অসভ্য সামরিক ছাউনি !

১। “পার্বত্য চটগ্রামে প্রবেশ করার সময় সামরিক ছাউনির অভ্যর্থনার দৃশ্যের মত কদর্যতম চেহারা একটি রাষ্ট্রের হতে পারে না।”
২। “আপনি একটি শহরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন আর তখনি প্রবেশ্মুখে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে সামরিক বাহিনীর ছাউনি। এটা কোন সভ্য দেশে চলতে পারে না।
৩। “প্রতিনিয়ত সামরিক ছাউনির সঙ্গে এখানকার মানুষের সাক্ষাৎ হবে এটা বাঞ্ছনীয় নয়। এটা কাম্য হতে পারে না।”

সম্প্রতি বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ মিজানুর রহমান রাঙামাটি জেলা পরিষদের হলরুমে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। উপরের তিনটি উক্তি ঐদিন তার দেয়া বক্তব্য থেকে নেয়া। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের একটি কমিশনের চেয়ারম্যনের মুখথেকে এমন বক্তব্য শুনে আমি হতবাক। দেশের একজন উচ্চশিক্ষিত নাগরিকের মুখ থেকে এমন কথা শোনা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক বৈকি। ইতিহাসের বিভিন্ন বইতে পড়েছি বাঙালীর প্রধান শত্রু বাঙালীই। আর দেশের বড় বড় ক্ষতির কারণ/সূত্রপাত হয় শিক্ষিতদের দিয়েই (আমি জানি কাঁথাটা শুনে অনেকেই আমার উপর ক্ষিপ্ত হবেন নিশ্চয়ই)। কারণ ‘বড় ক্ষতি’ সাধনের জন্যে প্রয়োজন ‘বড় মেধা’। কথাটা আমি দেশের প্রতিটি শিক্ষিত নাগরিকগণের উপর যথাযথ সম্মান রেখেই বললাম।

আমার পূর্ণ বিশ্বাস ডঃ মিজান আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস সম্বন্ধে আমার থেকে কম জানেন না। গত কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী দের কার্যক্রম/তৎপরতা সম্বন্ধে আমরা কমবেশী সবাই জানে। তাদের এসব তৎপরতা নির্মূলে আমাদের সামরিক বাহিনীর রয়েছে বিশাল বীরত্বপূর্ণ রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। যার অধিকাংশই অপ্রকাশিত থাকে। যদিও শান্তিচুক্তির পরে এসব তৎপরতা অনেকাংশে কমে এসেছে।

এবার আমি এক এক করে ডঃ মিজানের উল্লিখিত বক্তব্যের বিপরীতে আমার ভাবনা গুলো তুলে ধরতে চাই। প্রথমত, বিচ্ছিন্নতা বাদীদের রুখতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। নিজ পরিবার ছেড়ে অনেক দূরে অবস্থান, কোন প্রকার যোগাযোগের আওতার বাইরে থেকে, ম্যালেরিয়া সহ নানাবিধ রোগের সাথে যুদ্ধ করে গত কয়েক দশক ধরে তাঁরা তাদের সর্বস্ব দিয়ে গেছেন দেশের মানচিত্রকে অক্ষুণ্ণ রাখতে। আর ২০১৪ সালে এসে ডঃ মিজানের চোখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিক ছাউনিগুলো ঠেকছে একটি কদর্যতম দৃশ্য হিসেবে। এই উক্তির মাধ্যমে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘাম/রক্ত দেয়া প্রতিটি সৈনিকের বিসর্জনকে অবমাননা করেছেন। বাংলা অভিধানে ‘কৃতঘ্ন’ বলে একটি শব্দ আছে যা নাকি অন্য কোন ভাষার অভিধানে নেই। এর অর্থ হল ‘উপকারীর অপকার করে যে’ । এই তথ্যটি দিয়েছিলে কলেজের জনৈক বাংলার শিক্ষক।

