একটি পারিবারিক ফুটবলীয় গল্প

বিশ্বকাপ/ফুটবল প্রসঙ্গে আমার লেখাটি কতোটুকু প্রাসঙ্গিক তা জানিনা।বিশ্বকাপ এর শুরুতে প্রচণ্ড ফুটবল প্রেমিক একজন মানুষের কথা শুনতে হয়তো সবার ভালোই লাগবে

ক্যাডেট কলেজের ফুটবলের কথা আশাকরি সবারই মনে আছে। আহ!কি রোমাঞ্চকর দিনগুলি। নভিসেস ড্রিল এর আগে হাড় ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যে মাঝে মাঝে যখন বিকেলে ড্রিলের জায়গায় গেমস করার সুযোগ পাওয়া যেত,মনে হতো “এত সুখ কি আমার কপালে সইবে?” নাহ! সুখ বেশীদিন সয়নি। হাঁটু পর্যন্ত ঘাসে ভরা, অবহেলায় অযত্নে পড়ে থাকা প্রায় হাওয়া-বিহীন ফুটবলটাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলতো আমাদের ৫১ জনের। সেরকম এক বিকেলে বেকায়দায় ছুটে আসা বলটির আঘাত লাগলো ডান পায়ে। আমার রোগা পটকা ক্লাসমেটের কিকে এত জোর থাকতে পারে তা এখনও বিশ্বাস হয়না। বিশ্বাস না হলে কি হবে, আজ ১২ বছর পরও soleus পেশীটাতে হাত বুলিয়ে বুঝতে পারি এ দাগ যাবার নয়। সেদিন থেকেই আমার বুট(পড়ুন পিটি শু)জোড়া তুলে রাখা। তবে ফুটবল দেখতে আমার ভালো লাগে, ভালো লাগে ধারাভাষ্যকারদের মতো সমালোচনা করতেও।বার্সার খেলাগুলো দেখার চেষ্টা করি, টার্কিশ দল ফেনেরবাহচেরও খেলা দেখি সময় সুযোগ হলে। আজ আমার ব্লগের বিষয়বস্তু আমার ফুটবলপ্রেম না,লেখাটা কিছুটা পারিবারিক। আমার ঘরের মানুষগুলোর কথা।

আমি যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকেই বুঝতে পারি আমাদের বাসার লোকজন ক্রিকেট এর চেয়ে ফুটবল বেশী ভালোবাসে। বাসার স্টোররুমে দেখতাম বুট,নি-গার্ড,হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মোজা,শর্টস,জার্সি,গোলকিপারের গ্লাভস। সবগুলোই কেমন জানি পুরনো,ধুলো ময়লাতে ভরা। পরে আম্মাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আমার দুই মামাই নাকি বেশ ভালো ফুটবলার। একজন গোলকিপার আরেকজন মিডফিল্ডার। দুইজনেরই বেশ নাম ডাক, হায়ারে এখানে ওখানে খেলতে যায়। একজন মোহামেডানের সাপোর্টার আরেকজন আবাহনীর। কিন্তু দুজনই আবার আর্জেন্টিনার মারাত্মক ফ্যান। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই,আমাদের বাসায় একটা ১৭ বছর বয়সী আর্জেন্টিনার পতাকা আছে যেটা কমপক্ষে ১৮/২০ ফুট লম্বা। এতই লম্বা যে আমরা বিশ্বকাপের আগে ঐটা টানানোর মত লম্বা বাঁশ খুজে পেতাম না ।অগত্যা বারান্দার গ্রিলে ঝুলিয়ে রাখতে হতো।

ঘরে ছিল অসংখ্য পোস্টার, সবচেয়ে বেশী ছিল ম্যারাডোনা মাঠের মধ্যে পড়ে আছে পা ধরে, পেছনে বাঙলা ক্যাপশন “ওরা আমাকে এত মারে কেন”। এরিয়েল ওরতেগা, হারনান ক্রেসপো, হ্যাভিয়ার জানেত্তি কে ছিল না আমাদের ঘরে। ছোট মামা পোস্টার কেটে একটা প্ল্যাকার্ড বানিয়ে ছিল। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা চিৎকার করছে আর ক্যাপশনে লেখা “আমার চাই সোনার বুট”। আমি নয় আর আমার ছোট ভাই মাত্র ছয় বছর বয়সেই প্রত্যেকটা আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের নাম মুখস্থ বলতে পারতাম। এমনকি হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন,রবারত নেস্তোর সেন্সিনির নাম পর্যন্ত।

আমাদের বাসায় আরেকজন ছিল প্রচণ্ড ফুটবল পাগল,আমার নানা। প্রথমে ইপিআর পরে বিডিআর এ চাকরীর সুবাদে নিজেও ফুটবল খেলতেন। বয়সের ভারে পা না চললে কি হবে, মাথা থেকে ফুটবলটাকে তখনও বাদ দিতে পারেনি। তখনকার দিনে তো এত চ্যানেল এত ইন্টারনেট ছিলনা, তারপরও ফুটবলের টুকিটাকি সব খবর রাখতেন। শুধুমাত্র ফুটবলের খবর পড়ার জন্য পত্রিকা পড়তে প্রতিদিন ছুটে যেত মোড়ের চা-স্টলে। ছোট দুই নাতিকে শোনাতো পেলের কথা, ম্যারাডোনার হাত দিয়ে গোল করার কথা। নানাও আর্জেন্টিনার ফ্যান ছিল,তাই ঐ বয়সেই আমার ধারনা হয়েছিল পেলে ভালো খেলোয়াড় কিন্তু ম্যারাডোনা গড টাইপ কেউ।

দেয়ালে পোস্টার, টেবিলে স্টিকার, বারান্দায় পতাকা করতে করতে এসে গেল ৯৮ এর ফ্রান্স বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক কয়েকদিন আগে আমাদের সবেধন নীলমণি ১৪ ইঞ্চি রঙিন ফিলিপস টিভিটা গেল নষ্ট হয়ে। নানা ঠিক করতে নিয়ে গেল দোকানে, ফিরে এল বিরস বদনে। পিকচার টিউব নষ্ট হয়ে গেছে টিভিটার, ঠিক করতে হাজারখানেকের বেশী টাকা লাগবে। সংসারে তখন প্রচণ্ড টানাপোড়েন। নানার পেনশনের টাকা দিয়ে ছোট মামার পড়াশোনা, সংসারের সব খরচ, সব মিলিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটছিল সবার। বড় মামা পাশ করে চাকরীর সন্ধানে ঢাকায় গেছে, তারও দিন কাটছে টানাটানিতে। ভালো ছবি আঁকত বলে তা দিয়েই কোনমতে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। এমন সময় টিভির পেছনে এতগুলো টাকা খরচ করা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। নানা যেমন ফুটবল পাগল মানুষ তাতে খেলা দেখার জন্য যেমন করেই হোক টিভিটা ঠিক করাতো, কিন্তু নানীর ভয়ে সেই সাহস করে উঠতে পারেনি।

টিভি নষ্ট বলে তো আর নানার বিশ্বকাপ দেখা আটকে থাকতে পারেনা, তাই নানা ঠিক করলো এবারের বিশ্বকাপটা দেখবে একমাত্র বন্ধু স্বর্ণকার কানাই দাস এর বাসায়। সংসারে অশান্তি থাকলে সবার মেজাজই খিটখিটে থাকে তাই নানার এই আপাত সরল প্ল্যানেও বাধ সাধলো নানী, বলল চুপ করে বাসায় বসে থাকো, বুড়ো বয়সে খেলা দেখতে হবে না। নানা তারপরও লুকিয়ে চুরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তো, খেলা দেখে কখনো রাতে কখনো গভীর রাতে বাড়ি ফিরত। কোন কোনদিন ছাতা নিতে ভুলে যেত, বাসায় ফিরতে ফিরতে বৃষ্টিতে পুরো মানুষটা কাক ভেজা। পরদিন আমাদের দুই ভাইকে শোনাত কি হয়েছিল গত ম্যাচে। শুধু বিশ্বকাপই নয় পাড়ার ছেলেপেলেরা যখন কাদা ভরা মাঠে ফুটবল খেলত নানা তখনও মাঠের পাশে দাড়িয়ে থাকতো, এটা ওটা মন্তব্যও করতো মাঝে মাঝে।

৯৮ এর বিশ্বকাপই ছিল নানার দেখা শেষ বিশ্বকাপ। ১৯৭১ সালে রাইফেল হাতে সম্মুখ-সমরের এই যোদ্ধাটি জীবনযুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে পরাজিত হয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে, বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরে। এরপর বিশ্বকাপ এলেই বাসার সবার মন ভারি হয়ে ওঠে। বাসায় এখন দুইটা টিভি, নানার স্মৃতি রক্ষার্থে পুরনো ফিলিপসটাও যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে নানী। মাঝে মাঝে নানাকে স্বপ্নে দেখি,মাঝে মাঝে কথা বার্তা হয় ফুটবল নিয়ে। এই তো সেদিন বললাম “তুমি তো খালি ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা করতা,মেসির খেলা দেখছো?”নানা বলল “মেসির ড্রিবলিং,পাস ভালো তবে ডি মারিয়ার স্পীড,কিক,হেড আরও ভালো”। কে জানে ঐ পাশের দুনিয়ায় ফুটবল দেখার ব্যাবস্থা আছে কিনা,নইলে বেশ কষ্ট হবে লোকটার।

২৩ টি মন্তব্য : “একটি পারিবারিক ফুটবলীয় গল্প”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    তোমার নানার প্রতি শ্রদ্ধা।

    আমিও ছোট বেলায় পুরোনো ট্রানকে হঠাত আবিষ্কার করি জার্সি, বুট। জানতে পারলাম আব্বু গ্রামে ডাকসাইটে গোলকিপার ছিল, বাড়িতে গেলে শুনতাম হায়ারে গিয়ে আসেপাশের জেলায় গিয়ে আব্বুর খেলার গল্প। তখন থেকেই নিজেকে গোলকিপার হিসেবে চিন্তা করতাম, শেষ পর্যন্ত ঐ পজিশনে কলেজ টিমে খেলি। টিমে চান্স পাওয়ার কথা যখন প্যারেন্টস ডে তে আব্বুকে জানাই তখন তার চোখে মুখে অন্যরকম একটা হাসি দেখেছিলাম 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    চমৎকার লিখেছ হুমায়ুন।

    এজন্যই শুধু ক্যাডেট কলেজ ব্লগেই ঢু মারা হয়। দিনে কয়েকবার। এত চমৎকার লেখাগুলো আর কোথাও আসেনা বলেই বিশ্বাস করি।

    ভালো থাকুন নানা...


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।