আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ!(দুই)

আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলাম এক মহা বিস্ফোরণ এর দিকে। এগিয়ে আসছিলো ২৫ শে মার্চ, পশ্চিম পাকিস্তানী দের সেই মহা পরিকল্পনার রাত!

ওদের নাকি বাঙালীদের আর প্রয়োজন নাই। ওরা শুধু আমাদের ৫৫ হাজার বর্গ মাইল মাটি চায়, তাই ‘ অপারেশন সার্চ লাইট ‘ জ্বালিয়ে মেরে ফেলতে চায় আমাদের সবাইকে। মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দিতে চায় ওরা আমাদের সকল ঘড়-বাড়ী, মসজিদ-মন্দির, স্কুল-কলেজ । এরই নাম নাকি ” পোড়া মাটি নীতি ” শুধু মাটি থাকলেই চলবে ।এখানকার কৃশকায় কিছু ‘ বাঙাল ‘ যদি বেঁচে যায় , ‘ দাস ‘ হয়ে থাকবে। ওরা নিজেদের টকটকে ফর্শা , টিকালো নাক , পাঠান-পশতু-আফ্রিদিদের দিয়ে এই    ‘মাশরেকি পাকিস্তানের “ওয়াতান” সমৃদ্ধ করবে ।

চট্টগ্রাম থেকে ২৫ শে  মার্চ কাল রাত্রির বিভীষিকা কিছুই বুঝিনি।রাজার বাগ, ভার্সিটির উত্তাপ এখানে এসে পোঁছেনই , শুধু নিউজ ব্ল্যাক আউট , স্তব্ধ রেডিও , চারি দিকে গুঞ্জন, ঢাকায় কি হচ্ছে আল্লাহ মালুম !

শেখ সাহেবের আহ্বানে  মার্চের মাঝা মাঝি থেকেই কার্যত চট্টগ্রাম স্বাধীন ।লাল সবুজের শহর । প্রতিটি মহল্লায় লাঠি বাঁশ হাতে যুবক পুরুষ প্রস্তুত হচ্ছে। কীসের বিরুদ্ধে , বিন্দু মাত্র জ্ঞান নেই ।আসলে সম্পূর্ণ দেশটাই হত বিহবল ! কারো ধারনাই ছিল না এমন কিছু ঘটতে পারে, তাই কোন প্রস্তুতিও ছিল না কারো।

কেন্দ্রীয় সরকার ইসলামাবাদের  বা সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া ভালই চলছিলো আমাদের চাঁট গাঁ ! পুলিশ-বাঙালী ভাই ভাই, ভুট্টো – ইয়াহিয়ার ফাঁসি চাই বলে সরগম ছিল পাড়া । বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় কি তাণ্ডব বয়ে গেছে কারো কোন ধারনাই নাই। শুধু গুজব, মহা বিভীষিকা নাকি ঢাকাকে মৃত নগরে পরিণত করেছে।

২৬ শে মার্চ, শুক্রবার । বাবার সাথে ‘মক্কি মসজিদে’ জুমা আদায় করে ফিরে আসছি। থেমে থেমে গুলির আওয়াজ হচ্ছে । খামাখাই ব্ল্যাংক ফায়ার ! আসল খেলা শুরু হতে আর অল্প সময় বাকি।

দুপুর থেকে বিনা মেঘে বজ্র পাতের মত শুরু হলো নৌ বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ ‘ বাবর ‘, ‘ জাহাঙ্গীর ‘ ইত্যাদি থেকে লং ডিসটেন্স কামানের গোলা বর্ষণ । ওদের        ইন্টালিজেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী “Resistance Pocket”  গুলি যেমন, কাচারি পাহাড় , পুলিশ লাইন, প্রবর্তক পাহাড়ের অনাথ হিন্দু আশ্রম, ওদের   prime target!

