প্রসঙ্গ টিপাইমুখ বাঁধ: আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের অবস্থাণ এবং সাধারণ মানুষের কর্তব্য……

বিপদটা হলো আমরা সোচ্চার হলাম অনেক দেরীতে……..

ঘটনা ঘটার পরে কথা-বার্তা শুরু করে তো সত্যিকারের কোন লাভ নাই…….ইতিমধ্যে এই বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে (ভিত্তিপ্রস্তর করে ফেলেছে মনমোহন সিং)…….আমাদের কর্মকর্তাদের সেখানে গিয়ে চা খেয়ে আসার দাওয়াত-ও দিয়েছে ভারত!!!!

আমাদের কি মনে আছে International Tipaimukh Dam Conference 2005 Dhaka Bangladesh নামে একটা সম্মেলন হয়েছিল ২০০৫-এর ৩০-৩১ ডিসেম্বরে??? এবং যাতে দাওয়াত পেয়েও মেজর হাফিজ যোগ দেননি……..আবার মাল মুহিত, রাজ্জাক এনারা গিয়েছিলেন……যারা এখন কি বলতে কি বলছেন তারই কোন ঠিক নেই…….

তখন কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে তেমন কোন আলোচনাই হয়নি…….সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে কেন……..এইখানেই লুকিয়ে আসল মজাটা……..এটা বুঝতে না পারলে শত্রু-মিত্র নিয়ে জুজুর খেলাই চলতে থাকবে দেশজুড়ে……..

রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের দেশে যেমন ২টি ধারা…….প্রো-আওয়ামী আর এ্যান্টি-আওয়ামী, তেমনি মিডিয়াতেও……এখন অবশ্য ছদ্ম নিরপেক্ষ কিছু পত্রিকা আছে যারা আওয়ামী লীগের প্রতি দুর্বল…….

আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত সর্বদাই ফ্যাক্টর……এবং সব দলই ক্ষমতায় থাকলে ভারতের স্বার্থপন্থী হয়…..আ’লীগের সাথে ভারত অবশ্যই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কিন্তু ক্ষমতাসীন বি.এন.পি.-ও ভারতের স্বার্থরক্ষায় সর্বদা তৎপরই থাকে………

মনে রাখতে হবে বি.এন.পি.-র বিরোধী রাজনীতির স্ট্র্যাটেজিটাই হলো ভারত বিরোধীতা…….আ’লীগের তা নয়…….একারণে ‘সুবিধাভোগী’ বি.এন.পি.-র আমলে টিপাইমুখ নিয়ে তেমন সিরিয়াস আলোচনা হতোনা…….কারণ আওয়ামীপন্থী মিডিয়াতো চুপই থাকবে আর বি.এন.পি.-পন্থী মিডিয়াও তখন এইসব বিষয়কে তেমন গুরুত্ত্ব দেয়না……..ভারত কিন্তু তার কাজ সবসময় ঠিকঠাক এগিয়ে নিচ্ছে…….

ফারাক্কার ব্যাপারটা দেখুন: ১৯৬৪-তে পাকের জান-পরাণের দোস্ত (?) আমেরিকার আরেক শয়তান বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই কাজ শুরু করে ভারত…….অথচ পাকিরা এটাকে কতটা headace হিসেবে নিয়েছিল আল্লাহ জানেন……..কিন্তু ৭৪-এই বাঁধ চালু (পারীক্ষামূলক বলে পুরোদমে) হলে তার পুরো দায় একতরফা মুজিব সরকারকে চাপিয়েছি আমরা…….

তেমনি টিপাইমুখ নিয়ে কথা উঠে বাজপেয়ী সরকারের শেষ সময়ে……আমাদের উচিত ছিল তখনই ব্যাপারটা নিয়ে ভারতের সাথে দ্বি-পাক্ষিক সভায় বসা, পাশাপাশি technically তা বিশ্বসভায় তুলে ধরা…….হৈ চৈ-টা শুরু করা……….

যাই হোক, সাধারণ মানুষ যে এখন কথা বলছে, তা দেরীতে হলেও মন্দের ভালো…….আমাদের উপর ভারতের দাদাগিরির জন্য দায়ী আমাদের ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা…….একক কোন দল নয়……..

