নিমন্ত্রণ

ওয়ানডে ম্যাচে একটা ভালো পার্টনারশিপ ছাড়া যেমন বড় স্কোর করা যায় না, তেমনি স্বামী-স্ত্রীর ভালো পার্টনারশিপ ছাড়া দুর্দান্ত রান্নাও করা যায় না। কুঁচো চিংড়ি দিয়ে বাগানের টাটকা লাল শাক ভাজি করাই হোক কিংবা একটু বেশি ঝোল আর ঝাল রেখে চালের রুটি দিয়ে খাবার জন্য রান্না করা দেশি গরুর মাংসই হোক, আমার মা কখনোই একা পুরোটা কৃতিত্ব নিতে পারেন নাই। ঘরে আর বাইরের যারা খেয়েছে, যারা মুগ্ধ হয়েছে, যারা প্রচণ্ড ঝাল লেগে হাঁসফাঁস করতে করতেও প্লেট বাড়িয়ে আরেক চামচ গরুর ভুঁড়ি চেয়েছে, তারা পুরো গল্পটা না জানলেও আমি জেনেছি।

আমার বাবা সরল মনের মানুষ। আর তার এই সরলতার সুযোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ছিনিমিনি খেলেছে কাঁচাবাজারের দোকানিরা। তবে প্রতিদিন তো আর ঠকা সম্ভব না। তাই আমার বাবা যেদিন ভালো কিনতেন, সেদিন আসলেই বাজারের সবচেয়ে ভালোটাই কিনতেন। সাগর পাড়ের খুব কাছাকাছি থাকতাম আমরা। বাজার ভর্তি সাগরের মাছ। বাবার মুখে তার গ্রামের বিলের মাছের গল্প শুনতাম। বোয়াল, চিতল, শোল, ট্যাঙরা আর দেশি কই নাকি বড়শি ফেললেই টপাটপ উঠে আসত। শোল মাছ রান্না করতে হয় মিষ্টি লাউ দিয়ে। দেশি কইয়ের ঝোল আঙুলে চেটে না খেলে ব্যাপক মিস। বোয়াল আর চিতল তো সবাই রাঁধতে পারে না। সন্দেহ হচ্ছে? অনেক ভালো রাঁধুনি আছে যারা এই মাছ দু’টো ঠিকমত কাটতেই পারেনা। সবার সে যোগ্যতা নেই।

সে যোগ্যতা ছিল তার স্ত্রীর। আমিও একবাক্যে মেনে নিই, সে যোগ্যতা আমার মায়ের চেয়ে বেশি কারো ছিল না। আমি বড় হয়েছি সাগরের নোনতা মাছ খেয়ে। সাগরের নোনতা আর বিলের মিষ্টি মাছের ভেতর তুলনা করলে আমি চোখ বন্ধ করে লইট্যা-বাতাসি-কোরাল-বাটা মাছের দিকে রায় দেবো। সাথে আছে নানা পদের শুঁটকি। নিজের হাতে তুলে আনা বাগানের ফ্রেশ কলমি শাক দিয়ে ছুড়ি শুঁটকি রান্না করতেন আমার মা। আর রাঁধতেন লইট্যা মাছের চচ্চড়ি। অল্প করে আলু কুচি করে দিতেন। শপথ করে বলতে পারি, আমার মায়ের রান্না লইট্যা মাছ খেলে যে কেউ বলতে বাধ্য হবেন যে লইট্যার চেয়ে স্বাদের মাছ বাংলাদেশে নাই। জি, আমি সরিষা ইলিশ অনেক খেয়েছি, চাঁদপুরের ইলিশের কথাই বলছি, লইট্যার সাথে ফাইট করে ইলিশ পারবে না।