একেক বারে তিনটা করে বিশাল কামানের গোলা মাথার উপর দিয়ে উড়ে এসে প্রবর্তক পাহাড়ের আশ্রম এর উপর পরতে লাগলো । অক্লান্ত ভাবে। সারা বিকেল, সারা রাত।Target এর  ২০০ মিটারের মধ্যে আমাদের পাঁচলাইশ এর বাড়ি ।একদম line of Fire এ। জেটিতে নোঙ্গর করা পাকিস্তান নৌ বহর থেকে সোজা মেডিকেল কলেজের উপর দিয়ে উড়ে এসে গোলা গুলি যখন উচ্চতা হারিয়ে  প্রবর্তক পাহাড়ের উপর পরে, কোন একটা লক্ষহীন হয়ে মনে হয় মাথার উপরই পড়লো বুঝি ।

প্রবর্তক অনাথ আশ্রম থেকে অনেক হতাহতের খবর এলো। কাচারি পাহাড় বা কোর্ট বিল্ডিং এর প্রাচীন পর্তুগীজ দুর্গের একটা অংশ ধসিয়ে দেয়া হয়েছে শুনলাম। কিন্তু  ঢাকার তাণ্ডবরত ‘পাক আর্মি’ দের কোন নিশানাও চট্টগ্রামে কেও খুঁজে পেলনা।

কোন মতে রাতটি কাটিয়ে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আর শহরে থাকা চলবেনা। সকলের কিছু কিছু জামাকাপড়, চাল-ডাল গাড়ীতে তুলে , বিকালের মধ্যেই পালালাম শহর ছেড়ে। প্রথম গন্তব্য কালুরঘাট ‘শাহ সুলতান সাহেবের বাড়ী’ । বাবার পীর সাহেব ।

চান্দ গাঁও আবাসিক এলাকা তখনো হয়নি।মুরাদপুরই ছিল শহরের শেষ সীমানা । কালুরঘাট , বদ্দার হাট ছিল তখন মোটামোটি শহরের বাইরে।গ্রামের পরিবেশ । কয়টা দিন আনন্দেই কাটছে।

শহর থেকে আতঙ্ক জনক খবর আসে, পাকিস্তান নেভীর কমান্ডোরা নাকি পোর্ট থেকে বড়ো নালাটা দিয়ে দলে দলে শহর পর্যন্ত এসে আচানক বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে, অতর্কিতে পেছন থেকে, স্বল্প প্রশিক্ষিত পুলিশ/ই পি আর দের ঘায়েল করে, দখল করে নিচ্ছে ।

কর্ণফুলী নদী থেকে আগ্রাবাদ,পুলিশ লাইন, মেহদীবাগ, মেডিকেল কলেজ হয়ে বিশাল একটা খাল ( পরবর্তীতে  নালা ), কাঁতাল গঞ্জ হয়ে চাকতাই খালে পড়েছে , সেই নালাটা দিয়েই ক্রলিং করে নৌ কমান্ডোরা শহরের ভিতর ঢুকে পরে। ব্যাপার টা এতোই অভাবনীয় এবং অবিশ্বাস্য যে বাঙ্গালীদের শহর প্রতিরক্ষা নস্যাৎ হয়ে যায়। লালখান বাজার পুলিশ লাইনে অসংখ্য বাঙ্গালি মারা পরে। আমাদের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় ও প্রায় চব্বিশ পঁচিশ জন শহীদ হন ।

ওরা যখন শহর দখল করতে ব্যস্ত , সম্ভবতঃ মার্চের শেষ অথবা এপ্রিল এর প্রথম দিকে হবে, কালুরঘাট তখনো মুক্তাঞ্চল। এদিকে রচনা হচ্ছে ইতিহাসের আরেক অধ্যায় ।

শুনছিলাম “কালুরঘাট রেডিও স্টেশনে ”  কিছু একটা হচ্ছে । গত কয়দিন ধরেই এই রেডিও স্টেশন থেকে শুধু নজরুল এর রণ সংগীত ” চল চল চল”…,” কারার ঐ লৌহ কপাট ” ইত্যাদি গান প্রচারিত হচ্ছিলো বাঙালিদের  তত্ত্বাবধানে।

হঠাৎ ঘোষণা হলো ঃ ” আমি মেজর জিয়া বলছি ………”।

স্বল্প ক্ষমতা সম্পন্ন এই বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা দেশের কতটুকু জায়গায় পৌঁছেছিল আমার জানা নেই, কিন্তু ২৫ শে মার্চের রাতের পরে ঢাকার খবর থেকে বঞ্চিত, মনোবলহীন, দিক নির্দেশনাহীন বাঙ্গালীদের জন্য মেজর জিয়ার ঐ ভাষণ  মৃত সঞ্জীবনীর মত কাজ করেছিল, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ।

(চলবে )

 

৮৯৬ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ!(দুই)”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।