আব্বার হঠাৎ করেই চোখে ছানি পড়লো। ৫৫ বছর বয়সে বার্ধক্য ভর করেনি। এখনো আব্বা অনেক কর্মঠ এবং সার্ভিসে আছেন। কোন অসুখও নেই এবং এমন হয়নি যে কোন অপারেশন বা সিরিয়াস সিকনেসের কারনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। ছানি আরো বেশি বয়সে হয় সাধারণত। কিন্ত আব্বার হঠাৎ করেই এবছর প্রব্লেম ধরা পড়লো এবং খুব দ্রুত ছানি ম্যাচিউরড হয়ে গেল। সামান্য দূরত্বেও মানুষ আইডেন্টিফাই করতে সমস্যা হয়। অনেকেই হয়ত ভাবে দেখেও কথা বললোনা তাই একটু বিব্রতকর বটে। আবার সার্ভিস করার কারনে ঘরে বসে থাকার কোন উপায় নেই। তাই অপারেশন অবধারিত। আব্বা বাইরে গেলেই আমরা খুব চিন্তায় থাকি সন্ধ্যায় বাসায় আসার আগ পর্যন্ত কিন্তু তার নিজের কোন চিন্তা আছে বলে মনে হয়না।কারন আগের মতই কেয়ারলেস চলাফেরা। আব্বা নিজেও ডাক্তার আর তাই পরিচিত সিনিয়রদের সাথে(আই স্পেশালিস্ট) কন্সাল্ট করলেন। তারাও সার্জারীর পরামর্শ দিলেন।
ক্যামেরার লেন্সের মত মানুষের চোখের ভিতরও একটি স্বচ্ছ লেন্স থাকে।কোন কারনে এই লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে গেলে আমরা তাকে ছানি বলি। ছানির মেডিকেল টার্ম CATARACT. নীল ও বেগুনী রং চিনতে সমস্যা হয় আর ঝাপসা দেখা যায়। সাধারণত বয়সের কারনেই ছানি পড়ে। তাছাড়াও ছানি বিভিন্ন কারনে হতে পারে-জন্মগত কোন ত্রুটি থাকলে,চোখে আঘাত পেলে বা কোন প্রদাহ হলে এবং ডায়াবেটিসের কারনেও ছানি পড়তে পারে। ছানির একমাত্র সমাধান সার্জারী করে লেন্স প্রতিস্থাপন করা। চশমাতেও কোন কাজ হবেনা।
চোখের ব্যাপার অবশ্যই সেন্সেটিভ।তাই দ্রুত এবং সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।ছানি ম্যাচিউরড না হলে ডাক্তার অপারেশন করবেননা আবার ম্যাচিউরড হলেও দেরী করা ঠিক নয়। আমি ভাবতে লাগলাম কোথায় অপারেশন করানো যেতে পারে। অনেক নরমাল জায়গায় অপারেশন করেও অনেকের ভাল অপারেশন হয়েছে আবার ভাল হাসপাতালে করেও কিছু সমস্যা কারো কারো হয়।তাই অপারেশন যত সিম্পলই হোক না কেন অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।চোখের ব্যাপার খুব সেন্সিটিভ আর সব অপারেশনে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। তার পরও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিৎ। অনেক খোজ খবর করে জানতে পারলাম ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালই বেষ্ট হবে।
আব্বাকে ঢাকায় নিয়ে এসে ইসলামিয়া তে দেখালাম।ওখানে কয়েক দফা দেখে এবং এই টেস্ট সেই টেস্ট করে যা বুঝা গেল উনার ডানচোখে ভিশন (6/60) এবং বামচোখে (6/36) তাই ডানচোখে অপারেশন আগে করতে হবে। এখানে প্রচুর লোকজন দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও দেখলাম সবকিছু সিস্টেমেটিক বা সার্ভিস ভাল এবং এরা অনেক পেশাদার।
জানতে পারলাম ফ্যাকো সার্জারী (phacoemulsification) ছানি অপারেশনের যুগান্তকারী আবিস্কার।এই সার্জারী শেলাই বিহীন ব্যথা বিহীন এবং ঝামেলামুক্ত।ফ্যাকো(Phaco) মেশিনের মাধ্যমে ছোট(২.২-৩ মি.মি.) একটি ছিদ্র করে লেন্সটিকে ছোট ছোট টুকরো করে বের করে নতুন কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করা হয়। এই প্রতিস্থাপিত লেন্সই(Intraocular Lens/IOL) সারা জীবনের পাথেয়।
সার্জারীর চিত্র
লেন্স অপসারণ করা হচ্ছে
কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করা হলো
এই অপারেশন করতে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে আর অপারেশনের পর পরই রোগী বাড়ি চলে যেতে পারে। আবার তারপরদিন এসে ব্যাঞ্জেজ খুলে গেলেই হয়। কিন্তু ইসলামিয়াতে আগেরদিন ভর্তি হতে হয় আর অপারেশনের পরদিন রিলিজ করে।এতে পোষ্ট অপারেটিভ মনিটরের ব্যাপার আছে আর তাদের ব্যবসায়িক ফায়দাও আছে। অপরদিকে প্রচলিত অপারেশনে বেশি কাটতে হয় এবং লেন্স একসাথে বের করতে হয় তাই রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে,সেরে উঠতেও সময় লাগে বেশি।
এক্রিসফ লেন্স
এখন ভাবতে হবে কোন লেন্স নিব। এখানে ইন্ডিয়ান, ব্রিটিশ এবং আমেরিকান লেন্স আছে। রীতিমত নেট স্টাডি এবং পরিচিত ডাক্তারদের সাথে কন্সাল্ট করতে লাগলাম। আমার চিন্তা হলো যত সিম্পল অপারেশনই হোক চোখের ব্যাপার তাই খুব ভাবার বিষয়। একটু ভুল হলেই সেটি রিকভার করার কোন উপায় থাকবেনা। লেন্স আবার হার্ড(Rigid/Unfoldable) এবং সফ্ট-ফোল্ডেবল(Soft Foldable Intraocular Lens) দুরকমই আছে। শক্ত লেন্স ভাজ করে যায়না তাই একটু বেশি কাটতে হয়।আর তাই প্রদাহ,ব্যথা,রক্তক্ষরণ সবকিছু বেশি হতে পারে।আর ফোল্ডেবল লেন্সে এই ঝামেলা নেই।আর পুনরায় ছানি পরার সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে(< ১%)। Alcon Lens(আমেরিকার তৈরী) এবং FDA(Food and Drug Administration) Approved তাই আমরা Alcon Acrysof Single Piece (American)(S.A-60) লেন্স নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম যা Acrysof নামক নরম প্লাস্টিক উপাদানে তৈরী যা উন্নত এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টি দেয় এবং ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি প্রতিরোধ করে। আর অল্প আলোতে দৃষ্টির সূক্ষ্ণতা ও রঙের পার্থক্য(Contrast Sensitivity) নিরূপনের ক্ষমতা বাড়ায়। এখন ডাক্তার সিলেক্ট করার পালা। আমাদের টার্গেট ছিল দুইজন প্রফেসর সার্জন- কামাল অথবা সারোয়ার।ডাঃ কামাল সার্জারী করেন রবি, মঙ্গলবার আর ডাঃ সারোয়ার বৃহঃপতিবার।
যেদিন অপারেশন করাবো তার আগেরদিন ভর্তি হতে হবে। আমরা ডাঃ সারোয়ারকে দিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। বুধবার ২৮ অক্টোবর আব্বা মা’কে নিয়ে চলে এলেন টাঙ্গাইল থেকে । ভর্তি করালাম এবং অনেক কষ্টে কেবিন ম্যানেজ করলাম। সারা জীবন আব্বাকে অভিভাবক হিসেবে দেখে এসেছি। আজ আমি অভিভাবক হয়ে সব কাগজপত্র ফিলাপ করে ফর্মালিটিজ শেষ করলাম। এখানে কেবিন এভেইলেবল থাকেনা। আমরা দুতলায় সবচেয়ে বড় কেবিনটাই পেলাম।কেবিন নয় যেন খেলার মাঠ। আমাদের মাঝে তেমন কোন টেনশন নেই, কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব।