মাসে একদিন শুক্রবার ফজরের নামাজের পর বাবা লেবার কলোনিতে যেতেন। সেখানে দেশি ষাঁড় গরু জবাই হত। বাবা হাড্ডিছাড়া সলিড মাংস কিনতেন, সাথে ভুঁড়ি আর পা। মাঝে মাঝে কলিজা আর মগজ। বাসায় ফিরে তিনি লেগে যেতেন গরুর পা সাইজ করতে, আর তার পার্টনার জ্বাল দিত ভুঁড়ি। সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অন্তত তিনদিন ধরে জ্বাল দেয়া হত। অবশেষে যেদিন মসলাপাতি দিয়ে ফাইনাল রান্না করা হত, সেদিন ছিল আমাদের আসল ঈদ। বরং ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের দিন, কারণ ঈদের দিন তো কেউ গরুর ভুঁড়ি আর গরুর পায়া রান্না করে না। গরম ভাতের সাথে প্রচণ্ড ঝাল গরুর ভুঁড়ি আর চালের আটার রুটি দিয়ে গরুর নেহারি~ কে জিতবে? এর উত্তর আমি কেন, আমার বাবাও হয়তো জানেন না।

সবজির বাগান করার নেশা ছিল আমার বাবার। বাসার পেছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় কোদাল দিয়ে কুপিয়ে খেত বানাতেন। বাজার থেকে সার আর বীজ কিনে আনা হত। সেখানে লালশাক, পালংশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক আর কচু হত চমৎকার। টমেটো, ঢেঁড়স আর বেগুন গাছ বেশ কয়েকবার লাগানো হয়েছিল, কিন্তু ভালো কিছু পাওয়া যায় নাই। সকালে স্কুলে যাবার আগে আমি বালতিভরা পানি আর প্লাস্টিকের মগ নিয়ে বাগানে যেতাম। হালকা সবুজ পালং শাকের কচি পাতার ওপর মগ দিয়ে পানি ঢালতাম, হাত দিয়ে ছিটিয়ে দিতাম পুরো বাগানে। দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পর আমি শাক তুলতাম, আমার মা তুলতেন কচুর লতি। তবে কষ্ট হত কচুর খেতে পানি দিতে। বার্জার পেইন্টের ডিব্বার হাতলে দড়ি বেঁধে খেতের পাশের ড্রেন থেকে পানি তুলতে হত। তারপর নালা কেটে সেই পানি পৌঁছে দেয়া হত কচু গাছে। কাজটা সবচেয়ে বেশি করত আমার বড়ভাই। ওর জন্য বাবার আদেশ ছিল কচুর খেতে পানি দেয়া শেষ করে ক্রিকেট খেলতে যাবে, এর আগে যেতে পারবে না। নোংরা মনে হচ্ছে? আমার ধারণা এই দায়িত্বটা এখন সে খুব মিস করে।

আমার বাবার আর মায়ের এই রান্নার পার্টনারশিপ এখন বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। বিভিন্ন অসুস্থতায় কয়েকবার ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের দরজা-জানলা দেখে আসা মা এখন ভাল রাঁধতে পারেন না। বাবা বুড়িয়ে গেছেন, সবজি চাষ করার শক্তি নেই, হাঁটুর ব্যথায় দাঁড়িয়ে নামাজটাও পড়তে পারেন না। অনিন্দ্যসুন্দর শহর চট্টগ্রাম আজ অনেক দূরে। বাজারে দেখিনা লইট্যা, বাতাসি কিংবা সাগরের কোনো মাছ। কেমিক্যাল আর ফরমালিনের ভয়ে বাবা শাকসবজি কেনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। আমার খুব ইচ্ছে করে আবারো বাবার সাথে পালং শাকের বাগান করি, মায়ের সাথে কাদায় নেমে কচুর লতি তুলে আনি। মাকে বলতে ইচ্ছে করে, আর একবার সেই সময়ের মত করে কলমি শাক দিয়ে শুটকি রান্না করেন, বাটা মাছ দিয়ে পালং শাকের ঝোল, সাথে ছোট চিংড়ি দিয়ে লাল শাক ভাজি। কষ্ট হবে জানি, তবুও বাবাকে বলতে ইচ্ছে করে লেবার কলোনিতে আর একবার চলেন, বাপ বেটা মিলে ভুঁড়ি পরিষ্কার করব, পায়া রেডি করব। মাকে বলব, আপনার সেই রান্নাটা আর একবার করেন, যেটা খেয়ে প্রচণ্ড ঝাল লাগার পরও পানি খেতে ইচ্ছে করবে না, মুখে স্বাদটা লেগেই থাকুক। খানিকটা ডিমের মিহিদানা বানাতে হবে। আমার মায়ের বানানো বিশ্বসেরা ডেজার্ট।

