– চাচা, একটু বাইরে আসবেন?
রহমান সাহেব স্ত্রীর মাথার কাছে চেয়ার পেতে বসে ছিলেন। তরুণ ডাক্তারের ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল শ্যামলা মতন নার্সটা । ডাক্তারের ইশারায় সে ভেতরে ঢুকল। কেবিনের দরজা চাপিয়ে দিল।
– চাচা, চলেন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
এই ডাক্তার ছেলেটাকে তার খুব পছন্দ। গত তেরোদিন ধরে এই ছেলেটাই তার স্ত্রীর চিকিৎসা করছে। লম্বা, ফর্সা, কিছুটা ভারি শরীর। রহমান সাহেব তার মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন বহু বছর হল। ছোট একটা মেয়ে থাকলে তিনি অবশ্যই এই ছেলের বাবার সাথে দেখা করতেন।
– স্ত্রীর সাথে কি আপনার এখন স্বাভাবিক কথা হয়, চাচা?
– মাঝে মাঝে তো হয়ই। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তো চুপ করে থাকে।
– উনার অসুখটা সম্ভবত আমরা ধরতে পেরেছি।
রহমান সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েন। ডাক্তার গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ হাতে নামিয়ে নেয়। নিচু গলায় বলতে শুরু করে।
– আপনার স্ত্রীর মাথার ভেতরে কী চলছে সেটা আমরা ধরতে পারছি না, কিন্তু আপনার কথা থেকে কিছু ধরতে পারছি। উনার সবগুলো রিপোর্ট নরমাল। একদম সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতন।
– তাহলে কথাবার্তা এলোমেলো হচ্ছে কেন, ডাক্তার সাহেব? আবার কখনো চুপ করে থাকছে। আপনি তো দেখলেনই গত সপ্তাহয় টানা দুইদিন কথা বলল না, কিছু খেল না। রহমান সাহেবের গলায় প্রবল দুশ্চিন্তা, কপালের ভাঁজে তীব্র হতাশা।
– সম্ভবত উনার ভেতর খুব খারাপ ধরণের ডিপ্রেশন কাজ করছে। আপনি উনার সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তাতে আমার মনে হয়েছে উনি ছেলেমেয়েদের খুব মিস করছেন।
রহমান সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বড় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন কুড়ি বছর হল। বড় নাতি এবছরই ম্যাট্রিক দিল। নাতনিটা ক্লাস সেভেনে পড়ে। মেয়ের শাশুড়ি একসাথে থাকেন। সংসার ফেলে কতদিন তিনি মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখবেন?
ছোট মেয়েটা সন্তানসম্ভবা। তবুও সে মায়ের যত্নে কোনো ছাড় দেয়না। গত সপ্তাহেই এসেছিল। পুরো সাতদিন ছিল। শরীর কিছুটা খারাপ করাতে জামাই এসে নিয়ে গেছে। বাদ থাকলো শুধু মেজো ছেলেটা। একমাত্র ছেলে। বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, তবু বিয়ে করলো না। ঢাকায় একা থাকে। ভালো চাকরিই করে। প্রতি মাসে ভালো অংকের টাকা পাঠায়। তবে সংসারের প্রতি টান কম। হঠাৎ করে কাউকে না জানিয়ে বাসায় এসে হাজির হয়। টানা দু’দিন মায়ের গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকে। রান্নাঘরে বসে গল্প করে। মাঝরাত পর্যন্ত মায়ের সাথে ফিসফিস করে কথা বলে ড্রইং রুমে।
রহমান সাহেব এই ছেলের কাজকর্ম কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। ছেলেটা তার সাথে ফরমাল কথার বাইরে একটা কথাও বলেনা। তিনি বেশ কয়েকবার স্ত্রী কে জিগ্যেস করেছিলেন, ইমন কী কথা বলে তোমার সাথে? শিউলি ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিয়েছে, তোমার জানতে হবে না।
– চাচা, কিছু ভাবছিলেন?
– না না, তেমন কিছু না।
– টেনশন করবেন না চাচা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখন যাই, নিচতলার ওয়ার্ডে একবার রাউন্ড দিয়ে আসি।
– আচ্ছা, যান।
সিঁড়ি ধরে নামতে গিয়ে ডাক্তার আতিক হঠাৎ থামল।
– চাচা শোনেন!
– হ্যাঁ
– নিজের শরীরের যত্ন নেবেন, আপনার ওপর দিয়ে খুব ধকল যাচ্ছে।
– আচ্ছা বাবা, নিবো। ছেলেটাকে তিনি আপনি করে ডাকতেন। বেখেয়ালে বাবা আর তুমি ডেকে ফেলেছেন। রহমান সাহেব মনে মনে লজ্জা পান। আর বুক ভরা ভালোলাগা নিয়ে ডাক্তার ছেলেটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়।
কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকতে গিয়েই রহমান সাহেব থমকে গেলেন। বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার নাতি। তার পাশে দাঁড়ানো ছোট মেয়েটা। বড় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মিটিমিটি হাসছে তার নাতনি। ইমন আরো শুকিয়ে গেছে, কালোও হয়েছে। কিন্তু হুইল চেয়ারে লাল বেনারসী পরে বসে থাকা মায়ের কোলে মাথা গোঁজা এই যুবক ছেলেটাকে তার কাছে দেবশিশুর মতন লাগছে। মায়ের হাতে হাত রেখে ইমন একটা কাগজ মেলে ধরল।
“ ইমনের বাবা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি। শুভ বিবাহবার্ষিকী — শিউলি”
এই হাতের লেখা তিনি চেনেন। নিজে ধরে ধরে ছেলেটাকে শিখিয়েছিলেন। সবাই বলতো, ইমনের লেখায় মুক্তো ঝরে। রহমান সাহেবের গাল বেয়েও কি এখন মুক্তো ঝরে পড়ছে না?
অনেক ভালো লাগলো এই লেখাটা পড়ে।
এককথায় দারুন একটি দৃশ্যের ছবি দেখলাম বলে মনে হলো।
চমৎকার।
:just:
:thumbup:
ভালো থাকা অনেক সহজ।
অনেক ধন্যবাদ, সাদাত ভাই। আপনার লেখাও নিয়মিত পড়ি। ভালো লাগে। চালিয়ে যান ভাই 😀
যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
:clap:
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
অনেক ধন্যবাদ আহমদ ভাই। আমার সব লেখাই আপনি পড়েন। আমার খুব ভালো লাগে 🙂
যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
48 likes !!!
Good one.
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
অনেক ধন্যবাদ, আপা 😀
দোয়া করবেন।
যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা