আমাদের কলেজের ৮৮-৯৪ ব্যাচে তিনজন শাহরিয়ার ছিলো।
তোদের ব্যাচে বিশেষ কইরা সো হাউসে না হয় দুই নাজমুল ছিলো।
নাজমুল তুই নিশ্চয়ই ঠাকুর ঘরে কলা খাস না, এই সব ক্ষেত্রে চুপ থাকাই উত্তম।
কার্টুনের প্রসংগ ভালো লেগেছে।
আবার শুরু কর তোরা। আর এই বিষয়ে পোষ্ট দে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
চরম হইছে মামা। বিশেষত আহমেদের নিরপেক্ষ থাকার প্রবনতা, যাহীনের কার্টুন আর মুস্তাকীমের কাবাব।
বরিশাল ক্যাডেট কলেজ মনে হয়ে এইসব বিষয়ে সকলের চেয়ে এগিয়ে... :gulti:
বইনডি বরিশাল সব বিষয়ে এগিয়ে। 😀
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আমার নাম কিন্তু "আহমেদ" না, আমি হলাম "আহমদ"।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
🙂 🙁 😛 😀 :)) :(( =)) =)) :clap: 😉 B-) 😕 :shy: x-(
রায়হান আবীর, পুরোপুরি একমত 😀
লেখা সুন্দর হয়েছে :clap: :clap: :clap:
হাউস মসজিদ কমিটি বুঝলাম না কি জিনিস?
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
পোলাপান এত ভালো লেখে কিন্তু একটা লিখে হারিয়ে যায়...তোরা একটু নিয়মিত লেখ তাইলে তো আমাদের সময় টা আরেকটু ভালো কাটে...আর হামীম তো এখন তার সব শৌর্য বীর্য ফেইসবুক স্ট্যাটাস লেখায় দিয়ে দিচ্ছে...ওর কাছ থেকে আর কিছু আশা করা ঠিক হবে না...