আমাদের আজ কোন নেতা নেই…….প্রচন্ডভাবে বিভক্ত জনতার কাতারে বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ করে আমরা মানসিক শান্তি হয়তো পেতে পারি…….কিন্তু ভারতের মতো রাষ্ট্রের সন্ত্রাস প্রতিহত করা তাতে সম্ভব কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়……..কাশ্মীরের চেনাব নদীর বাঁধ নিয়ে যেমন পারমানবিক শক্তিধর পাকিস্তান বলার মতো কিছু করতে পারেনাই…….

আর এই প্রতিবাদে আমাদের আজকের গলাবাজ তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের থেকেও সাবধান হওয়া উচিত……..

১,৪২৭ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “প্রসঙ্গ টিপাইমুখ বাঁধ: আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের অবস্থাণ এবং সাধারণ মানুষের কর্তব্য……”

  1. হাসান (১৯৯২-৯৮)

    ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, আমাদের উন্নতির জন্য ভারতের অবদান অপরিসীম , এই সব চার দলীয় জোটের অপ প্রচার !!!!!!!..... =)) =)) :)) =)) :)) =)) :)) =)) :))

    আমাদের উচিত হবে লেন্ধুপ দর্জি এর মত একজন সুয্যোগ্য, দেশপ্রেমিক, গণতনমনা একজন নেতার অপেক্কায় থাকা ............

    জবাব দিন
  2. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প : প্রচারণা বনাম বাস্তবতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

    একজন পশ্চিমা বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, বিশ্বে ভবিষ্যতে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তা তেল নিয়ে হবে না, হবে পানি নিয়ে। এই কথাটি যখন বলা হয়, তখন তেলের লোভে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকায় বুশ প্রশাসন ‘‘নারীঘাতী শিশুঘাতী বর্বরতায়” লিপ্ত। তবু যুদ্ধটি সারাবিশ্বে সম্প্রসারিত হয়নি। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, পানি নিয়ে যুদ্ধটি সারাবিশ্বে সম্প্রসারিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের এই অভিমত কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না, আমরাও দিতে পারি না। মধ্যপ্রাচ্যে সাতিল আরবের পানি নিয়ে বিরোধ, আমাদের উপমহাদেশে সিন্ধু নদের পানি বন্টনের (Indus water dispute) বিরোধ, গঙ্গার পানি বন্টনের বিরোধ, সাম্প্রতিক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক।।এসবই ভবিষ্যতে পানি নিয়ে মহাবিরোধ বাধার আলামত কি না জানি না।

    উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব দুই এলাকাতে পানি বন্টনের সমস্যা ও বিরোধের উদ্ভবের মূল কারণ, ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারতকে বিভক্ত করার সময় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ছুরিতে দেশটিকে কৃত্রিমভাবে ভাগ করা এবং পরবর্তীকালে দেশি শাসকচক্র কর্তৃক সমস্যাটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ক্রমাগত ব্যবহার করার প্রবণতা। সমস্যার সমাধান তাদের কাম্য নয়, বরং সমস্যাটিকে জিইয়ে রেখে তার রাজনৈতিক ফায়দা লোটাই একশ্রেণীর রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক শাসক এবং রাজনৈতিক দলের কাম্য মনে হয়েছে এবং এখনো মনে হচ্ছে। তাতে দেশের বা দেশের মানুষের কী চরম ক্ষতি হচ্ছে সেদিকে তাদের আদৌ নজর নেই। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের শাসকশ্রেণীর একাংশের মধ্যে অভিন্ন মনোভাব বিরাজমান।

    ইংরেজ রেডক্লিফ সাহেব ভারত ভাগ করার ছুরিটা হাতে পেয়ে এমনভাবে সেটি ভাগ করেছিলেন, তাতে শুধু নদীর পানি নয়, কৃষি শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভক্ত অঞ্চলগুলো এমনভাবে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল থাকে, যাতে এই ভাগাভাগি নিয়ে তারা বহুকাল বিবাদে লিপ্ত থাকতে বাধ্য হয়। এর ফলে পশ্চিমে সিন্দু নদের পানি এবং পূর্বে গঙ্গা নদীর পানির হিস্যা ও ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যা ও বিরোধের সূত্রপাত।

