ক্যাডেট কলেজে নতুন শিক্ষক যারা যোগদান করতেন তাদেরকে একটা স্বল্পমেয়াদী কোর্স করতে পাঠানো হতো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। সেখানে তাদেরকে শেখানো হতো “মেথড অফ ইন্সট্রাকশন” বা এমওআই (অনুমানে নির্ভর করে বলছি)। এর উদ্দেশ্য কিভাবে বিভিন্ন ট্রেনিং এইডের সাহায্যে ক্লাস নিতে হয়, কিভাবে ছাত্রদেরকে শতভাগ ইনপুট দেয়া যায় সেটা শেখানো । আমরা কলেজে থাকতে থাকতেই ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই কোর্স করে স্যারদের কতখানি উত্তরণ ঘটত তার মূল্যায়ন করার যোগ্যতা আমার ছিল না। তবে খেয়াল করেছিলাম যে বেশ বড় সংখ্যক নতুন শিক্ষক যারা চাকুরী ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতেন তারা এই কোর্সটা করে তবেই বিদায় নিতেন। সেখান থেকে ধারণা হয়েছিল এটা নিশ্চয়ই ভালো ফলদায়ক কোন কোর্স।
এমওআই এর সাথে ভালোভাবে আমার পরিচয় ঘটে বিএমএ’র শেষ টার্মে। সেখানে আমাদের থিওরি ও ব্যবহারিক ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়, অভ্যস্ত করে তোলা হয়। অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আপাত নিরীহ বিষয় যে কত বড় ইফেক্ট ফেলতে পারে সে সম্পর্কে তখনই জানতে পারি। একটা নির্দিষ্ট বিষয় পড়ানোর জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, পুরো ক্লাসের ৪০/৬০ মিনিট সময় কিভাবে প্ল্যান করতে হবে, বিষয় বস্তুর কতটা কভার করতে হবে, ক্লাসে ছাত্রের উপস্থিতি ও অবস্থানের উপর ভিত্তি করে গলার স্বর কতটুকু হবে বা কিভাবে গলার স্বরে ভ্যারিয়েশন এনে মনোটনি কাটাতে হবে, কিভাবে ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখতে হবে, কিভাবে আই কন্ট্যাক্ট করে কথা বলতে হবে, কিভাবে ছাত্রদের ক্লাস পার্টিসিপেশন করাতে হবে, ব্ল্যাক বা হোয়াইট বোর্ডে লিখার সাইজ কতটুকু হলে সবচেয়ে পিছনে বসা ছাত্রের জন্যও পড়তে কোন অসুবিধা হবে না, হাত পা শরীরের মুভমেন্ট কেমন হবে, বিভিন্ন ট্রেনিং এইডের সঠিক ব্যবহার কি হবে – সবই চলে আসে এই এমওআই এর ভিতরে।
ধাপে ধাপে বাস্তব উদাহরণসহ আমাদের হাতে কলমে শেখানো হয়েছিল এমওআই। হাজার শব্দের চাইতে একটা ছবি যেমন অনেক বেশি ভাব প্রকাশ করতে পারে তেমনি হাজার কথার চাইতে একটা উপযুক্ত ট্রেনিং এইড অনেক বেশি করে বোঝাতে সক্ষম হয়। একারণেই আমাদের ট্রেনিং এইড ব্যবহারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হত। তখনও কম্পিউটার বা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের প্রচলন বহুলভাবে শুরু হয়নি বলে আমরা প্রধানত ব্যবহার করতাম ওভার হেড প্রজেক্টর (ওএইচপি)। রাত জেগে নিজহাতে ভিউ ফয়েল তৈরী করে তাতে ছবি এঁকে, প্রধান প্রধান পয়েন্ট তুলে দিয়ে ক্লাস নেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতাম।
