রিয়ার ভিউ মিররে পেছনের গাড়ির তীব্র হেডলাইটের প্রতিফলনে চোখ যেন ঝলসে যায়। এদেশে কি কোন আইন কানুন নাই? এভাবে হাই-বিম মেরে এরা কি রাস্তায় মানুষ খুন করতে নামসে? রাস্তা ভর্তি লাইট। আলোর কোন কমতি নাই। তারপরও এত প্রকট আলো জ্বালিয়ে কি লাভ, শুনি? রাস্তার এপারে গাড়ি অনেক আস্তে চলছে। পাঁচ লেনের প্রশস্ত হাইওয়ে। রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। মঙ্গলবার পেরিয়ে বুধবার হবে। তারপরও এত জ্যাম কেন?
সামনের গাড়ির লালবাতি দুইটা মনে হয় যেন পেছনের থাকা গাড়িটার হাই-বিম’টাকেও হার মানাবে। সব সময় নাটক সিনেমায় দেখা যায়, রাতে গাড়ি চালানো অবস্থায় ড্রাইভারের ক্লোস-আপ শটে নিচে কোথা থেকে যেন আলো আসছে। মানে, মনে হয় যেন ড্যাশবোর্ডে আলাদা লাইটিং সিস্টেম ফিক্স করা। নায়ক গাড়ি চালাচ্ছে। পাশে নায়িকা। দুজনের ঝগড়া হয়েছে, ঠিক কি নিয়ে বোঝা যাচ্ছে না। নায়কের চোখে মুখে হালকা বিরক্তির ছাপ — কিন্তু পটু হাতে স্টিয়ারিং হুইলটা বারবার ডানে বামে ঘোরাতে মোটেও ভুল হচ্ছে না। অভিজ্ঞ গাড়িচালক, তবে গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে পড়া স্পটলাইট অভিজ্ঞতা যাচাই করে না। তাই ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জার দুজনের মুখেই সমপরিমাণ আলো পড়েছে। নায়িকা বলে কথা।
আমার বেলায় ডিরেক্টর সাহেব নিশ্চিৎ লাল আলোর ব্যবস্থা করতেন। লালবাতি মনে হয় দুইটা লিখেছি। আসলে চারটা হবে। তীব্রতা অনেক বেশি: নতুন গাড়ি হবে নিশ্চয়ই। না, অবশ্যই নতুন গাড়ি – লেক্সাস এর লোগোটার নিচে নাম্বারপ্লেটের যায়গায় একটা কাগজ টেপ মেরে দেয়া। কাগজে কিছু নাম্বার টাইপ করা, কিন্তু চকচকে টেপের আড়ালে এই সেল্স ট্যাগ নাম্বার পড়ার সাধ্যি কার? এক্সিট নাম্বার ২৮ পার হলাম। কলিন্স স্ট্রিট। আর মাত্র কয়েকটা এক্সিট পড়েই আমারটা — আর্লিংটন থেকে বেড়িয়েই আমার সস্তা এপার্টমেন্ট এলাকা। সাধারণত এই পয়েন্ট থেকে বাসা পৌঁছতে ১০ কি ১২ মিনিট লাগে। আজকে মনে হয় আরো কমপক্ষে আধাঘন্টা লাগবে। বুঝতে পেরেছি জ্যাম কেন; আমার বাসার কাছেই হাইওয়েতে নতুন পিচ ঢালাই চলছে। শুভ কাজ – রাস্তার যে বেহাল দশা ছিল, এই কাজ ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু এরকম জ্যামের চাইতে ভাঙ্গা রাস্তাও মনে হয় ভাল ছিল।
আলোর তীব্রতা কমেছে মনে হয় যেন। চোখ সয়ে গেছে, নাকি I-30 হাইওয়ের এই অংশে সোডিয়াম বাতির পরিমাণ বেশি? আচ্ছা এখনও কি ঐসব লাইটপোস্টে সোডিয়াম ব্যাবহার করে? এক মিনিট — এগুলা তো সাধারণ লাইটপোস্ট না — একেকটা “পোস্ট” তো কমপক্ষে ১০ তলা উঁচু! না, বেশি বললাম — ধরেন, ৫ তলা উঁচু — তাও কম কি? আর পোস্টের মাথায় ফ্লাড লাইটের মত করে চক্রাকারে কয়েকটা লাইট বসানো। কয়টা লাইট তা বলতে পারব না: আপাতত গোণার সুযোগ নাই। একদিন সময় করে গুণতে হবে। আচ্ছা ঐটা কি – ঐযে কালো আকাশে