    সিন্দু নদের পানি বন্টনের সমস্যা সমাধানে বেশি বিলম্ব হয়নি। একাত্তর-পূর্ব পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকেরা জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক ছিলেন। তারা সিন্দু নদের পানি সমস্যাটি ভারত-বিদ্বেষী মনোভাব দ্বারা চালিত হয়ে রাজনীতিকীকরণের দিকে আগাননি, বরং একটি জাতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখেছেন এবং রাজনীতির বাইরে সমস্যাটিকে রেখে, কোনো জেহাদি হুঙ্কার না ছেড়ে আলাপ-আলোচনার টেবিলে বসে ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি করেছেন। এই চুক্তি সম্পাদনে বিশ্বব্যাঙ্কসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাহায্য ও সমর্থনও তারা পেয়েছেন। এই চুক্তির নাম সিন্ধু অববাহিকা (Indus basin treaty) চুক্তি।

    এই চুক্তি সম্পাদনের সময়েই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে দাবি উঠেছিল, পূর্বাঞ্চলের গঙ্গার পানি বন্টনের সমস্যা ও বিরোধটিও আন্তর্জাতিক সালিশি ও বিশ্বব্যাঙ্কের সহায়তায় পশ্চিম অংশে যে চুক্তি করার আলোচনা হচ্ছে তার অন্তভুর্ক্ত করা হোক এবং অনুরূপ গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি করা হোক। সম্ভবত: এই ধরনের আলাপ-আলোচনায় ভারত রাজি ছিলো। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাতে আগ্রহ দেখাননি। পূর্ব পাকিস্তানের গঙ্গা নদীর পানি বন্টনের সমস্যাটিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তারা সিন্ধু নদের পানি বন্টনের সমস্যাটিকেই অগ্রাধিকার দিয়ে আলোচনায় বসে চুক্তি করার আগ্রহ দেখান। পূর্ব পাকিস্তানের জীবনমরণের সমস্যাটিকে সেদিন এভাবে উপেক্ষা করার কারণ অনেকেই বুঝতে পারেননি।

    কারণটি জানতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তখন বেঁচে আছেন এবং ‘ইত্তেফাকে’ তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ নামের কলামটি নিয়মিত লেখা হচ্ছে। এ সময় একবার তিনি পাকিস্তানের সংবাদপত্র সম্পাদকদের এক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য করাচীতে গিয়েছিলেন। উঠেছিলেন ক্লিফটন বীচের কাছে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কন্যা বেগম আখতার সোলায়মানের বাসভবন লাখাম হাউসে।

    আমিও সেবার তার সঙ্গে ছিলাম। করাচীর জনপ্রিয় সান্ধ্য দৈনিক ‘লীডারের’ সম্পাদক আবদুল মজিদ ছিলেন মানিক মিয়ার ব্যক্তিগত বন্ধু। একদিন লীডার সম্পাদককে ইত্তেফাক সম্পাদক লাখাম হাউসে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালেন। খাওয়া-দাওয়ার পর বেগম আখতার সোলায়মান এবং তার মেয়ে মুন্নির (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের আইন মন্ত্রী হয়েছিলেন) উপস্থিতিতেই দুই বন্ধু রাজনৈতিক আলোচনা শুরু করেছিলেন। মানিক ভাই বলেছিলেন, আমি বুঝতে পারছি না ইন্ডাস বেসিনের পানি নিয়ে আলোচনার সময় কেন গঙ্গার পানি বন্টনের সমস্যাটি তার অন্তর্ভুক্ত করা হলো না? দু’দেশের মধ্যে একই সমস্যা নিয়ে একই আলোচনা সভায় বসে একই ধরনের চুক্তি হওয়া তো উচিত ছিলো।

    মানিক মিয়ার বক্তব্য শুনে আবদুল মজিদ মৃদু মৃদু হাসছিলেন। মানিক মিয়া বললেন, আপনি হাসছেন যে বড়? আবদুল মজিদ হাসি থামিয়ে বললেন, মানিক মিয়া, আপনার ক্ষুরধার লেখনির সুনাম আছে। আপনি কেন পাকিস্তানের অবাঙ্গালি শাসকদের এই সামান্য চালাকিটা ধরতে পারছেন না?

    মানিক মিয়া বললেন, চালাকিটা কি? আব্দুল মজিদ বললেন, প্রথম কথা, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাঙালিদের সমস্যাকে পাকিস্তানের শাসকেরা দেশের কোনো সমস্যা বলেই মনে করে না। দ্বিতীয় কথা, সিন্ধুর পানি বন্টন তাদের নিজেদের স্বার্থেই প্রয়োজন। সুতরাং এখানে ভারত-বিদ্বেষ প্রচারকে প্রশ্রয় না দিয়ে বাস্তবতাবোধ থেকে দিল্লির সঙ্গে আপস করেছে। কিন্তু গঙ্গার পানি বিরোধকে জিইয়ে রাখাকেই তারা লাভজনক ভাবে। তারা মনে করে এই বিরোধ জিইয়ে রেখে ভারতের কাঁধে সব দোষ চাপিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের ভারত-বিদ্বেষী করে রাখা যাবে এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে।

    মানিক মিয়া বলেছেন, আপনি পশ্চিম পাকিস্তানের একজন প্রগতিশীল ও মুক্ত মনের সাংবাদিক। তাই পানি সমস্যা সম্পর্কিত এই সত্যটা বুঝতে পেরেছেন এবং স্বীকারও করছেন। কিন্তু আলতাফ হোসেন, জেড-এ-সুলেরির মতো বড় বড় সম্পাদকেরা তো এসব কথা স্বীকার করছেন না এবং তা নিয়ে লিখছেন না। আমরা কেন্দ্রীয় রাজধানী থেকে দেড় হাজার মাইল দূরে বসে কাকে কি বোঝাবো? আব্দুল মজিদ বলেছেন, “তবু আপনি লিখুন মানিক ভাই, আপনার লেখনি আরব সাগরের এপারে এসেও ঢেউ তোলে।’

    ঢাকায় ফিরে মানিক মিয়া পরপর একটি নয়, তিনটি কলাম লিখেছিলেন ইন্ডাস বেসিন চুক্তি নিয়ে। গঙ্গার পানি বন্টন সমস্যা নিয়ে ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কি ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হতে পারে তা জেনেও সমস্যাটি রাজনৈতিক স্বার্থে জিইয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানি শাসকদের কৌশলকে তিনি তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন। এমনকি ১৯৫৫ সাল থেকে পৌনঃপুনিক ভয়াবহ বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের যে চরম ক্ষয়ক্ষতি হয় তার প্রতিকারের জন্য ভারতের সঙ্গে (কারণ, পূর্ব ভারতও এই বন্যার ছোবলে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়) যৌথভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দাবি তুলেছিলেন। লিখেছিলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি বন্টনের সমস্যা দু’টিকে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে রাখা উচিত। ক্রুগ মিশনের সুপারিশের বাস্তবায়নের দাবিও দৈনিক ইত্তেফাকে বার বার তোলা হয়েছে।

    এসব দাবির কোনোটাতেই পাকিস্তান সরকার কর্ণপাত করেননি। ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক বিবাদ থাকুক, কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দু’দেশের পারস্পরিক স্বার্থে মিটিয়ে ফেলা হোক এ ধরনের কোনো প্রস্তাবে পাকিস্তান সরকার সায় দেয়নি। বরং নানা অজুহাতে তা বাতিল করেছে। এসব দাবি যারা তুলেছেন তাদের ‘ভারতের চর’, ‘ভারতের দালাল’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী। তিনি সদ্যবিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে যে অর্থনৈতিক পরস্পর-নির্ভরতা রয়েছে, তার স্বার্থে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানকে কিছুটা অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার দানের প্রস্তাব করেছিলেন। ফলে তাকে শুধু পদত্যাগে বাধ্য করা হয়নি, সত্য-মিথ্যা দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে তার রাজনৈতিক জীবন খতম করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

    পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে যখন ভারত গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে, তখনও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক সালিশী সংস্থার কাছে যায়নি। কেবল পূর্ব পাকিস্তানে ভারত-বিরোধী প্রচারণা জোরদার করেছে। এ সময়ের একটা মজার ঘটনা বলি। ভারত নির্মাণ করছে ফারাক্কা বাঁধ আর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বেতার ও ঢাকা টেলিভিশনে তখন ক্রমাগত বাজানো হচ্ছিল একটি রবীন্দ্র-সঙ্গীত। পাকিস্তানের বেতার ও টেলিভিশনে তখন রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার প্রায় নিষিদ্ধ। সে সময় বিশেষভাবে ঢাকা টেলিভিশনে একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত বার বার বাজানো হতে শুনে আমরা অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলাম। গানটি হলো- ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধঃ।’