তিনি বলতে চেয়েছেন এটা একটি অসভ্য দেশের চিত্র। এর মাধ্যেমে তিনি আসলে কার/কাদের স্বার্থে কথা বলছেন তা বিবেচনার দাবী রাখে। প্রতিনিয়ত সামরিক ছাউনির সাথে সাক্ষাত কেন অবাঞ্ছনীয় হবে তা আমার বোধগম্য নয়। আমার এখন ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে দেশের সামরিক বাহিনীর সাথে কি তার কোন ভীতিকর স্মৃতি আছে কিনা? কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বরত সামরিক বাহিনীর সদস্যগন ডঃ মিজানের মত এক দিনের পিকনিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যান না। তাঁরা সেখানে নিজ ইচ্ছায়ও যান না। তাদের কে আদেশের মাধ্যমে সেখানে নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্যে পাঠানো হয়, যা একটি কষ্টকর ব্যাপার এবং ডঃ মিজানের মত একদিনের জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণকারীর পক্ষে তাদের এই কষ্টগুলো অনুধাবন করা অসম্ভব। তিনি যদি সেখানের অধিবাসীদের সাথে মিশে থাকতেন, তাদের মনের কথাগুলো শুনে থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি এমনটি বলতেন না। কেন বলতেন না সেটা তিনি সেখানের বাঙালী অধিবাসীর জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। আজ আমার ওনাকে বলতে ইচ্ছে করছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের সামরিক বাহিনীর অবস্থানের কারণেই তিনি বাংলাদেশের অংশ হিসেবে গত শনিবার রাঙামাটির সেমিনারে বক্তব্য দিতে পারেছেন। সেখানে সামরিক ছাউনি দেখতে না পাওয়া গেলে হয়তো বাংলাদেশের আজকের মানচিত্রটি থাকত না।

৩,৬৭২ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “অসভ্য সামরিক ছাউনি !”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    গত কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী দের কার্যক্রম/তৎপরতা সম্বন্ধে আমরা কমবেশী সবাই জানে।

    প্রিয় মাহমুদ, তোমার সাথে দ্বিমত করছি। কারণ, তুমি যাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছ, বেড়ার অন্যপাশ থেকে দেখলে তারা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাকামী, মুক্তিযোদ্ধা, ঠিক যেমন ১৯৭১ এর আগে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা ছিল। পাহাড়িদেরকে ''বিচ্ছিন্নতাবাদী" মনে করা বাংলাদেশীর সংখ্যার উপর এই বিবেচনা নির্ভর করে না। এই নিয়ে রাব্বীর (১৯৯২-৯৮)
    পোস্টে একসময় দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল সিসিবি'তে। চাইলে দেখে নিতে পারো।
    (সম্পাদিত)


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    সামরিক ছাউনির কিছু মনস্তাত্বিক ও নিরাপত্তা উদ্দেশ্য রয়েছে। যার ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য।
    আবার যে আংগিকে সমালোচনাটি তুলে ধরেছেন মি.র. সাহেব তার মা.ক. মঞ্চের ব্যানারে তার আড়ালে কি আছে বা থাকতে পারে তা যারা তাকে চেনেন যথার্থ, তারাই ভালো বলতে পারবেন।

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    অধ্যাপক মিজানুর রহমান কে যতটা বুঝি, তিনি কথাটা সামরিক বাহিনীকে ভেবে বলেন নাই।
    তিনি তা বলেছেন সেই দৃষ্টি কোন থেকে যাকে আমরা বলে থাকি, "বেস্ট ম্যানেজমেন্ট ইজ এন অর্গানাইজেশন দ্যাট নিডস নো ম্যানেজার"।

    সেই হিসাবে:
    - কোন ল'এনফোর্সার ছাড়াই যারা ঠিকঠাক থাকে, চলতে পারে - তারাই হলো মোস্ট সিভিলাইজড
    - যাঁদের কিছু ল'এনফোর্সার লাগে - তারা মধ্যম মানের সভ্য
    - আর যাঁদের যে সে ল'এনফর্সার না, রীতিমত যোদ্ধা দিয়ে নিরাপত্তা দিতে হয়, তাদের কি বলবো।

    তবে হ্যাঁ, এই যে যোদ্ধা দিয়ে নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে, এই দায় তো যোদ্ধাদের না। কনফ্লিক্টে জড়িত সকল পক্ষেরেই দায় আছে এতে।
    কারো কম আর কারো বেশি।
    এই যা.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।