একটা উজ্জল তবে প্রায় নিভু নিভু বিন্দু দেখা যাচ্ছে? শুকতারা নাকি? শুকতারা যেন আকাশের কোন দিকে উঠে? পূর্ব না পশ্চিম? নাকি উত্তর না দক্ষিণ? এত রাতে থাকে নাকি? আমি তো পশ্চিম দিকে যাচ্ছি এতটুক জানি। ঐযে কুপার স্ট্রীটের প্রান্তে থাকা “পিরামিড-ওয়ালা” বিল্ডিং টা দেখা যাচ্ছে। আগে আর্লিংটনে থাকা অবস্থায় এইটাই ছিল আমার indicator, যে আমার এখন এক্সিট নিতে হবে। কিসের বিল্ডিং বলতে পারব না, কিন্তু দেখতে অতি মাত্রায় জঘণ্য। নিশ্চয়ই কোন ফিনান্সিয়াল সেন্টার হবে। এদের রুচিবোধ এরকম কদর্যই থেকে যাবে আজীবন।
উফ! আর কতক্ষণ? একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভাল হতো। আমি মোটেও ধূমপান করি না। ক্যাডেট-জাতির কলঙ্ক আমি রিতীমত। সিগারেট এ নিয়মিত না, ফুটবল খেলি না, ইউরোপিয়ান লীগসমূহ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নাই — আবার ঐদিকে পড়াশোনাতেও খুব একটা সুবিধার না। অনেক কষ্টে মষ্টে এই সেকেন্ড ক্লাস ভার্সিটিতে টিকে আছি। বের করে দিতে পারে যেকোন দিন: খারাপ রেজাল্টের জন্য। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে নিজের মধ্যে কেন যেন কোন বিকার নাই। এরকম কেন হলো? এমন কি হওয়ার কথা ছিল?
একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভাল হতো। স্পটিফাইতে স্টিলারস হুইল এর “স্টাক ইন দ্য মিড্ল উইথ ইউ” বাজছে। একটা অসাধারণ ট্র্যাক। প্রথম শুনি টারান্টিনো’র মুভি রিজার্ভার ডগ্সএ। না। আসলে প্রথম শুনি মনে হয়ে ফেসবুকে কারো শেয়ার দেয়া পোস্টে — পরে আবার ঐ মুভিতে। কে শেয়ার দিয়েছিল ঠিক নিশ্চিৎ না, আমাদের নাফিস হতে পারে, আবার নিউ ইয়র্কে এক পরিচিত মেয়ে আছে, সেও হতে পারে। স্পটিফাই তে “টারান্টিনো” নামে একটা প্লে-লিস্ট খুঁজে পেয়েছি। লোকটার সিনেমাগুলো নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করিনা, তবে সিনেমার সাথে সাথে তার গান এর চয়েজ যে অসাধারণ — তা আবার বলতে! এই গান টা শুরু হওয়ার পর পরই হঠাৎ এই সিগারেটের তৃষ্ণা পাচ্ছে। বাসায় গিয়েই ধরাতে হবে। একবারে দুইটা কি তিনটা। তারপর আবার মাসখানেক অফ। ভাল ছেলে আমি।
২৬ নাম্বার এক্সিট পার হলাম — ফিল্ডার স্ট্রিটে পেছনের গাড়িটা নেমে গেছে। সামনের নতুন লেক্সাসটাও হারিয়ে গেছে কোথাও। হাইওয়ের এই অংশে সেই ৫ তলা উঁচু লাইটপোস্ট গুলাও নেই। কোন লাইটই নাই। দুপাশে ঝোপঝাড়, প্রতিদিন দিনের আলোয় দেখে অভ্যস্ত: এখন অবশ্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই ঝোপঝাড়ের পাতাগুলো হেডলাইটের তীব্র আলোও শুষে নেয় যেন। আকাশে এখন আরো কয়েকটা প্রায় নিভু নিভু বিন্দু দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার আকাশে তারা জ্বলছে। কিন্তু শহুরে আলোতে তা মিইয়ে গেছে। জীবনে একবার মাত্র খালি চোখে নিহারিকা – গ্যালাক্সি সব দেখতে পেয়েছিলাম রাতের আঁধারে। গত ডিসেম্বরে, ইউটাহ তে একটা ন্যাশনাল পার্কে। ঠান্ডায় মরে যেতাম, নাইলে রাত টা ওখানেই কাটাতাম। কাটাবো কোন একদিন। মানে, কোন এক রাত।