    ঢাকা টিভিতে বার বার এই গানটি সম্প্রচারিত হতে দেখে তৎকালীন মহাপরিচালককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাই আপনারা কি রবীন্দ্রনাথের এই ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ গানটি অনবরত বাজিয়ে গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলতে পারবেন? মহাপরিচালক লজ্জিত হাসি হেসে বলেছিলেন, কি করবো ভাই, সরকারের নির্দেশ। হয়তো তাদের কোনো অনুগ্রহভোগী বুদ্ধিজীবী এই পরামর্শটি দিয়েছেন। তবে এর ভালো দিকটাও দেখুন। আমরা অন্তত এই সুযোগে বেতারে-টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজানোর সুযোগ পাচ্ছি।

    গেল পাকিস্তান আমলের কথা। এবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী আমলের কথায় আসি। পাকিস্তান আমলের কোনো কোনো সমস্যার উত্তরাধিকার বাংলাদেশকেও গ্রহণ করতে হয়েছে। যেমন ভারতের সঙ্গে নদী নিয়ন্ত্রণ ও পানি বন্টনের সমস্যা। ফারাক্কা বাঁধ তখন বাস্তবতা। তাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ভারত বৃহৎ এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী। বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে বেষ্টন করে আছে। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের যতোটা স্বার্থ ও অধিকার আদায় করা যায়, সেই চেষ্টাই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম সরকার করেছে এবং ভারতের কাছ থেকে ৪০ হাজার কিউসেফ পানির হিস্যাও আদায় করেছে।

    স্বৈরাচারী সরকারগুলোর আমলে ভারত-বিদ্বেষ প্রচার দ্বারা ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে গঙ্গার পানির সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে রাজনীতিকীকরণের উপর গুরুত্ব দেন। শুরু হয় মিছিল, মিটিং, লঙ মার্চ ইত্যাদি। মওলানা ভাসানীকেও সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এই ব্যাপারে মাঠে নামিয়েছিলেন। তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। বাংলাদেশ হিস্যা মাফিক পানি পায়নি। ভারত কোনো পানি চুক্তি করেনি। এই চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য করার জন্য ভারতের উপর প্রভাব বিস্তারে জাতিসংঘ বা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে রাজি করাতেও জিয়া সরকার থেকে শুরু করে খালেদা-নিজামি কোনো সরকার পারেনি।

    অথচ এই অসম্ভব কাজটা সম্ভব হয়েছে জঙ্গিপনা না দেখিয়ে কেবলমাত্র আলাপ-আলোচনা ও বন্ধুত্বমূলক মনোভাবের প্রকাশ দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে। আবার দীর্ঘ একুশ বছর পর প্রথম- বারের মতো ক্ষমতায় এসেই এই একই কাজটা করেছেন হাসিনা সরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ত্রিশ বছর মেয়াদি পানিচুক্তি সম্পাদনে রাজি হয় এবং এগিয়ে আসে। বর্তমানে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সমস্যাটি আবার প্রকট হয়ে উঠেছে, তারও সমাধান সম্ভব যদি ভারত বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশীর দাম্ভিকতা ত্যাগ করে আলোচনায় এগিয়ে আসে এবং বাংলাদেশও কোনো প্রকার জঙ্গিপনার দ্বারা সেই দাম্ভিকতায় খোঁচা না মেরে আত্মমর্যাদা ক্ষুণœ না করে বন্ধুত্বমূলক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আলোচনায় এগিয়ে যায়। বর্তমান হাসিনা সরকারের প্রচেষ্টা সেদিকেই নিয়োজিত বলে মনে হয়।

    তবে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের অনুগ্রহপুষ্ট একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর প্রচার-প্রচারণা দ্বারা মনে হয়, পাকিস্তানি আমলের ভারত বিদ্বেষ প্রচার ও কনফ্রন্টেশনের নীতি অনুসরণ দ্বারা টিপাইমুখ বাঁধের সমস্যা থেকেও তারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চান এবং সমস্যাটির সহজ সমাধান চান না। তারা জানেন, এই কনফ্রন্টেশনের নীতি দ্বারা সমস্যাটির সমাধান হবে না, বরং বাংলাদেশের মানুষের অশেষ অকল্যাণ হবে।

