(শিরোনামটা আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের একটা আত্মজৈবনিক বই থেকে অনুপ্রাণিত।)
অলিম্পিকের দামামা বাজতে শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। অনেক ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে অলিম্পিকের আবেদন খুবই প্রবল। আমি খেলাধুলায় তেমন ভাল না বলে হয়তো আমাকে অলিম্পিক খুব একটা টানে না। তবে ২-১জন ক্রীড়াবিদকে ভালো না বেসে উপায় নেই। যেমন; উসাইন বোল্ট বা মাইকেল ফেলপস। কাল রাতে ঘুম আসছিলোনা বলে ল্যাপটপ খুলে বসেছি। পুরোনো দিনের ছবি দেখছিলাম। দেখতে দেখতে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম সেই ছবি পেলাম। ২৫ ব্যাচের আমি, মশিউর আর মারুপ (ঠিকই পড়েছেন “মারুফ” না “মারুপ”) ঢাকায় খেলা হলেই দেখতে যাই। সাথে আমার ভার্সিটির কয়েকজন বন্ধু যায়। অইদিন গিয়ে দেখা হলো আমার খুব প্রিয় দুই জনের সাথে। ২২তম ব্যাচের তৌহিদ ভাই আর নাজমুল ভাই। আমার একটা অভ্যাস হলো সবকিছুর মধ্যে ক্যাডেট কলেজ টেনে আনা। স্টেডিয়াম এর ছবি দেখেতে গিয়েও আমার ক্যাডেট কলেজের কথা খুব মনে পড়ে। সত্যি কথা বলতে আমার জীবনের অই ছয় বছর ছিলো একটা শিক্ষাসফর। ক্রিকেটকে জ্ঞান হবার পর থেকেই ভালোবাসতাম। কিন্তু অন্য খেলাধুলা’র প্রতি আমার প্রথম আকর্ষণ (খেলা দেখার প্রতি, খেলার প্রতি নয়। বেশিরভাগ খেলাই খুব খারাপ খেলি) তৈরী করে ক্যাডেট কলেজ। আর ক্রিকেট কে আমার কাছে মাদক দ্রব্য বানিয়ে দেয়ও কিন্তু ক্যাডেট কলেজ।
কলেজে ক্রিকেট ছিলো এক সপ্তাহের খেলা। চারদিন প্রাকটিস। ৩দিন খেলা। দীর্ঘ সময় নিয়ে খেলতে হয় বলে মনে হয় পুরো সামরিক বাহিনীতে ক্রিকেটের খুব চল নেই। ক্যাডেট কলেজ যেহেতু সেনাবাহিনী পরিচালিত তাই এখানেও ক্রিকেট উপেক্ষিত। তবে রুম বা করিডোর এ নিয়মিতই ক্রিকেট চলতো। ক্রিকেট নিয়ে কিছু অসাধারন স্মৃতি আছে । হাসপাতেলে আমি, ২২ব্যাচের রায়হান ভাই, নাজমুল ভাই, ২৪ব্যাচের ঝুমন ভাই , ওবায়েদ ভাই, জাওয়াদ ভাই আর আমাদের মাহমুদুল একসাথে প্রায় ২ সপ্তাহ ছিলাম। ঐসময় প্রতিদিন কি ক্রিকেটটাই না খেলতাম। আমাদের ক্লাস টুয়েলভ লাইফের কমন রুমের ক্রিকেট নিয়ে তো একটা উপন্যাস লেখা যায়। একটা ঘটনা এখনো মনে পড়ে। আন্তঃহাউস ক্রিকেট চলছে। সিনিয়র-জুনিওর দুই মাঠে খেলা চলছে। খেলা দেখায় কারো খুব মনোযোগ দেখা যাচ্ছেনা। কারন সেদিন আবার বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের দিন। সকাল থেকেই অপেক্ষা করছি কখন বাংলাদেশ জিতবে। ২২তম ব্যাচের নাজমুল ভাইকে ঘিরে আমরা কয়েকজন বসে আছি। মোটামুটি সবাই ২২তম ব্যাচ। আমিই “ছোট মানুষ”। আড্ডা টাইপের আরকি। নাজমুল ভাই কথা বলছেন আমরা শুধু শুনছি। মুম্বাইয়ের মাফিয়াদের যেমন “ভাই” বলে সম্মোধন করে আমরাও (জুনিওর-ক্লাসমেট) তাকে ডাকতাম “ভাই নাজমুল ভাই”। প্রথম “ভাই” টা অবশ্য জুনিওর’রা সামনাসামনি বলতাম না। ভাই খেলাধুলায় খুব আগ্রহী ছিলেন। তিনি তার প্রিয় দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়ে কি জানি বলছিলেন। আচমকা পুরো কলেজ হো হো করে উঠলো। জিম্বাবুয়ের