রাস্তার দুই পাড়ে দুইটা গ্যাস স্টেশন দেখা যাচ্ছে। একটা সেভেন-ইলেভেন, একটা শেল। সেভেন-ইলেভেনটার নিচে আবার শেভরনের লোগো দেয়া। ওরা নাকি শেভরন কে কিনে ফেলেছে না কি যেন। আমাকে এখন এক্সিট নিতে হবে — এই মাত্র “ফোর্ট ওয়ার্থ সিটি লিমিট” সাইন টা পার হলাম। বললাম না, আর্লিংটন থেকে বের হয়েই বাসা! সস্তা এপার্টমেন্ট। কিন্তু আমার রুম থেকে তারা দেখা যায়। প্রতি সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যায়। সূর্যোদয় স্পষ্ট দেখা যায়। ওপাড়ে লেক, লেকের পানির উপর সেই সূর্যের প্রতিফলন দেখা যায়।
সস্তা এপার্টমেন্টই ভাল।
B-)
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
B-)
পিনিকে ছিলে মনে হচ্চে। লিখার মাঝে সেই আবেশটা আছে। 🙂
স্টাক ইন দ্য মিডল উইথ ইউ প্রথম শোনা হয়েছে এখানের স্থানীয় রেডিও স্টেশান কিউইনা ক্লাসিক ৯৭ দশমিক ৭-এ। আমি এই চ্যানেলের এতই ভক্ত যে ওদের গানগুলো নিয়ে স্পটিফাইতে একটি প্লে লিস্টও বানিয়েছি। টারান্টিনোর গান সিলেকশান অসাধারণ। পাল্প ফিকশনের সেই নাচের দৃশ্যে চাক বেরীর 'ইউ নেভার ক্যান টেল।'
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
পিনিক বৈকি। 😀
রিজার্ভার ডগ্স এর যে সীনে গানটা ব্যবহার করছে টারান্টিনো সেটা আমার দেখা অন্যতম সেরা সিন। না, ঠিক সিনটার জন্য না — কিন্তু সিনের সাথে এই গানের "বেমানান-মানান" একটা ব্যাপার ছিল, এক কথায় অসাধারণ।
অলমোস্ট পার্ফেক্ট ''নিশীথ প্রলাপ!'' :clap: :thumbup:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
:hatsoff:
দারুন লিখেছো, মনে হলো নিজের চোখে দেখলাম সব কিছু, ভাল একটা আবেশ আছে 🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
কী মুচমুচে বাংলা তোমার! 🙂
পড়তে পড়তে মনে হলো আমিই হয়তো ফিরছি বন্ধুর বাড়ী থেকে কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে! 😛
অনেকদিন পারফেক্ট কাচ্চি বিরিয়ানী খাইনা। 🙁
পিনিক ! পিনিক ! একাকী মধ্যরাতের পিনিক। লেখা ভালো লাগছে। আমি রিলেট করতে পারছি। মাঝে মাঝেই এরকম বিক্ষিপ্ত চিন্তা মাথায় আসে...
গানটা মনে হয় আমার প্লে লিস্টেই দেখছিলি। "High" নামের ওই প্লে লিস্টে আছে.. প্লে লিস্টের নামটা নিয়ে একটা কাহিনী আছে 😛
এনিওয়ে পিনিক টিনিক জাতীয় কিছু করা যেতেই পারে সামনে। আসিতিছি আবার লোন স্টার স্টেটে।
মোকাব্বির ভাই, ইউটাহ আসতেছেন তো ? ওই জিনিস মিস দিয়েন না.. আর্চেস ন্যাশনাল পার্ক। মধ্যরাতের খালি চোখে দেখা গ্যালাক্সি ! :dreamy:
এরপর ইউটাহ তে গেলে মনুমেন্ট ভ্যালি তে ক্যাম্পিং করতে হবে। মাস্ট।
রাস্তা, লাল লাইট আর তোমার এপার্ট্মেন্ট দেখতে পাচ্ছি। অসাধারণ!
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি