পূর্বের পর্ব: প্রবাসে প্রাকৃতজন: পরিবেশ পরিচিতি (১ম ভাগ)
একদিন স্কুল থেকে ফিরে গোধূলি জানালো যে তাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে এসেছে, নাম লীয়াহ। কয়েকদিন পরেই পরিচয় হল লীয়াহর বাবা অ্যান্ডির সাথে। ভদ্রলোক পেশায় অর্থপেডিক সার্জন, (তাঁকে আমি ফাজলামো করে মাঝে মধ্যে বাংলায় হাড়-কবিরাজ বলে ডেকে থাকি) । আমাদের মিডল্যান্ডস এলাকায় বেশ নাম ডাক ওয়ালা কনসালটেন্ট। আদিতে নাইজেরিয়ান, দীর্ঘদিন স্লোভানিয়াতে ছিলেন। গায়ে গতরে নেহায়েত মন্দ না, নির্জন রাস্তায় হঠাৎ সামনে পরলে যে কেউ রীতিমত ঘাবড়ে যাবে। ভদ্রলোক বয়সে আমার চেয়ে পাচ-ছয় বছরের বড় হবেন। প্রথম দিন আলাপের পর থেকেই জমে গেলাম। দারুন আমুদে লোক, থাকেনও আমার মহল্লাতে। দেখা সাক্ষাৎ হয় যখন তখন। অ্যান্ডির স্ত্রী একজন স্লোভানিয়ান। এতদিন তিন গোয়েন্দা পড়ে জেনে এসেছি ব্যাভারিয়ানরা গায়ে-গতরে পালোয়ান টাইপের হয়। এখন দেখছি কার্পাথিয়ান রেঞ্জ এলাকার মানুষেরাও কম যায় না। স্বয়ং অ্যান্ডিকেও তাঁর পাশে মামুলি মাঝারি আকৃতির মনে হয়।
অ্যান্ডিকে আমি ডক (ডাক্তার) বলে ডাকি, তিনি আমাকে স্যার-প্রফেসার বলে ডাকতেন। কিন্তু প্রথমবার এরকম সম্বোধন করার সাথে সাথেই এই প্রফেসর শব্দটা ব্যবহার না করতে অনুরোধ করলাম। অ্যান্ডির কৌতূহল মেটাতে শেষমেশ ব্যাপারটা একটু বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করলাম। দেশে থাকতে প্রায় বছর দশেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম বৈকি, কিন্তু প্রফেসর পদ পর্যন্ত পৌঁছাতে তখনও অনেক পথ বাকী ছিল। তাই আমার নামের আগে প্রফেসর শব্দটা লাগালে সেটা হবে চরম ধৃষ্টতা, চরম অভব্যতা। তাছাড়া আমাদের দেশে হাত-দেখা জ্যোতিষীরা এবং নিজেকে “সৎ লোকেদের” সর্দার দাবীকৃত জনৈক একজন নিতান্ত অসৎ ভাবে এবং দৃষ্টিকটু ভাবে তাঁদের নামের আগে প্রফেসর শব্দটা ব্যবহার করেন। সেকারণে অপাত্রে-কুপাত্রে প্রফেসর শব্দটা ব্যবহারের প্রতি আমার তীব্র এর প্রকার এলার্জি জন্মে গেছে। এজন্য বন্ধুমহলে বা ঘরোয়া আলাপেও কেউ আমাকে প্রফেসর বললে আমার কান গরমে লাল হয়ে যায়, এখনও হয়ে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অ্যান্ডি আর কখনও আমাকে প্রফেসর বলে ডাকেনি।
গোধূলিকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে সেদিন অ্যান্ডিকে দেখলাম সাংঘাতিক রকমের অস্থির হয়ে আছে। কি ব্যাপার? না, সে দৌড়ের উপরে আছে। লীয়াহকে বাসায় রেখেই রওয়ানা হতে হবে লুটনের উদ্দেশ্যে। আমাদের শহরের নিকটতম এয়ারপোর্টটি লুটনে, তাই ভাবলাম বোধ হয় প্লেন ধরতে যাচ্ছে। কিন্তু না, আসল ব্যাপার হল সে কয়েকদিন আগে মোটরওয়েতে স্পীড লিমিট অমান্য করে ধরা খেয়েছে। এখন লুটনস্থ কোন এক সরকারী দপ্তরে কোন এক মুরুব্বীর সামনে গিয়ে “ধরিলাম কান, থাকিতে প্রাণ, স্পীড লিমিট ভায়োলেশন? করিবোনা আর কখন” – টাইপের কিছু প্রতিজ্ঞা-টতিজ্ঞা করতে হবে, এই আর কি।
আমি বললাম, এ আর এমন কি? এতে তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্সে তো কোন পয়েন্ট পড়ছে না, তাহলে এটা নিয়ে এত অস্থির হবার কি আছে? অ্যান্ডি জানালো এর চেয়ে বড় একটা হুজ্জোত ঘটে গেছে। তাঁর গাড়ির ব্রেক লাইটগুলো হঠাৎ করেই আর কাজ করছে না। এখন এই অবস্থায় ড্রাইভিং করতে গিয়ে আবার কোথায় কোন আপদে পড়বে, সেই টেনশানেই এত অস্থিরতা।