বিএমএ’র সাধারণ রুটিনের ধাক্কায় ক্লাসে ঘুমানো আমাদের জন্য একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। আর প্লাটুন কমান্ডার থেকে শুরু করে যেই স্যারই ক্লাস নিতেন খানিক পরপর আমাদের ঘুমানো নিয়ে মৌখিক সতর্কীকরণসহ ভালোরকম পালিশ দিতেন। প্রায়ই দেখা যেত ক্লাস বাদ দিয়ে পুরো বা আংশিক ক্লাস পিটি/প্যারেড/ব্যায়াম (ফ্রন্টরোল তার মধ্যে অন্যতম) করছে। এমওআই এর অংশ হিসেবে যখন ক্লাস নিতে দাঁড়াতাম তখন আমরাও স্যারদের মতোন এই ঘুম ভাঙ্গানো প্রাকটিস করতাম। বিশেষ করে মৌখিক সতর্কীকরণটা বেশি চলত।
আমাদের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আবার এই ব্যাপারে একটু বেশি মনোযোগী। যেই আমাদের কেউ একজন ক্লাস নিতে নিতে বলে উঠত, “জেন্টলমেন ডু নট স্লিপ” তখনই প্লাটুন কমান্ডার রাডার ঘুরিয়ে দুই চারজনকে ঘুমন্ত অবস্থায় পাকড়াও করতেন আর বাইরে পাঠিয়ে দিতেন ফ্রন্টরোল দিতে। আমাদের প্রত্যেককেই একে একে অনুন্য ২০ মিনিট করে ক্লাস নিতে হোত। বিষয়বস্তু সবারই পূর্ব পরিচিত বলে ঘুমটা বেশ জেঁকেই বসতে চাইত। কয়েক দফা ফ্রন্টরোলের ঘটনা ঘটার পর মনে মনে নিজেকে সতর্ক করে দিলাম – আমার বেলায় এমনভাবে কাউকে ঘুমের ব্যাপারে বলব না যাতে প্লাটুন কমান্ডার কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হয়ে ফ্রন্টরোল দিতে হয়।
আমার বিষয় ছিল “তিন বাহিনীর ইকুইভ্যালেন্ট র্যাংক ও গ্যালান্ট্রি এ্যাওয়ার্ডস”। মেঘে মেঘে বেলা বেড়ে আমার লেকচার দেবার সময় হয়ে এল। নিজেকে পাখিপড়া করে এসেছি – ঘুমের ব্যাপারে এমনভাবে বলব না যাতে কাউকে পাঙ্গা খেতে হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বোধ করি মুচকি হেসেছিলেন। সূচনা বক্তব্য শেষ হতেই প্ল্যানমাফিক ওএইচপি’তে প্রথম ভিউ ফয়েলে আর্মির কোন একটা সিনিয়র র্যাংক দেখানো হল। জিজ্ঞেস করলাম,”ওয়েল জেন্টলমেন, হু অল ক্যান সে হোয়াট দিস র্যাংক ইজ? প্লিজ রাইজ হ্যান্ড”। জনা ত্রিশের মধ্যে সতেরটা হাত উঠল। সেটা গুনে বললাম,”আই এ্যাফ্রেড ইফ দ্যা আর্মি চিফ এনটারস দিস রুম জাস্ট নাউ ইউ উইল নট বি এবল টু রেসপন্ড প্রপারলি। জেন্টলমেন, দিস ইজ দ্যা র্যাংক অফ….”। কথা শেষ না করেই থেমে যেতে বাধ্য হলাম প্লাটুন কমান্ডারের ইশারায়। এবার উনি ঘোষনা করে বসলেন ‘যারা যারা জান না তারা বাইরে যেয়ে পনেরটা করে ফ্রন্টরোল দিয়ে এস’!!