একটা মানুষ পায়ের প্রচণ্ড ব্যথাতেও চুপ করে থাকে, কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে পেইন কিলার খেয়ে নেয়। বাবার নিষেধ না মেনে দেশের জন্য খেলতে নামে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিল্ডিং করে পুরো পঞ্চাশ ওভার। দলের সবচেয়ে বিপদের সময় অন্য কারো দিকে চেয়ে না থেকে নিজে বল হাতে তুলে নেয়। জানিনা কয়টা নি-ক্যাপ তার হাঁটুতে বাধা, জানিনা দুই হাঁটুতে সাতটা সার্জারি করার পরেও একজন মানুষ কীসের জোরে পেস বোলিং করে, জানিনা একজন মানুষের দেশপ্রেম কতখানি হলে তার নাম “মাশরাফি বিন মুর্তজা” হয়। অনেকেই ভালো খেলতে পারে, অনেকেই বড় মাপের মানুষ হয়, অনেকেই বিশ্বসেরা হয়। কিন্তু অনেকেই একজন মাশরাফির জন্ম দিতে পারে না। মাশরাফির বাবা জানিয়েছেন, ফিটনেস ধরে রাখার জন্য তাঁর ছেলে অনেক বছর হয়েছে পেট ভরে ভাত খায় না।

মাশরাফি, তোমার এত ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। তবু তুমি একটা দিন আমাদের বাড়িতে এসো। আমার বাবা অনেক স্নেহ নিয়ে বাজার করে আনবেন, আমি বাগান থেকে টাটকা শাকের কচি পাতা তুলে আনব, আমার মা তার হৃদয়ের সবটুকু মমতা খুন্তি-কড়াইয়ে মিশিয়ে দিয়ে রান্না করবেন। তোমাকে আমি একবেলা পেট ভরে ভাত খাওয়াতে চাই।

তুমি যাবে? যাবে মোর বাড়ি?

৪,৯৭৪ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “নিমন্ত্রণ”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এই লিখাটা পড়লে কৌশিক অবশ্যই একদিন তোমাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যেতে চাইবে।
    এতটা ভালবেসে কেউ নিমন্ত্রন জানালে সেটা ফেলে দেবার মত ইনসেন্সিটিভ আর যে ই হোক না কেন, আমাদের নড়াইলের কৌশিক না।
    দেখি, তোমার এই নিমন্ত্রন কৌশিকের কাছে পৌছুনো যায় কিনা।
    আমাদের নড়াইলেরই ছেলে যখন...

    খুব ভাব লিখেছো এই ট্রিবিউটটা। :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দূর্দান্ত লেখা রিফাত, শুরু থেকেই দারুন একটা ভাল লাগা কাজ করছিল পড়তে পড়তে, শেষে এসে অন্যরকম ভাবে আলো বেশি ভাল লাগলো। :hatsoff:

    আরো পড়তে চাই


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. সোহান (২০০৪-১০)

    লেখাটা পড়ে মনে মাঝে শূন্যতা আর জীভের মাঝে জল দুইটাই এল। 😀 হলফ করে বললাম এই লেখা পড়লে স্বয়ং মাশরাফি তোর নিমন্ত্রন অগ্রাহ্য করবে না। :hatsoff:
    ::salute::


    আমি সিগারেটের ছাই, জানালার ধুলো। চাইলেই ফু দিতে পার। ঊড়ে যাব।

    জবাব দিন
  4. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    দোস্ত, তোর ফুটবল আর ক্রিকেট দেখে হিংসে হয়েছে কলেজে থাকতে। আজ সত্যিই হিংসে হচ্ছে তোর এই লেখা টা পড়ে। অসাধারণ দোস্ত।
    :just: :boss: :hatsoff:


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।