আমি তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, দেখ, মানুষ মোটর গাড়ি চালাচ্ছে আজ একশ’ বছরের কিছু বেশী হবে। অন্যদিকে ঘোড়া-গাধার পিঠে চড়ছে হাজার হাজার বছর ধরে। তো, কাউকে কখনও দেখেছ ঘোড়া-গাধার পিছে ব্রেক লাইট ব্যবহার করতে? কল্পনা করো তো, চেঙ্গিস খান ঘোড়ার পিছনে ব্রেক লাইট লাগিয়ে যুদ্ধের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, কিংবা নাসিরুদ্দিন হোজা কোন এক বেজায়গায় তাঁর গাধাকে পার্ক করে রেখেছেন আর সেটির লেজে ঝুলানো ব্রেক লাইট জ্জ্বল-জ্বল করে জ্বলে আছে? সাথে সাথে তাল মিলেয়ে অ্যান্ডি যোগ করল, কিংবা ধরো ব্রেক লাইট ছাড়া মাসট্যাং চালানোর দায়ে বিলি-দ্য-কিড কে শেরিফ আর তাঁর তিন ডেপুটি তাড়া করছে! তারপরে তাঁর সেই বিখ্যাত হাহ হাহ হা হাসি। নাহ, এগুলো কোনটাই কখনও ঘটেনি। অতএব, নো চিন্তা ডু ফুর্তি। চালাও তোমার ফোর্ড মাসট্যাং, পুলিশে ধরলেও একই গল্প শুনিয়ে দেবে, ব্যস খেল খতম! বুঝলাম সে পুরোপুরি আশ্বস্ত না হলেও মোটামুটি ভাবে তাঁর অস্থিরতা কাটিয়ে উঠেছে। পরে জেনেছি, ওই অবস্থাতেই সে লুটনে গিয়েছিল এবং কোন ঝামেলা ছাড়াই সেদিন সবকিছু শেষ হয়েছিল।
অ্যান্ডির স্পীড লিমিট ভায়োলেশানের কথা শুনে কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে সময়ে এখানকার স্থানীয় পত্রিকার প্রচ্ছদে উঠে এসেছিল এক বাঙালী ভদ্রলোকের ছবি। তিনি ব্লেচলীতে থাকেন। ভদ্রলোক আবার সে সময়ে সেখানকার “বঙ্গীয় মুসলিম” সমাজের প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি জাতীয় কোন একটা পদের অধিকারী ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার স্পীড লিমিট ভায়োলেট করেছেন। এমনকি যেসব স্থানে শিশু কিংবা বয়োঃবৃদ্ধ লোকজন চলাচল করেন সে সব এলাকাতেও তিনি কোন আইন বা দায়ীত্ববোধের ধার ধরেন নি। অথচ এসব এলাকায় রাস্তার পাশেই পর্যাপ্ত পরিমানে সতর্কতামূলক সাইনপোস্ট লাগানো থাকে।
প্রতিবার রাস্তার পাশের স্পীড ক্যামেরায় ধরা পড়ার পরে যথারীতি ওনার কাছে ছবি সমেত চিঠি পাঠানো হয়। আর তিনি প্রতিবার সেটা অস্বীকার করে জবাব লেখেন, “আমি না, ওই সময়ে আমার এক ফ্রেন্ড গাড়িটা চালাচ্ছিল”। তাছাড়া তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে বরাবর নিজেকে প্রশাসনিক হেনস্থার শিকার একজন “মাইনরিটি কম্যুনিটির” নেতা হিসাবে তুলে ধরতেন এবং বরাবর পার পেয়ে যেতেন। কিন্তু বেশ কয়েকবার একই রকমের ঘটনা ঘটতে থাকার কারনে এক পর্যায়ে ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বিস্তারিত তদন্তে তাঁর আগেকার প্রত্যেকটা মিথ্যা ধরা পরে যায়। আইন ভঙ্গ করা, দায়ীত্বহীনতা, মিথ্যা বলা এবং নিজের স্বার্থে মাইনরিটি কম্যুনিটির নাম ভাঙ্গানোর দায়ে ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিল। একই সাথে কোর্টের রায়ের পরে ভদ্রলোকের ছবি স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রচ্ছদে স্থান করে নেয়। তিনি নিজের মুখে চুন আর স্থানীয় বাঙালীদের মুখে কালি লেপন করলেন। অথচ প্রথমেই ভুল স্বীকার করে সংশোধিত হয়ে গেলে আর এত কিছুর সম্মুখিন হতে হত না।
পরের পর্বঃ প্রবাসে প্রাকৃতজন (পর্ব ০.৮: মাই নেম ইজ খান)
😀 😀
"কাউকে কখনও দেখেছ ঘোড়া-গাধার পিছে ব্রেক লাইট ব্যবহার করতে? কল্পনা করো তো, চেঙ্গিস খান ঘোড়ার পিছনে ব্রেক লাইট লাগিয়ে যুদ্ধের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, কিংবা নাসিরুদ্দিন হোজা কোন এক বেজায়গায় তাঁর গাধাকে পার্ক করে রেখেছেন আর সেটির লেজে ঝুলানো ব্রেক লাইট জ্জ্বল-জ্বল করে জ্বলে আছে?"
