তিনটি প্রতিক্রিয়া

এক

সম্প্রতি দাবা খেলাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি মহোদয়। খবরটি দেখার সাথে সাথে মনে ভেসে উঠলো উৎপল দত্তর চেহারা, হীরকের রাজা। কল্পনায় দেখতে পেলাম রাজসভায় বসে তিনি এরকম একটি ঘোষণা দিচ্ছেন –

রাজাঃ
দাবা!
খেললে কিন্তু জাহান্নামে যাবা।
… ঠিক কি না?

সভাসদ দলঃ
ঠিইইইক, ঠিক ঠিক …
দাবাড়ুরা সব ইহুদি-কাফের-নাস্তিক!

রাজকবিঃ
লাঠি তলোয়ার বিনা,
সব খেলা কর ঘৃণা।।
দাবা খেলায় পাপ ভারি,
ছেড়ে দাও তাড়াতাড়ি।।
এসব খেলা ছাইপাশ,
কথা না শুনলে সমুখে ভীষণ সর্বনাশ!

কল্পনার ঘোর থেকে বাস্তবে নেমে ভাবতে লাগলাম, কী এমন গূঢ় রহস্য থাকতে পারে যে দাবাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে? হতে পারে যে, দাবার ষোলটি গুটির মধ্যে হাতী-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত সবই আছে একাধিক, কিন্তু রাজার বিবি মাত্র একজন! যে খেলায় সুলতানে-আযমের সাথে এরকম নিষ্ঠুর বৈষম্য প্রকাশ পায় সেই খেলা কোন ভাবেই বৈধ হতে পারে না। তার উপরে, সুলতানে-আযম চলাফেরা করেন ধীর কদমে, একবারে এক ঘরের বেশি নড়তে অক্ষম। যদিও, ক্যাসলিং এর নামে পালানোর সময় এক লাফে অনেকদূর পাড়ি দিয়ে কেল্লার দেয়ালের পেছনে গিয়ে লুকাতে পারেন, কিন্তু সেটা তো নেহায়েতই ব্যাতিক্রম। অন্য দিকে, বিবি ছাহেবা অবলীলায় যেদিকে খুশি, যতদূর খুশি যেতে পারেন। সুলতান হয়তো মনে মনে মজিদের ভাষায় লানত দেন, “অত দব দব করি হাঁটিয়ো না বিবি” কিন্তু মুখে কিছু ফোটে না। এরকম একটি বেয়াদবি মূলক খেলাধুলাকে একশ বার নিষিদ্ধ করা উচিত, হাজার বার নিষিদ্ধ করা উচিত। 

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের বাড়িতে দাবা খেলার ব্যাপক প্রচলন। মায়ের কাছে শিখেছিলাম কিভাবে খেলতে হয়। সকুলে যাবার বয়েস হবার আগে খেলেছিও বিস্তর। তারপরে একদিন কি মনে হল, দুম করে ছেড়ে দিলাম। অনেক বছর পরে কলেজে একদিন খেলতে বসেছিলাম আবার। আমাদের ব্যাচের মেহেদির সাথে, সে তখন দাবায় কলেজ চ্যাম্পিয়ন। একজন এমেচারের সাথে অতটা গা করে হয়তো সে খেলেনি সেদিন। বোধকরি তাই অবিশ্বাস্য ভাবে সেদিন জিতেও গিয়েছিলাম!

তারপর থেকে খেলাটা পুরোপুরিই ছেড়ে দিলাম। “চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে দিয়েছি এবং তারপর থেকে আমাকে আর কেউ হারাতে পারেনি ” – এরকম একটা দুর্লভ রেকর্ডের মালিকানা হাতছাড়া করার কোন মানে নেই। কে জানে বাপু, খেলতে গিয়ে যদি বেঘোরে কারও কাছে হেরে যাই? তখন সে বলবে, তুমি হারাও কলেজ চ্যাম্পিয়নকে আর আমি হারালাম তোমাকে, তার মানে আমি কলেজ চ্যাম্পিয়নকে গ্র্যান্ড হারানি দিলাম! কলেজ চ্যাম্পিয়নের ইজ্জত সমুন্নত রাখার তাগিদেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন, সেই ঘটনার পরে আর কোনদিন বাইরের কারো সাথে দাবা খেলিনি। শুধু মাঝে মাঝে গোধূলির সাথে খেলি। নিয়ম মাফিক সব সময়েই আমাকে হারতে হয়। ভাগ্যিস মেয়ে আমার জানে না যে, পিতৃদেব এই শতরঞ্চির ক্রীড়ায় একদা তাঁহার শিক্ষায়তনের শ্রেষ্ঠ বীরকে পরাস্ত করিয়াছিল!

যা ই হোক, উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আমার এতদিনের খামখেয়ালী জনিত দাবা না খেলার সিদ্ধান্ত আজ পুণ্য অর্জনের উপায়ে পরিণত হল। হারাম কাজ বর্জন করা মানে তো প্রকারান্তরে পুণ্য অর্জন করা, তাই নয় কি? ওওওওম… উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ …

(চলবে)

৪,৮৯০ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “তিনটি প্রতিক্রিয়া”

    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      তাসের খেলায় মনে হয় আপত্তি তেমন কিছু একটা নেই। সেখানে রাজা মশায়ের রানী একটা থাকলেও গোলাম আছে, দাসী-বাঁদি ও আছে বিস্তর। তাছাড়া ট্রাম্প করার ছলে পরকীয়ারও সুযোগ আছে ;;; ;;;


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    রাজা রাজরার খেলা পাশা
    তাই নিয়ে প্রজাকুল করবে তামাশা

    আর হ্যা রাজা বেচারার শেকলবন্দী নড়াচড়া
    রাণীর যত্রতত্র যেনতেন ইচ্ছে-খুশী ঘোরাফেরা

    বড়ই অনায্য।
    নিষেধাজ্ঞা জরুর প্রযোজ্য।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুজিব (১৯৮৬-৯২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।