আমি হতভম্ব, বিস্মিত, ভ্যাবলাকান্ত হয়ে রসট্রামে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার এমওআই শিক্ষা বিএমএ অধ্যায় এভাবেই শেষ হয়েছিল।
হাহাহাহা, দোস্ত তোর অভিজ্ঞতাটা মজা লাগলো। অনেক সময় আগেভাগে প্রস্তুত হয়ে যেয়েও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানো যায়না, ঠিকনা? এই এমওআই কোর্সকি নিজের টার্মের পোলাপাইনেরই নিতে হতো নাকি জুনিয়রদের? কলেজে থাকাকালীন সময়ে একবার চিটাগাং সি এম এইচ এ জিসিদের একাডেমিক কিছু সাবজেক্ট-এর সাথে পরোচয় হয়েছিলো [ট্যাক্টিক্স সহ আরো কি কি যেন] সাদা সাদা ছোট টেক্সট বইগুলো আর এর বিযয়বস্তু বেশ মজাই লেগেছিলো।
আর ক্যাডেট কলেজের নতুন শিক্ষকদের যে এমওআই এর কথা বললি সেটাও কিছু কিছু মনে আছে। ক্যাডেট কলেজে ঢোকার আগে সরকারি স্কুলগুলোতে বি এড এর শিক্ষকদের এরকম কোর্সগুলোর কথা মনে পড়লো। তবে ক্যাডেট কলেজের নতুন শিক্ষকদের একাডেমিক শিক্ষকতার দক্ষতার পাশাপাশি আরো অনেকরকম টেস্ট দিতে হতো। ডাইনিং হল ম্যানার্স, ক্যাডেট সামলানো ( :grr: ) ডিউটি মাস্টারের কাজকর্ম এসব। তবে আমাদের সাথে তাদের বেশ ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। তখন আমাদের একটা ট্যালেন্ট শোতে নতুন শিক্ষকদের বেশ আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে যুক্ত হওয়াটা এখনও বেশ মনে আছে। বাংলার একজন শিক্ষক ছিলেন, অনাথবন্ধু মল্লিক স্যার। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার এবং সুরকারও ছিলেন। তিনিতো ইনস্ট্যান্ট দুইটা গান লিখে সুর পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন আমাদের প্রোগ্রামটার জন্য। যাই হোক, প্রায় পনের বছর আগের স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দিলিরে। :shy:
অনাথ বন্ধু মল্লিক স্যার একজন অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্নদাশঙ্কর রায়ের উপর ডক্টরেট করা এই মানুষটি(বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজে তথা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের যে কোন প্রতিষ্ঠানে কতজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী ক্লাস নেন সে তথ্য এ মুহূর্তে আমার কাছে নেই-তবে আমার ধারণা সংখ্যাটি খুব বেশি হবেনা)আমার অন্যতম প্রিয় একজন মানুষ।এরকম আত্মভোলা,প্রতিভাবান মানুষটির সাথে কুটিল মানুষদের শঠতা দেখে মাঝে মাঝে মনে হত-ক্যাডেট কলেজ সিস্টেম আসলে আর এত ভাল শিক্ষক পাওয়ার যোগ্যতা রাখেনা।শুধু গান নয়, তিনি আন্তঃহাউস নাটক প্রতিযোগিতায় নিজের লেখা নাটক দিয়ে ক্যাডেটদের অভিনয় করাতেন,মাইকেল মধুসূদনের কবিতার সূর করে স্টেজ পারফর্ম করতেন।মুক্তার মত ছিল তাঁর হাতের লেখা-কথায় কথায় স্বরচিত কবিতা লিখে দিতেন যে ক্যাডেটই চাইতনা কেন।আমার ডায়েরীতে উঁনার লেখা দু-লাইন আজও মুক্তার মত জ্বলজ্বল করে,যেটাতে তিনি আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।
কাইয়ুম ভাই,অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যারের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য।কানে বেজে উঠছে ক্লাস সেভেনের প্রথম দিনে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে গাওয়া তাঁর স্বরচিত গানের কলিগুলো।
সন্দীপক মল্লিক(উনার লেখক-ছদ্মনাম) স্যারকে স্যালুট।
আমাদের কলেজে একজন ছিলেন- জয়েনুদ্দীন স্যার। মুনীর চৌধুরীর নাটকের উপরে পিএইচডি করেছিলেন তিনি।
www.tareqnurulhasan.com
বাংলার জয়েনুদ্দীন স্যার, হাসিনা ম্যাডামের হাজবেন্ড?
