বিশ্বকাপ ফুটবল একটা প্রতিযোগিতা না, উৎসব। চার বছর ধরে বিশ্বব্যাপী ফুটবলপ্রেমীরা বুভুক্ষের মতো অপেক্ষায় থাকে ফুটবল যাদুর মুগ্ধতায় প্লাবিত হতে। এই ফুটবলের সেরা তারকারা স্রেফ খেলোয়াড় নয়, ফুটবলের, এই উৎসবের এক একটি কুশলী দেবতা। তাদের নৈপুণ্য চাঁদ তারা নক্ষত্রের মতো মুগ্ধতার আলো ছড়াবে, এটাই ফুটবল আমোদীদের প্রার্থনা।
প্রথম যাদের খেলা দেখে মুগ্ধতা বেশী মাত্রায় গাঢ় হয়ে জমা হয় কারো মনে, সে হয়ে ওঠে সেই দল, সেই তারকার সমর্থক। আমি যেমন ব্রাজিলের ফুটবল ভক্ত। আমার দেখাদেখি আমার ছেলেও ব্রাজিলের ভক্ত হিসেবে প্রথম বিশ্বকাপ দেখা শুরু করে হয়ে ওঠে মেসি আর আর্জেন্টিনার অনুরক্ত, এক জোর সমর্থক।
না আমার সন্তানের প্রতি মায়ায় নয়, মেসির জাদুতে আমিও তার ভক্ত। আবার ঠিকই নেইমার বার্সা ছেড়ে পিএসজিতে গেলে লালীগার পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ লীগ সবটা না হলেও পিএসজির খেলা মিস করতে ইচ্ছে হয় না। বেকহেম চলে আসার পর ফারগুসন যখন সাত নম্বর জার্সিটা নতুন এক খেলোয়াড়ের গায়ে উঠিয়ে দিলেন। তাকে দেখতে ম্যানইউর খেলা মিস করলাম না। দেখা নয় আবিষ্কার করলাম নতুন এক সম্ভাবনাকে। ফারগুসনের প্রতি শ্রদ্ধার পাত্র ভারী হলো আরো। একটা সময়ে ভালো খেললেও অত পছন্দ করতাম না আর এই রোনাল্ডোকে। সিআরসেভেন হয়ে ওঠার দিনে দিনে তাকে পছন্দ না করলেও তারিফ করতে শুরু করলাম তার দক্ষতাকে।
ইংলিশ প্রিমিয়ার ছিলো টিভি পর্দায় ফুটবল দেখার প্রথম টান। সেই লীগ দেখতে মুখিয়ে থাকলেও ইংল্যাণ্ডকে আমি এই জীবনে সমর্থন করবো না এক দিনের জন্যও। অবশ্য ভালো খেলাটুকুন উপভোগ করতে আমার কার্পণ্য নেই, থাকবেও না কখনো। একই রকম অনুভূতি আমার জার্মান দলকে নিয়েও। টোটাল ফুটবল আর পাওয়ার ফুটবলের মাস্টার মাস্তান জার্মানির খেলার প্রতি একটা সমীহ তাই আমার গোপন করার সুযোগ নেই। আশ্চর্য এই যে জীবনে প্রথম খেলাটা মোয়ামুটি জেনে দেখা বিশ্বকাপে সবচেয়ে নজর কেড়েছিলো হাতে প্লাস্টার নিয়ে খেলা রুমেনিগে। এর পরও দিন না যেতে বিশ্ব রাজনীতিতে জার্মান আর বৃটিশদের হার্মাদিপনাকে ঘিরে যে ক্ষোভ অসন্তোষ আর রাগ জন্ম নিয়েছে মনের ভিতর, তা শৈশব থেকে আজ অব্দি কমেনি। বরং বেড়েছে। প্রতিদিন ভালো খেললেও জার্মানি কখনোই আমার প্রিয় দল নয়। প্রলেতারিয়েত মানসিকতার আমি যেমন ক্রিকেটে ইংল্যাণ্ডের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়াকে কখনোই সমর্থন করি না। আবার তাদের খেলা ঠিকই উপভোগ করেছি।
তো ফুটবলের সেরা উৎসব, শুধু তাই নয়, খেলাধুলার জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জমজমাট উৎসব বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে আমার তাই একটাই প্রার্থনা। সব তারকা খেলোয়াড়রা যেনো তাদের সেরাটাই দিতে পারে। ফুটবল ক্ষুধায় কাতর, চার বছরের বুভুক্ষ ফুটবল প্রেমীদের যেনো মন ভরে কানায় কানায়।
সালাহ খেলতে পারবে কি পারবে না শঙ্কা যেমন আসরের আগেই মনটা খারাপ করে দিয়েছে। প্রথম খেলায় বেঞ্চে বসে থাকতে দেখে এবং হেরে যাবার গোলটা খাওয়ার পর তার অভিব্যক্তি দেখে সেটা বেড়েছে। সুয়ারেজ কাভানি তেমনি আলো জ্বালতে পারেনি মাঠে নেমেও। সেটা পুষিয়ে দিয়েছিলো স্পেন আর পর্তুগালের খেলা। পুরো খেলাটা শতভাগ উৎসবের আমেজ নিয়ে উপভোগ করেছি। তারপর আর্জেন্টিনার খেলা কষ্ট দিয়েছে। মেসির ব্যর্থতা যন্ত্রণা দিয়েছে। আশাহত ও বিমর্ষ হয়েছি। আইসল্যাণ্ডের খেলা আবার এক নতুন প্রাপ্তি দিয়েছে। পাওয়ার এবং স্পিড, সেই সাথে বটবৃক্ষের মতো শক্তিমান রক্ষণ নিয়ে ওদের আক্রমণ শানানোর করিৎকর্মা ফুটবলকে আমি প্রশংসাই দেবো। নান্দনিক ফুটবল বঞ্চিত হলেও এ এক নতুন পাওয়া।
এবার ব্রাজিলের খেলা নিয়েও আছি উৎকণ্ঠায়। সেরা খেলাটা দিতে পারবে কিনা ব্রাজিলের তারকারা তা নিয়ে উৎকণ্ঠা উপচে পড়ছে। হার জিৎ নয়, সেরা ফুটবল দেখাটা থেকে যেনো বঞ্চিত না হই, এটাই আমার আকাঙ্ক্ষা। লম্বা এক টুর্ণামেন্ট বিশ্বকাপ। শেষ পর্যন্ত খেলোয়াড়দের সুস্থ্যতা বজায় থাকা, শক্তিমত্তা ধরে রাখা; এসবই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অনিচ্ছাকৃত ভুলে বা ডিফ্লেকশনে আত্মঘাতী গোল হওয়া কিংবা ডে গিয়ার মতো কিপারের বিশ্বস্ত হাত ফস্কে বল জালে চলে যাওয়া বা মেসির পেনাল্টি মিস করার মতো ঘটনা এটাই প্রথম না। তবে আসর শুরু না হতেই ব্যাপারটা ইতিমধ্যে একাধিকবার দেখা হয়ে গেছে। এমন আসরের মনস্তাত্বিক চাপ, এ ধরনের অঘটন আরো ঘটাবার সম্ভাবনা জাগিয়েই রাখছে। আর যেটা ভাবাচ্ছে বেশি, তা হলো ভালো ফুটবলার ও ভালো দলের শেষ পর্যন্ত ফিটনেস বজায় থাকা।
মোদ্দা কথা, আর যা ই হোক সেরা উপভোগটাই কাম্য। এমন কি মেসির জন্য প্রযোজ্য হিসেব অনুযায়ী তার শেষ বিশ্বকাপের বিজয় মুকুট তার ভাগ্যে জুটে গেলে এই ব্রাজিল সমর্থক আমার খারাপ লাগবে না। সত্যিই না। সেরা দল হিসেবে সমর্থন না করলেও পর্তুগাল এবার এমন কিছু করে ফেললে খুব একটা খারাপ লাগবে না। দশম পিএসজি খেলোয়াড় হিসেবে নেইমার এবার কাপ জিতলে আনন্দ হয়তো একটু বেশি হবে। তবে তারচে’ বেশি আনন্দ হবে সব তারকাদের মন ভরানো খেলা পারফর্ম করতে দেখায়।
আনন্দঘণ উপভোগের উৎসব হোক বিশ্বকাপ। মাঠের উত্তাপ ছড়াক সারা বিশ্বে, তাতে কেউ না পুড়ুক, অন্যকে না পোড়াক। আনন্দ বেদনায় উদ্বেলিত হোক গোটা বিশ্ব। ক্ষোভ বিক্ষোভ হিংসা বিদ্বেষ এতোটুকুও না ছুঁতে পারুক ফুটবলকে। এই শুভাকাঙ্ক্ষা সব খেলোয়াড় এবং দর্শকের জন্য।
১৭ জুন ২০১৮
লেখা পড়ে মনে হলো বিশ্বকাপের এ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া সবগুলো ম্যাচ ঘুরে এলাম। ভালো লেগেছে লুৎফুল ভাই। ধন্যবাদ অনেক।
ধন্যবাদান্তে,
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১
["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]
ভালো লাগলো লেখাটা।
ফুটবল কিন্তু তারপরও জমে ওঠেছে। সারা জীবন বড় দলগুলোর দাপট দেখে অভ্যস্ত চোখ এইবার নতুন নতুন দলের সামর্থ্য আর শক্তিমত্তার প্রদর্শনী উপভোগ করছে। এটাই বা কম কি!
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
ব্লগের টাইটেলে "ফুটবল" হবে বোধহয়
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
:clap: :clap:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
"এই ফুটবলের সেরা তারকারা স্রেফ খেলোয়াড় নয়, ফুটবলের, এই উৎসবের এক একটি কুশলী দেবতা। তাদের নৈপুণ্য চাঁদ তারা নক্ষত্রের মতো মুগ্ধতার আলো ছড়াবে, এটাই ফুটবল আমোদীদের প্রার্থনা।" - চমৎকার কথা!
মাঠের উত্তাপ ছড়াক সারা বিশ্বে, তাতে কেউ না পুড়ুক, অন্যকে না পোড়াক। আনন্দ বেদনায় উদ্বেলিত হোক গোটা বিশ্ব। ক্ষোভ বিক্ষোভ হিংসা বিদ্বেষ এতোটুকুও না ছুঁতে পারুক ফুটবলকে। এই শুভাকাঙ্ক্ষা সব খেলোয়াড় এবং দর্শকের জন্য। - একজন খাঁটি ক্রীড়াপ্রেমিকের কথা বটে! একমত।