একটা উইকেট পড়ামাত্র ঘোষণা মঞ্চ থেকে মাইকে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। বারবার পুরো কলেজ আনন্দে ফেটে পড়ছে। যখন জিম্বাবুয়ে’র ৯ম উইকেট পড়লো কলেজ প্রিফেক্ট মাসুদ ভাই (একজন কিংবদন্তী কলেজ প্রিফেক্ট) দুই মাঠের খেলা বন্ধ করে সবাইকে ঘোষণা মঞ্চের কাছে আসতে বললেন। সেখানে মাইকে ছাড়া হলো রেডিওতে প্রচারিত বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ম্যাচের সরাসরি ধারাবিবরণী। উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছি। কিন্তু সবাই আসার পর আর উইকেট পড়েনা। ওই ইনিংসে দেশসেরা বোলার রফিক তখনো কোনো উইকেট পায়নি। সবারই ধারনা শেষের জন্যই তিনি সব ভালো জমিয়ে রেখেছেন। চট্টগ্রামের ছেলে এনামুল জুনিওর তখন ৫ বা ৬ উইকেট নিয়ে ফেলেছে। যাদের বাড়ী চট্টগ্রামে তারা বাকিদের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। জ্ঞানী লোকজন সকালে প্রথম আলো পড়ে এসেছে, তারা পেপারের লেখা থেকে কোন দেশের প্রথম টেস্ট জিততে কত বছর লেগেছে সেই আলাপ করছে। কিন্তু উইকেট পড়ছে না। অবশেষে চট্টগ্রামই জয়ী হলো। এনামুল জুনিওরের বলে ক্যাচ উঠলো আশরাফুলের কাছে। বিজয়! বিজয়!! বিজয়!!! মনে হলো এত আনন্দ আর জীবনে কোনদিন পাইনি। কি উল্লাস! কি উদযাপন! কলেজের একটা শাস্তি ছিলো “ফ্রন্ট রোল”; বাংলায় ডিগবাজি। অন্য সময় কাউকে এটা দিতে বললে কেউ দেয়না। অনেক দুষ্ট ক্যাডেটকে “ফ্রন্ট রোল” দেওয়াতে প্রিফেক্টদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু ম্যাচ জেতার আনন্দে দেখা গেলো অনেকে মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি আনন্দে লাফাচ্ছি। আমার পাশে আরো কয়েকজন।এই মুহুর্তে মনে পড়ছে তাওহীদ ভাই, আরাফাত ভাই, ওয়াসিফ ভাই, সৌরভ ভাই, তৌহিদ ভাই, আমাদের তৌহিদ, হামীম, নিলয়… আরো অনেকে। এদের মনে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। নাজমুল ভাইকে দেখলাম অনেকখন পর। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো তিনিই ম্যাচটা জেতালেন। একটু পরে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার আনতে যাবেন। আনন্দের আতিশায্যে ৫০-৬০ জনের একটা বড় গ্রুপ কিছুদিন আগে শেষ হয়ে যাওয়া ক্রীড়া প্রতিযোগীতার জন্য বানানো ৪০০ মি. ট্র্যাকে দৌড়াতে শুরু করলো। আমি নিজেও ছিলাম ঐ দলে। আনন্দে কেন দৌড়াতে হবে তা তখন মাথায় আসেনি। অবশ্য ৩০০ মি. দৌড়ানোর পর আমি ও আরো কয়েকজন ক্লান্ত হয়ে হাঁটা শুরু করি। তবে প্রায় ৪৫-৫০ জন কিন্তু ঠিকই দৌড় শেষ করেছিলো।
এই জয়ের রেশ কাটতে অনেকদিন সময় লেগেছিলো। কলেজের ভালো স্মৃতি নিয়ে লিখতে গেলে কোনোদিন শেষ হবেনা। তবে এই স্মৃতিটা অনেক আনন্দের একটা স্মৃতি। কাল রাতে তৌহিদ ভাই-নাজমুল ভাইর ছবি দেখে আবার মনে পড়ে গেলো। যেদিন খেলা দেখতে গিয়েছিলাম সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ- বাংলাদেশের ম্যাচেও বাংলাদেশ জিতেছিল। সেদিনও কি উদযাপন! মুশফিক রহিম ৬ মারার সাথে সাথে ২৫-২৬ হাজার মানুষের সেকি লাফালাফি। কি উল্লাস! তবুও ক্যাডেট কলেজের মাঠে ৩০০ জন মিলে যে উল্লাস করেছিলাম তার সাথে আর কিছুর তুলনা হয়না। আমাদের কলেজের সায়েদ ভাই/১৫তম ব্যাচ এর একটা লেখা থেকে কিছুটা অংশ নকল করে এই লেখাটা শেষ করি।