আমি তো জানি উনি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ উপর করেছিলেন। ছয় বছর ছিলাম ওনার সংগে, ড্রামা সোসাইটিতে।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
হ ভাই। এখনো মনে পড়ে,
রাস্তা ফাঁকা, যাচ্ছি ঢাকা...
ড্রামা ভয়েজ থোয়িং এ স্যারে কিছু প্রিয় কোট ছিল যেমন "যদু হে............।। মাছ কিবা।" যদু যতদুরে থাকবে, হে......।।টান তত বড় হবে।
আরেকটা মনে পড়ে "আকাশের উপড়ে আকাশ"।
তো একদিন সোসাইটি টাইমের পরে হাউসে পোলাপাইন বেশ পচাইলো। সোসাইটি টাইমে আমরা নাকি হে.........।। হে............ করে গান গাই।
স্যার আমাকে খুব আদর করতেন, এখন যে কই?
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফৌজদারহাটে স্যাররা ঠিক কি কোর্স করতেন এই ব্যাপারে আমার খানিকটা সন্দেহ ছিল। এইবার সেটা দূর হল। ভাবতে অবাক লাগছে এমওআই ছাড়াও তাদের ডাইনিং হল ম্যানার্স, ক্যাডেট সামলানো, ডিউটি মাস্টারের কাজকর্ম এসবও শেখানো হত। আমি জানি না এখন এই ব্যাপারটা কিভাবে স্যাররা আয়ত্ব করেন।
ট্রেইনি স্যারদের সাথে ক্যাডেটদের সখ্যতার ব্যাপারটা খুব ভালো লাগল :clap: ।
বিএমএ'তে নিজের কোর্স ছাড়া অন্য কোন কোর্সের সাথে ট্রেনিং ও লেখাপড়ার ব্যাপারে কো-ইনসাইড করে লাখে একটা 😛 ।
অনাথ বন্ধু মল্লিক স্যারের সম্পর্কে যতটুকু জানলাম তাতে খুব আফসোস হচ্ছে এই ভেবে যে তার সাথে এখনও পরিচয় হবার সুযোগ হয়নি। স্যারকে :salute: ।
Life is Mad.
সায়েদ ভাই মজা পাইলাম 😀 😀 😀
সন্দীপক মল্লিক(উনার লেখক-ছদ্মনাম) স্যারকে :salute:
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
মল্লিক স্যারকে সরাসরি পাইলে স্যালুট মারতি না খালি হাসতি। আর মাশরুফ ভাই মল্লিক স্যার ডক্টরেট করেন নাই এমফিল করলিসেন।"আত্মভোলা,প্রতিভাবান মানুষটির সাথে কুটিল মানুষদের শঠতা " এই ব্যাপারটা সত্যি। তবে স্যার এমন একজন মানুষ যার প্রতি শ্রদ্ধা জাগে হৃদয়ের গভীর থেকে।
স্যারদের ট্রেনিং ছিল নাকি?
এখন তো মনে হচ্ছে অধিকাংশ স্যার ট্রেনিং ঠিক মত করত না, ফাকি মারত।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
:khekz: :khekz: :khekz:
ফয়েজ ভাই
জবাব নাই
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥
:khekz: :khekz: :khekz:
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
:goragori: :goragori: :goragori: :khekz: :khekz: :khekz:
ক্যাডেট কলেজ আর বিএমএ ... দুইটার ব্লেন্ডিংটা ভাল হইসে।
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥
🙂 😛 🙂 থ্যাংকু :shy:
Life is Mad.
তাইফুর ভাই, সুন্দর পর্যবেক্ষণ। 🙂
:shy:
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥
মজা 😀 :))
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
সায়েদ ভাই, স্মৃতিচারণ ভালো লাগছে।
থ্যাংকস ব্রাদার 🙂 ।
Life is Mad.
আরো চাই আরো চাই