তারপরদিন ২৯ অক্টোবর অপারেশনের আগে আব্বাকে বেশ নির্বিকার মনে হলো কারন উনি এই অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। অপারেশন হবে তিন তলায়।ওটিতে নিয়ে যাওয়ার আগে তেমন কোন হৃদয়গ্রাহী ব্যাপার ঘটলোনা। তারপরও কি অজানা কোন আশঙ্কা আমাদের মনে উকি দেয়নি? হয়ত দিয়েছে কিন্তু আমরা সবাই শক্ত ছিলাম এবং পজিটিভ ভাবছিলাম আর আল্লাহকে ডাকছিলাম।কারন আমাদের সাধ্যমত আমরা সব করেছি।আমি শুধু আব্বার সাথে গিয়ে ওটিতে দিয়ে আসলাম। মাত্র একটি ফ্লোর উপরে হলেও লিফ্টে নিয়ে গেল। ওটির সামনে আবার থাকা যাবেনা তারাই অপারেশনের পর কেবিনে দিয়ে যাবে। তাই আমি কেবিনে চলে আসলাম। সময় বাড়তে থাকে, আধ ঘন্টা পার হয়ে যায় আব্বার আসার কোন লক্ষন নেই। আমাদের অস্থিরতা বাড়ে, আমি ওটির সামনে গিয়ে একবার ঘুরে আসি। আমি জানতাম ওটি’তে আবার অনেক রুম আছে তাই একেবারে কয়েকজনকে ভিতরে নিয়ে চেকআপ করে অপারেশন করে কয়েকজনকে একসাথে। আমিও তাই ভাবলাম আর সবাইকে মা সহ সবাইকে আশ্বস্ত করলাম।কারন এখানে আমাকেই বেশি শক্ত থাকতে হবে। ঘন্টাখানেক পর হুইল চেয়ারে করে চোখে ব্যান্ডেজ বাধা অবস্থায় আব্বাকে রুমে দিয়ে গেল। সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। আব্বা আমাদের অভয় দিলেন এবং বললেন কোন সমস্যা হয়নি। অপারেশনের সময় ব্যথা দূরে থাক, টের পাওয়া যায়না।অপারেশনের আগে একটু লোকাল দিয়ে নেয়। আমার ধারনাই ঠিক, ওখানেও কিছু চেক আপ করতে হয়, তাছাড়া ডাঃ সারোয়ার আরেকটি অপারেশন করছিলেন তাই অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে এলো। অপারেশনের পর নরম কিছু খেতে বললো যাতে চিবানোর সময় চাপ না পড়ে। তাই আমি থাই স্যুপ এনে দিলাম। আর কালো সানগ্লাস কিনতে বলা হলো তাই ফার্মেসী থেকে টিপিকাল গ্লাস কিনে দিলাম। বিকালে নার্স এসে যখন চোখে ড্রপ দেয়ার জন্য ব্যান্ডেজ একটু খুললো তখনই আব্বা বললেন ভাল দেখতে পাচ্ছেন। আমাদের আনন্দের সীমা নাই।আবার ব্যান্ডেজ করে দিলো।
তারপরদিন সকালে ফাইনালী ডাক্তার দেখে রিপোর্ট দিলেন ভিশন (6/9) এবং ব্যান্ডেজ খুলে দিল। (6/60) থেকে (6/9)! অসাধারণ ! এখন চশমা ছাড়াই অনেক ভাল দেখতে পান।
নতুন লেন্স প্রতিস্থাপন করা চোখ
-আব্বা আমাকে বললেন “তোমার শার্ট কবে কিনলা ? শার্ট ত সুন্দর হইছে ।“
ছোট বাচ্চা একটি একটি করে কথা শিখলে বাবা মা যেমন মুগ্ধ হয় আমিও তেমনই মুগ্ধ হই। আব্বা জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলেন দূরে রাস্তায় সব ক্লিয়ার দেখতে পাচ্ছেন। মড়ার্ন টেকনোলজিকে ধন্যবাদ জানাই আর ভাবি চিকিৎসা বিজ্ঞান কত উন্নত হয়েছে ! আব্বাকে রিলিজ করে দেয়া হলো।
