২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসির দন্ডাদেশ পাওয়া আব্দুস সালাম পিন্টু আমাদের টাঙ্গাইলের মানুষ। উনার পরিবারের সাথে একটা ফানি পারিবারিক সম্পর্ক হয়েছিলো আমাদের। সর্বশেষ যে বাসায় আমরা ভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলাম সেই বাসায় আমাদের ঠিক আগেই ভাড়া থাকতেন উনারা। তো সেই জেনারেল এরশাদের সময়ে মোবাইল তো দূরে থাকুক ফোনেরও এত বিস্তৃতি ছিলোনা। ফলে রাজনীতিক পিন্টু”ভাই” যে বাসা বদলে ফেলেছেন তা তার দলের অনেকেই জানতে পারেননি। ফলে উনার সাথে দেখা করতে অনেক মানুষকে আসতে দেখেছি বাসায়। বাইরে থেকে “পিন্টু ভাই, পিন্টু ভাই আছেন” জাতীয় প্রশ্নের উত্তর প্রথম প্রথম আম্মা, বাসায় থাকলে আব্বা, আর শুনে শুনে পরে আমি দেয়া শিখেছিলাম। আমার ছোট ভাই সৌরভ তখনো হয়নি। একই প্রশ্নের একই উত্তর প্রতিদিন বারকয়েক দিতে দিতে আম্মা-আব্বা বিরক্ত হলেও আমি বেশ মজা পেতাম, দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে বলে আসতাম যে উনারা এখন আর এই বাসায় থাকেন না।
একদিন সেই পিন্টু “ভাই”য়ের মা এবং স্ত্রী আমাদের বাসায় আসলেন। উনার পরহেজগার মা মহিলাদের নিয়ে তার বাসায় তবলীগ করতেন। আম্মা দুয়েকবার হয়তো গিয়েওছিলেন উনাদের বাসার সেই জমায়েতে। আর শিক্ষয়িত্রী স্ত্রীও অনেক গল্পটল্প করতেন বলে শুনেছি।
সেই পিন্টু ভাই ১৯৯১ এর নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেন এক উপজেলা কেন্দ্র থেকে। আওয়ামী লীগকে তব্দা করে আর গোটা দেশকে চমকে দিয়ে বিএনপির জয়ী হয়ে যাওয়া সেই নির্বাচনে এমপি হয়ে গেলেন উনিও। ১৯৯৪ এ আমি ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলাম, বাসাও ছেড়ে দিলাম সেবছরই আমরা তাই আর হয়তো দূর থেকে অন্যসবার মতোই খবর জানা বা পাওয়ার বাইরে যোগাযোগটা আর থাকেনি।
১৯৯৬-এ হারলেও ২০০১-এ এমপি হয়ে হলেন উপমন্ত্রী, তাও আবার শিক্ষা আর পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের।
সেবার বিএনপি শুরুতেই ৬০ সদস্যের “বিরাট” মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে। এতে বড় নেতাদের সাথে প্রতি/উপমন্ত্রী মর্যাদায় জাতীয় পর্যায়ে অপরিচিত অথচ স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় অপেক্ষাকৃত তরুণদের উঠিয়ে আনা হয়। আমি তখন কুয়েটের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাউস মন্ত্রীসভা প্রথম থেকেই মিডিয়ার সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হলেও আমার কাছে পদক্ষেপটা ভালোই মনে হয়েছিলো, শুধুমাত্র চিহ্নিত দুই যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী করা ছাড়া। আমি জানিনা হাওয়া ভবন দিয়ে সমান্তরালে “আসল” সরকার না চালিয়ে আর স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের উপরে নির্ভরশীল না হয়ে তারেক রহমান যদি নিজেকে আর সংগঠনকে গড়ে তোলার প্রয়াস নিতেন তাহলে দেশের অবস্থা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো।
২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলায় দল হিসেবে বিএনপিকে দায়ী করা হয়নি বিচারে, তার কারণও নেই। যে কোন ঘটনা ঘটার জন্য অথবা তা প্রতিহত করতে ব্যর্থতার জন্য সেই সরকারকেই দায় নিতে হবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনার পরের পদক্ষেপগুলোই আসলে সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়। সেইসাথে ক্রমশ শেখ হাসিনার প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ বৃদ্ধি, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা আর অবদান নিয়ে অন্যায্য, বালখিল্যভাবে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা ইত্যাদির পাশাপাশি হাওয়া ভবন নিয়ে গড়ে ওঠা দুর্নীতির প্রশ্নে ব্যক্তি তারেক রহমানের ইমেজ ক্ষুণ্ণ আর দায় বাড়তে থাকে। দেশব্যাপী জঙ্গি উত্থানে দৃশ্যমান নিস্ক্রিয়তা, অস্ত্রের চালান ধরা পড়া আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কারসাজির চেষ্টায় গোটা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মেয়াদের শেষে এসে শায়খ আব্দুর রহমান আর বাংলাভাই গ্রেপ্তার হলেও তাদের নেটওয়ার্ক নিয়ে নিস্ক্রিয়তা বা সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা প্রকাশ্যই থেকে যায়।
তরুণ নেতৃত্বের যে আশাবাদ দেখানো হয়েছিলো তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়, দুই দলের বৈরিতা রূপ পায় পুরোপুরি বিদ্বেষের। আর এই গ্রেনেড হামলার রায়ের সাজাপ্রাপ্তদের নামের তালিকার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় জাগে, এও সম্ভব!
একদম তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা একজন পিন্টু”ভাই”য়ের এই পরিনতি ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাওয়া রাজনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে মুদ্রার একপিঠ দেখা গেলো। জানিনা কোনদিন আরেক সরকার এলে এর বিপরীত কি চিত্র দেখতে হবে আমাদের। হয়তো আরো অনেক “পিন্টুভাই”কে জানবো আমরা এই অভাগা দেশের সাধারন মানুষগুলো। আফসোস আইনের শাসনের যে কথা আমরা বলে থাকি তা হয়তো তখনও অধরাই থেকে যাবে বাংলাদেশের মাটিতে…
মন্তব্য করুন