বধ্যভূমির শব্দটির উচ্চারণ কেউ করলে প্রথমেই মাথায় চলে আসে রায়েরবাজার বদ্ধ ভূমির কথা। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আরেকটি বদ্ধভূমি হবে তা কি কল্পনা করেছে কেউ? তাও আবার বিডিআর এর পিলখানা সদর দপ্তরে? ইউনিফর্ম পরিহিত নিরস্ত্র সামরিক কর্মকর্তাদের নিশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে? একাত্তরের স্বাধীনতার পর রায়বাজারের বদ্ধভূমিতে আমরা পেয়েছিলাম অসামরিক বুদ্ধিজীবীদের লাশ আর স্বাধীনতার পরে আমাদেরকে পিলখানার বধ্যভূমিতে পেতে হলো সামরিক পোশাক পরিহিত সামরিক কর্মকর্তাদের লাশ। শুধু কি তাই? স্ত্রী, শিশু সন্তান এমনকি নিহত কর্মকর্তাদের মায়েরাও লাঞ্ছিত হয়েছেন। স্বাধীন হওয়ার পরেও নারীদের নিস্তার নেই, তাও আবার নারী শাসনের যুগে। এবার আমরা কাকে দোষারোপ করব? ব্রিটিশরা তো খুবই খারাপ আর পাকিস্তানিরা আরো আরো খারাপ, কিন্তু এবার কি? এবার কি আমরা নিজেদের গায়ে নিজেরাই থুথু ছিটাবো?
বিডিআর বিদ্রোহকে কি কোনভাবেই বিদ্রোহের পর্যায়ে বিবেচনা করা যায়? আসলে একে বিদ্রোহ বলা আর এই অমানবিক নৃশংস ঘটনার কুৎসিত ভয়াবহ চেহারার ওপর পুরো এক স্তর মেক আপ চড়িয়ে দেয়া বা ধামাচাপা দেয়ারই নামান্তুর। বিডিআর পিলখানা সদর দপ্তরে ঘটে যাওয়া সে নৃশংসতার স্বীকার এক ভুক্তভোগীর ভাষ্য অনুযায়ী তা ছিল এককথায় carnage, massacre।
ঐ ঘটনার মূল পরিকল্পক থেকে শুরু করে, ঐ ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতাকারী এবং সর্বশেষ ঐ ঘটনার বাস্তবায়নকারী আমাদের যে মেসেজ দিয়েছে তা নিম্নরূপঃ
/তোমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষিত স্থাপনায় নিরাপদ নয়।
/তোমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিজেদের পিঠ বাঁচাতে অক্ষম তারা তোমাদের মত সাধারণ মানুষকে রক্ষা করবে কিভাবে?
/আমরা তোমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার যে কোন স্তরেই আমাদের ইচ্ছে মাফিক প্রবেশ করতে পারি। আমরা আমাদের ইচ্ছে মত প্রভাবান্বিত কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত করতে পারি তাদের, যাদের ওপর তোমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরু দায়িত্ব দিয়েছ।
/আমরা অদম্য, আমরা অজেয়, আমরা অদৃশ্য। আমাদের অভিধানে নৈতিকতার দিকনির্দেশক/মানদন্ড, ন্যূনতম নৈতিক মূল্যবোধ, যে কোন অবস্থায় শত্রুপক্ষের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব এসব কোন বিষয়েরই অস্তিত্ব নেই। চূড়ান্ত অনাচারের অন্তঃহীন গহবরে আমরা নিশ্চিন্তে ডুবে যেতে পারি বলেই নিহত সামরিক কর্মকর্তাদের মা, তাদের স্ত্রী এমনকি তাদের শিশু সন্তানদেরও লাঞ্ছিত করতে আমাদের বাঁধে না। যেহেতু আমরা শূন্য বিবেকের অধিকারী তাই যত অনাচারী আমাদের হাত দিয়ে হোক না কেন দিন শেষে আমাদের তিল পরিমাণও আফসোস নেই, ওটাও একটা বড় শূন্য। আমরা দেখতে শুনতে মানুষের মত কিন্তু আদতে মানুষ নই অন্য কিছু।
/যদিও তোমরা সার্বভৌম জাতি, তোমরা সেই সার্বভৌম জাতির মনিব নও বরং তোমাদেরকে শর্তহীন ভাবে “অন্য কাউকে” মেনে চলতে হবে, নতজানু হয়ে মাথা ঝুকিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হবে। তোমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ঠাকুমার ঝুলি ছাড়া আর কিছুই নয়, শর্তহীন অধীনতাই তোমাদের একমাত্র বাস্তবতা।
হত্যাকারীদের এতটা ক্ষোভের কি কারণ থাকতে পারে যে জন্য তার দাবি দাওয়া আদায়ের স্বার্থে তাকে অফিসারকে হত্যার পর অফিসারের স্ত্রী ও কন্যাকেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে হয়। এই বিষয়টা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সৈনিক অফিসারের মধ্যে সম্পর্ক যদি ঘৃণা ও আস্থা হীনতার হয় তবে তো আর বহিঃশত্রুর প্রয়োজন নেই, বারোটা বাজানোর জন্য আমরা নিজেরাই যথেষ্ট।
জীবিত থাকা অবস্থায় মানুষগুলো যতটা না শক্তিশালী ছিল শহীদের মৃত্যুবরণ করে নেওয়ার পর তারা আরও শক্তভাবে আমাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে, অফুরন্ত অনুপ্রেরণা হিসেবে আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। তারা সাহসী ছিলেন, তারা কাপুরুষ ছিলেন না। অবশ্যম্ভাবী পরিণতি জেনেও তারা হত্যাকারীদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের সবাইকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান নসিব করুক এই দোয়া করি।
ন্যায় বিচার তো হবেই। আজ, কাল বা পরশু এই জীবন কালেই। অন্তরে অন্তঃস্থল থেকে দোয়া করি যেন আল্লাহ সুবহানূওয়াতায়ালা মুখোশ পরা ষড়যন্ত্রীদের আসল চেহারা দিনের আলোয় উন্মুক্ত করে দিক, যেন সবাই তাদেরকে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিনে নিতে পারি।
প্রকৃতি সর্বদাই একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। বিডিআর গণহত্যা সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। সমীকরণের ডান আর বাম হাত কিন্তু এখন পর্যন্ত সমান সমান নেই। কিন্তু তাই বলে ইতিহাস থেমে থাকে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় এবং তার প্রভাব থেকে ওরা কেউই মুক্ত নয়। হ্যাঁ এমনকি ১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্টের হতাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা বেশ একটা বড় সময় কি আরামেরই না পার করে ফেলেছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। প্রকৃতিতে বিচরণকারী প্রত্যেকের প্রকৃতির বিচার এরকম নিরপেক্ষই হয়েছে, হতে থাকবে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।