    সেই সঙ্গে আরেকটি সত্য হলো, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ফলে শুধু বাংলাদেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, ভারতের পূর্বাঞ্চলের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের ভারত-বিদ্বেষী মহল এই সত্যটা চেপে রেখে কেবল বাংলাদেশই একা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ভারতের পানি-অধিকার কর্মী কে.আর. রঞ্জন স্পষ্টই বলেছেন, ‘টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে ভারত সব সত্য কথা বলছে না। এ বাঁধ নির্মিত হলে মনিপুরে অকাল বন্যা এবং ভারতীয় এলাকার বিরাট অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাবে।”

    ভারতের পানি অধিকার কর্মীর এই বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়, সমস্যাটা উভয় দেশের। কেবল বাংলাদেশের সর্বনাশ করার মতলব নিয়ে এই প্রকল্প তৈরি হয়নি। বরং দু’দেশের মধ্যে আলোচনাক্রমে যদি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দু’দেশের মানুষেরই ছোটোখাটো কিছু উপকারে আসতে পারে। বিএনপি-জামায়াত পন্থীদের প্রচারণা শুনলে একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যাটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারই তাদের লক্ষ্য। তাতে দেশ ও জাতি গোল্লায় যাক, তাতে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

    টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যে বিএনপি-জামায়াত জোট গেল গেল রব তুলেছে, তার সমর্থন-সূচক বক্তব্য শোনা যায় না, তাদের ঘরানার কোনো কোনো নদী আইন বিশেষজ্ঞের কক্তেও। যেমন ড. আসিফ নজরুল তার এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের আসল মতলব সম্পর্কে নানা সন্দেহ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখলেও শেষ পর্যন্ত বলেছেন, “ভারত যদি শুধু টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে, যদি টিপাইমুখ প্রকল্প এলাকায় ভূমিকম্প না হয়, যদি ভারত ফুলেরতল ব্যারেজ নির্মাণ না করে, যদি টিপাইমুখে জমিয়ে রাখা পানি প্রত্যাহার না করে, তাহলে বাংলাদেশের ক্ষতি মারাত্মক নাও হতে পারে।” এতোগুলো যদির উপর মন্তব্য করা বাহুল্য।

    সম্ভবত এ জন্যই ৩২ বছর যাবৎ পানি সম্পদ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন যে বিশেষজ্ঞ সেই কাজি গোলাম মোস্তফাও সংবাদপত্রে প্রকাশিত তার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “টিপাইমুখ প্রকল্পটি নিয়ে এখনই আন্তর্জাতিক দেন-দরবারে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। কারিগরি ও বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মনে হয়, ভারত যদি ফুলেরতল ব্যারেজ নির্মাণ না করে তাহলে বাংলাদেশের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। আর ভারত যদি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাহলে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সেখানে কারিগরিভাবে নিরাপদ ড্যাম নির্মাণ সম্ভব। এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক দেন-দরবারে যাওয়ার পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসাই লাভজনক।”

    এই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি। আগে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। জানা দরকার টিপাইমুখে তাদের প্রকল্পটি কি? তা ভালোভাবে জানার আগেই এই যে গেল গেল চিৎকার এবং সমস্যাকে সংকটে এবং শেষ পর্যন্ত সংঘাতে পরিণত করার চেষ্টা তা দেশের হিতাকাঙক্ষী ব্যক্তি বা দলের হতে পারে না। যারা এ চেষ্টাটি চালাচ্ছেন, তাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ করা প্রয়োজন।

    লন্ডন ।। ২৭ জুন, শনিবার ।। ২০০৯

    জবাব দিন
    • রশিদ (৯৪-০০)

      অসংখ্য ধন্যবাদ মান্নান ভাই........

      কিন্তু সমস্যাটা রয়েই যায়, যখন গাফফার চৌধুরী জে. জিয়ার সময়ের ২বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তির কথা চেপে যান (যেটাতে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল).......আমরা আসলেই অদ্ভুত টাইপের সব লোকজন......নইলে একজন স্বনামধন্য কলামিস্ট, যিনি কিনা পাকিস্তানিদের জাতীয় বিষয়ে সমঝোতার কথা বলছেন অথচ নিজের বেলায় তার আর প্রয়োগ করছেন না.......

      এই আত্মঘাতি প্রবনতার শেষ কোথায়???

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।