চোখে ১৫ দিন পানি দেয়া যাবেনা, ভারী জিনিস তোলা যাবেনা আর ১ মাস একটু সাবধানে থাকতে বলা হলো।আর চোখের ৩ টি ড্রপ দেয়া আর কালো সানগ্লাস ইউস করতে বলা হলো ধূলাবালি থেকে প্রটেকশনের জন্য।
-আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যখন বামে টার্ন নিলাম তখন আব্বাকে বললাম কতদূর দেখতে পাও।
-আড়ং এর পিছনে যে উচু বিল্ডিং এর পিছনে সব স্পষ্ট দেখা যায়।
আমার মুগ্ধতার মাত্রা সেই বিল্ডিং এর পিছনে দিগন্ত রেখা পেরিয়ে যায়।
আব্বা এমনিতেই স্মার্ট আর ফ্যাশন সচেতন তার প্রমান তিনি আবারো রাখলেন।
-আমাকে বললেন “একটা ভাল কালো সানগ্লাস কিনে দাও বাইরে যাওয়ার জন্য।“
আমি বিকেলে বসুন্ধরা থেকে একটি ফ্যাশনেবল গ্লাস কিনে দেই।তাঁর ফ্যাশনের মাত্রা আরো একধাপ বাড়ে (Clearly Ahead)।আর চোখের দৃষ্টিও ত মাশাল্লাহ্।
এক সপ্তাহ পর রেগুলার চেক আপে আসি ডাক্তার বলে সব ঠিক ঠাক চিন্তার কোন কারন নেই।এক মাস পর আবার যেতে বলেছে। ডিসেম্বরের ফার্স্ট উইকে আবার ফাইনাল চেক আপের পর আশা করি আমরা বাম চোখের(6/36) কথা সার্জারির কথা ভাবতে পারবো।
সবাই আমার আব্বার জন্য প্লিজ দোয়া করবেন আরেক চোখেও যেন দৃষ্টিশক্তি এই চোখের মতই ফিরে পান।
আঙ্কেলের জন্য দোয়া রইলো।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
আঙ্কেলের জন্য দোয়া রইলো 😀
দোয়া রইলো
ইনশাল্লাহ আংকেল পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যাবেন ...... তোমার এই পোস্টটা খুবই চমৎকার হয়েছে।
খালু পুরো দৃষ্টি ফিরে পান এই কামনা করি। আমাদের শুভকামনা জানিও।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
দোয়া রইলো ......
আলহামদুলিল্লাহ
পড়া শেষ করা পর্যন্ত একটু টেনশনে ছিলাম, খুব ভালো লাগলো পুরোটা জেনে।
আল্লারে ভাই কেমনে লিখলেন। শেষ প্যারা পড়ার আগ পর্যন্ত আসলেই খুব টেনশন-এ ছিলাম। ইনশাল্লাহ খুব শীঘ্রই আন্কেল সুস্থ হয়ে উঠবেন।
আঙ্কেলের জন্য দোয়া রইলো। আর আপনার লেখাটাও ভাল লাগল ভাইয়া
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আমার আব্বুও গত মাসে ইসলামিয়া থেকে এই অপারেশন করিয়েছেন......এবং তার বয়সও ৫৫...
একদম মিলে গেল দেখছি !!!!!!!
আব্বুর ডান চোখে হয়েছে......ডিসেম্বরেই বাম চোখেরটাও করানোর কথা...
আংকেলের জন্য শুভকামনা।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
লেখাটা ভালো লাগল ইমরান ভাই। পড়া শেষ করে বেশ স্বস্তি অনুভব করলাম।
আশা করি আংকেল পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠবেন শীঘ্রই।
eid leave a tangail asar karone net a boste parini goto koyekdin.tai response kora hoyni.ekhane bangla font nai.onek kosto kore cyber cafe theke comment korchi.sobai k onek dhonnobad amar abbar jonno dua korar jonno.blog a boste na pere koyekdin khub fapor a achi.
মন্তব্যের নিচে দেখেন অভ্র অপশন আছে, আপনার অভ্র ইন্সটল করা না থাকলেও বাংলায় মন্তব্য করতে পারবেন ইমরান ভাই।
ভাল বুদ্ধি দিয়েছ তানভীর ধন্যবাদ।