বরাবরের মতই ঝরঝরে কুড়মুড়ে লেখা! চলতে থাকুক প্রাকৃতজনের কাহিনী! 🙂 (সম্পাদিত)
থ্যাঙ্কস আপু, লিখে তো যাচ্ছি ঠিক ই কিন্তু সময়ের ক্রম অনুসারে পর্ব গুলো লেখা হচ্ছে না। এজন্য এখন থেকে পর্ব গুলোর নাম রিয়েল নাম্বারে রাখছি, এতে করে পর্বগুলোর ঘটনার সময়ের ক্রম রক্ষা করা সম্ভব হবে।
:hatsoff: :hatsoff:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
"তিনি নিজের মুখে চুন আর স্থানীয় বাঙালীদের মুখে কালি লেপন করলেন। অথচ প্রথমেই ভুল স্বীকার করে সংশোধিত হয়ে গেলে আর এত কিছুর সম্মুখিন হতে হত না।"
এইখানেই তো হ্যাবিচুয়াল ক্রিমিনালদের বিষেশত্ব। তারা অপরাধ করে আমুদ পাবার জন্য।
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর স্ট্যাটাসে লিখা দেখলাম "অপ্রাপ্তি থেকেই মানুষ অন্যয়/নিষিদ্ধ কাজে উৎসাহিত হয়"
আমি ওটা সংশোধন করে "কখনো কখনো অপ্রাপ্তি থেকেই মানুষ অন্যয়/নিষিদ্ধ কাজে উৎসাহিত হয়" করার প্রস্তাব করায় বন্ধুটি নাখোশ হন।
এখন এই "বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি"-র কথা শুনে বুঝতে পারছি, আমি তেমন নাখোশ হবার মত কিছু করি নাই।
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
আপনি অবশ্যই নাখোশ হবার মত কথা বলেছেন পারভেজ ভাই! উপদেশ প্রস্তাব করার আগে আপনাকে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনয়ায় নিতে হবে তো, কথায় আছে না - যস্মিন দেশে যদাচার, কাছা খুলে নদী পার ... 😛 (স্যরি, একটু ফাজলামো করলাম)
আমি এমন মানুষ ও দেখেছি যিনি যেখানে সত্যি কথা বললেও একই ফল হয় সেখানেও মিথ্যা কথা বলেন। আর আমাদের এই কম্যুনিটি লীডার ভদ্রলোক যদি প্রথম বারেই সত্যি কথা বলতেন তাহলে তাঁর ক্ষতি অনেক কম হত।
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
এক্কেরে কোপাকুপি রেসপন্স...
:duel: :duel: :duel:
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
ভালো লাগল। 🙂
নিজের মনের আনন্দে লিখালিখি করি।
থ্যাঙ্কস মামুন ভাই। 🙂 🙂
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
উপরে পারভেজ ভাই বলেছেন কিছু মানুষ আছে অপরাধ করে তৃপ্তি পাবার জন্য। আমি এইটা মানতে চাইতাম না। এখন দেখে শুনে বুঝি। কিছু মানুষের চেহারায় পর্যন্ত তৃপ্তি ফুটে উঠে যে আইন ভঙ্গ করেছে। যে জাতি বড় দাগে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় সেই জাতির random sampling ভাল হবার সম্ভাবনাও কম।
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
ঠিক! ঠিক!! ঠিক!!!
:thumbup: :thumbup: :thumbup:
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
:thumbup: :thumbup:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
“আমি না, ওই সময়ে আমার এক ফ্রেন্ড গাড়িটা চালাচ্ছিল”।
😀
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
স্পিডিং খুব খারাপ জিনিস।
হাইওয়েতে বামের বা মাঝের লেনে ৭০ মাইল স্পিডে চালালেও আমার পিছনের গাড়িওয়ালারা মাইন্ড করে। তেনারা ফুস করে ডানে যাবেন, এরপর আমাকে ক্রস করে আবার ফুস করে বায়ে আসবেন। এরপর আবার বাধ্য হয়ে আমাকে স্পিড কমাতে হয়। ছোত গাড়ি চালালে এই বিপদ। রাস্তার লোকজন পাত্তা দেয় না। আবার আমি যদি বায়ের গাড়ি গুলান ক্রস করে সাই সাই করে চলে যাই তখন ও তেনারা মাইন্ড করেন।আমার যে নিসান মাইক্রা। মাঝে মাঝে ভাবি রাস্তায় এয়ারবাস চালাবো।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
=)) =)) =))
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য