একবার এক ছাত্রের পরীক্ষায় এসেছে ‘গরু’ রচনা। কিন্তু সে পড়ে গেছে “বাংলাদেশের নদ-নদী”। ছাত্র চালাকি করে গরু গোসলের বর্ণণা দিতে গিয়ে লিখলো “গরুকে নদীতে গোসল করানো হয়। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ।……” এরপর পুরোটাই নদীর বর্নণা। আমার অবস্থাও ঐ ছাত্রের মত। সাড়ে চার বছর হয়ে গেলো এখনো যাই ভাবি-লিখি-বলি একটা জিনিস আসবেই… তা হলো ক্যাডেট কলেজ। স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়ে আমার মনে পড়ে কলেজের কথা। সবাই উসাইন বোল্ট নিয়ে কথা বলে; আর আমি এখনো বলি ২০তম ব্যাচের মঞ্জুর ভাই কে নিয়ে। সবাই মিলে অলিম্পিক দেখতে বসে আর আমি বলতে শুরু করি ২৪তম ব্যাচের মিশকাত ভাই’র ৪০০ মি. কেমন দিত। ক্যাডেট কলেজ আমার কাছে “বাংলাদেশের নদ-নদী”…এই একটি রচনাই আমি পারি। সব কিছুকে টেনে আমি এই “নদী” তে নিয়ে আসি।
খুব ভাল লাগল পড়ে। সব ক্যাডেট ই এক রকম। আমার ও কোথাও ভাল কিছু দেখলেই কলেজের কথা মনে পরে।
:clap: :boss:
"মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,
জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"
🙂 🙂 🙂 ধন্যবাদ।
ছোট হাতি
ভাল লিখেছো। আমরা কলেজে থাকতে পেয়েছিলাম ৯৭ এর আইসিসি ট্রফির ফাইনাল, সেদিন বিকেলেও কলেজে মিছিল হয়েছিল আর এর পরে ৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়। কলেজের কমনরুমে বসে খেলা দেখার মত মজা আর কোথাও পেলাম না 🙁
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ধন্যবাদ। 🙂 🙂 🙂
ছোট হাতি
মজা করে পড়লাম তুষার
ভালো লেগেছে 🙂
ধন্যবাদ। লেখা-লেখি শুরু করছি মাত্র। সকলের দোয়া চাই।
ছোট হাতি
তোর লেখার হাত ভালো ধরে রাখিস।
এইতো বিজ্ঞ সমালোচক চলে এসেছেন। =)) =)) =))
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ভাল লিখছিস!!! একদম মনের কথা বলছিস... সবকিছুতেই ক্যাডেট কলেজ উঠে আসে............ :clap:
যাহিন লিখোনা ক্যান ??
তোমার লেখা আমি খুব পছন্দ করি।
আশাকরি ভালো কিছু লেখা পাবো আমরা তোমার কাছ থেকে।
amr nam dekhe ami onek happy .. kono golpe amar nam kokhonoi thake nah .. jodi o khub boro role play korte pari ni .. 😛 ami vabchilam . ekhono chokh er samne vashe vai .. onk valo thakish ..
:clap: :clap: :clap:
ভালো হইছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
লেখাটি ভালো ছিলো। আমরা যারা ক্যাডেট কলেজের না তাদের জন্য এধরনের লেখা উপভোগ্য। লিখতে থাকুন। 🙂
সেই দিনই শুধু আমি নিজ ইচ্ছায় খানিকটা দৌড় দিয়েছিলাম ।
ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে যার পর নাই আমি খুবই গর্বিত।
চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।
ভাই, আপনার লেখা টা পড়ছিলাম আর অই ঘটনাটা চোখের সামনে ভাস্তেচ্ছিল। অসাধারন মুহূর্ত। লেখা পড়ে ভাল লাগছে।
:clap: :clap: :clap: