ফুটবল বিষয়ক নৈশ অভিযান !

ক্যাডেট কলেজে ঢোকার আগে ফুটবল নিয়ে এতোটা ক্রেজ ছিল না। খেলা দেখতাম, ব্যাস এতটুকুই। এর বেশি কিছু ভাবার কোনো কারন কখনো দেখি নি । যাই হোক ক্যাডেট কলেজের বাধ্যতামূলক গেমস পিরিয়ড অল্প কয়েকদিনের মাঝে আমি সহ আমার আরো কতিপয় সহপাঠীকে পুরোদস্তুর ফুটবল প্লেয়ার বানিয়ে দিলো। গেমস টাইম এ ফুটবল খেলি আর প্রেপ , ক্লাস টাইমে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল নিয়ে আড্ডা মারি। খেলা দেখার সুযোগ খুবই কম। চ্যানেল থাকেনা মাঝে মাঝে আর যখন থাকে তখন হয়ত আমরা প্রেপ এ অথবা লাইটস  অফ এর পর বেডে। আর যখন থার্ড প্রেপের পর কোনো খেলা থাকতো বেশির ভাগ সময়ই মন খারাপ করে টিভি রুম থেকে চলে যেতে হতো । কারন রিমোর্ট কন্ট্রোল টা থাকতো সিনিয়র ভাইদের কাছে। তারা এই স্বল্প সময়ের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে  কোনো হিন্দি গানের চ্যানেলকেই বেছে নিতেন। :brick:  বসে উসখুস করা ছাড়া আমাদের সেই ফুটবল ক্রেজি গ্রুপটার আর কিছু করার ছিল না। সে কারনে পরদিনের ডেইলি স্টার আর নিউ এজ  এর খেলার পেজ ই ছিল আমাদের ভরসা !

যাইহোক , একটু সিনিয়র হলাম। আমাদের অল্টারনেট  আর ইমিডিয়েট সিনিয়রদের  ব্যাচে আমাদের মতো কিছু ফুটবল পাগল ক্যাডেট ছিল। তো একসাথে গেমস টাইমে খেলার সুবাদে আমাদের রিলেশন টা খুব  ভালো ছিল। তাদের প্ররোচনা দেওয়া শুরু করলাম। রেসাল্ট পসিটিভ।  সেই থেকে শুরু হলো আমাদের নৈশ অভিযান। হ্যা, রাতের বেলা লাইটস অফ এর পর চুরি করে টিভি রুমে ঢুকে খেলা দেখা। স্পেশালি চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচ গুলো শুরু হতো  রাত পৌনে একটা থেকে। ঐদিন দুপুর থেকে আমাদের মাঝে বিশাল একটা উত্তেজনা কাজ করতো। কার টিম জিতে আর কার টিম হারে। আমি আবার রিয়াল মাদ্রিদের ডাই হার্ড সাপোর্টার। ওই টাইম এ  রিয়ালের খুব বাজে সময় যাচ্ছিল। সো , বুঝতেই পারছেন যে মাঝে মাঝে বেশ ভালো রকমের পচানি খেতে হতো। টিভি রুম অফ করে দেওয়া হতো ১০:৪৫ এ। তার আগেই আমরা সাউন্ড কমিয়ে জিরো করে রাখতাম যাতে পরে এসে টিভি অন করলে যাতে কোনো সাউন্ড না হয়। বেডে গিয়ে হাউস মাস্টার চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতাম। স্যার চলে যাওয়ার পর অপেক্ষার পালা কখন নাইট ডিউটি মাস্টার হাউসে আসে। আমাদের ভাগ্য  টা খারাপ ছিল।সব নাইট ডিউটি মাস্টার ই  আমাদের হাউসের টপ এ থাকতেন। তবে আমরা খুব  ভালোমতই জানতাম যে কোন স্যার কখন রাউন্ড দেয়। এনডিএম এর রুমে গিয়ে কে কখন লাইট অফ করে শুয়ে পরে এটাও আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। স্যার ঘুমিয়ে পরলে  হাউস বেয়ারাও তার রুমে গিয়ে শুয়ে পরতো। এরপর শুরু হত আমাদের মিশন। রুম থেকে বের হয়ে সবাইকে ডেকে জড়ো  করতাম। বিভিন্ন পোস্টে গার্ড দাড়া করাতাম । একজন নজর রাখতাম হাউস বেয়ারার রুম এ… সাবানের উপর ছাপ দিয়ে বানানো একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। ঐটা দিয়ে টিভি রুমের তালা খুলে ভিতরে ঢুকতাম। এটা যেদিন লাক ভালো সেদিনকার ঘটনা। মাঝে মাঝেই হাউস বেয়ারা তালা চেঞ্জ করতেন। তখন ছিল আরেকটা রাস্তা। দরজার গ্লাসটা খুলে ফেলতাম। তারপর সেই ছোট ফোকর দিয়ে অনেক কসরৎ করে বডিটা সাপের মতো করে ভিতরে  ঢুকিয়ে দিতাম। এইদিন আমাদের মোটাসোটা  বন্ধুদের আর খেলা দেখা হতো না। ঐ ছোট ফোকর গলে তাদের বিশাল দেহ টা ঢুকতো না। স্বাস্থ্য  যে সবসময় সকল সুখের মূল না এই কঠিন সত্য অনুধাবন করতে করতে তারা রুমে ফিরে যেতো ! ~x(
টিভি রুমে ঢুকে আমাদের  প্রথম যে কাজ টা ছিল তা হলো জানালা গুলো কে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়া। যাতে টিভির আলো বাইরে না যায়। দূর থেকে গার্ডের বাশির আওয়াজ আর শেয়ালের ডাক শুনতে পেতাম। গা ছমছম  করা একটা পরিবেশ থাকত সব সময়। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যেতো আমাদের খেলা দেখার উত্তেজনা। এরপর দোআ দরুদ পরে টিভি টা অন করা হত। দোআ  দরুদের প্রসঙ্গ আসছে কারণ মাঝে মাঝেই চ্যানেল থাকত না। তখন নিজেদের ভাগ্যকে গালি গালাজ করে চলে আসতাম।আর চ্যানেল থাকলে তো কথাই নেই !  তখন  আমাদের তথাকথিত  অবৈধ মোবাইল ফোন থেকে অন্য হাউসে ফোন দেওয়া হতো। আমাদের কোনো প্রবলেম হলে আমরা অন্য হাউসে চলে যেতাম। অথবা ওদের ঝামেলা হলে ওরা চলে আসতো আমাদের হাউসে। এই আন্ত হাউস ভিসিট টাও ছিল খুব রোমাঞ্চকর। আমাদের কলেজে তিন হাউস এর বিল্ডিং আলাদা এবং মোটামুটি দুরে। হাউস গুলো আবার শেড দিয়ে কানেক্ট করা। আমরা দোতালার করিডোরের থাই গ্লাস দিয়ে শেডে লাফিয়ে নামতাম। তারপর এই শেডের উপর দিয়ে হেটে অন্য যেকোনো হাউসে চলে যেতাম। জোত্স্না রাতে  শেডের উপর দিয়ে হাটার মুহূর্ত টা এখনো আমার চোখে ভাসে। অদ্ভুত মায়াবী এক অনুভূতি।আমার জীবনে দেখা সেরা একটা  দৃশ্য হলো  সেই মুহুর্তের মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ । এটা  দেখার টানে ই মনে হয় প্রায় নিজের হাউসের টিভি রুম ফেলে অন্য হাউসে যেতাম খেলা দেখতে।
এরপর খেলা দেখার পালা। সে এক অন্যরকম অনুভুতি। একদম লো ভলিউম , কেউ কোনো কথা বলছে না। মাঝে মাঝেই ফিসফিস করে কিছু কথাবার্তার শব্দ। সবচেয়ে মজা হত যখন কোনো গোল হতো। লাফিয়ে উঠে আমরা সেলিব্রেট করতাম, হাই ফাইভ করতাম, হাততালি দিতাম। কিন্তু টিভির মতোই সবকিছুই যেন মিউট করা। কোনো শব্দ হত না। খেলা শেষ হলে হারু পার্টি মন খারাপ করে  দৌড় দিয়ে পালাতো। আর বাকিরা সব কিছু প্যাক আপ করে ফেরার প্রস্তুতি নিত। এরমাঝে হয়ত কতিপয় দুষ্ট ক্যাডেট কিছু গরম হিন্দি গান বা তামিল চ্যানেল দেখার প্রস্তাব দিয়ে  বসতো। 😛  যা অবশ্য বেশির ভাগ সময় ই অনাস্থা ভোটে বাতিল হয়ে যেত। সকালে পিটি তে যেতে হবে। তাই সবাই রুমে এসে শুয়ে পরতাম। সকালে যখন ঢুলতে ঢুলতে পিটিতে যেতাম, তখন যারা খেলার রেসাল্ট জানে না তারা স্কোর জানতে চাইতো। তখন নিজেদের বিশাল বস বস লাগতো। B-)  হাসি হাসি মুখ করে সবাইকে খেলার বর্ণনা দিতাম। আমরা যখন ইলেভেন টুএলভ এ তখন প্রায় একই  ঘটনা। সেই একই চক্র। তখন আমরা আবার এক কাঠি সরেস। চ্যানেল না থাকলে লোকাল ভিডিও চ্যানেলের নিচ  থেকে নাম্বার জোগার করে ক্যাবল অপারেটরকে ফোন দেওয়া হত। সে এক জটিল কাহিনী। বিভিন্ন জন, বিভিন্ন সিম থেকে বিভিন্ন পরিচয়ে ফোন করে চ্যানেলের জন্য তাগদা দিতো। কেউ বা আর্মি অফিসার, কেউ ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের নেতা, কেউ আবার ইঞ্জিনিয়ার! ক্লাস টুএলভ এ গিয়ে একবার হলো ট্রাজেডি ! আমি সহ আরো কয়েকজন  এইচ এসসি পরীক্ষার মাঝখানে খেলা দেখত গিয়ে হাতে নাতে ধরা খাই। বার্সেলোনা আর আর্সেনাল এর ম্যাচ। থাক, সে কাহিনী আরেকদিন হবে ! ওটা এখন মনে করতে চাচ্ছি না !  :no:
কলেজ থেকে বের হবার পর ও খেলা দেখা  চলছে। নেভাল একাডেমিতে থাকার সময় টুকুতে একটু বিরতি পড়েছিল। ইউএসএ   তে আসার পর ও সব ম্যাচই দেখি। কিন্তু কোথায় যেন সুর টা কেটে গেছে। সেই বুনো মজাটা আর পাই না। এখন খেলা দেখতে গেলে বারবার সেই সময়গুলোর কথা , চেনা মুখগুলোর কথা মনে পরে । কিছুই করার নেই। আমরা সবাই এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। আমার একটা প্ল্যান আছে। কোনো একদিন আমাদের সেই ফুটবল ক্রেজি গ্রুপ টা আবার একসাথে হবো। অবশ্যই সেদিন রাতে থাকবে চ্যাম্পিয়নস লীগের কোনো খেলা। রাতে আমরা জানালাটা  কম্বল দিয়ে ঢেকে দিব। টিভির ভলিউম টা  কমিয়ে দিব। তারপর ফিসফিস করতে করতে সেই পুরোনো স্টাইলে আবার আমরা একসাথে খেলা দেখবো। অদ্ভুত ফ্যান্টাসি ! জানি ….. তবু ও চিন্তা করতে ভালো লাগে।
১,১৩৩ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “ফুটবল বিষয়ক নৈশ অভিযান !”

  1. তন্ময় (২০০৬-২০১২)
    ক্লাস টুএলভ এ গিয়ে একবার হলো ট্রাজেডি ! আমি সহ আরো কয়েকজন এইচ এসসি পরীক্ষার মাঝখানে খেলা দেখত গিয়ে হাতে নাতে ধরা খাই। বার্সেলোনা আর আর্সেনাল এর ম্যাচ। থাক, সে কাহিনী আরেকদিন হবে ! ওটা এখন মনে করতে চাচ্ছি না !

    এই ঘটনার জের অনেকদিন বইতে হয়েছিল । প্রথমে ভাবতাম ভিপির বাসায় থেকে হয়তবা লাইন কাটে । হঠাত একদিন আবিষ্কার করলাম ঘটনাটা ঘটানো হয় SH এর তিনতলায় এবং আসামী হাউস মাস্টার.........অতঃপর............... :gulli2: :gulli2: :gulli:


    চলো বহুদুর.........

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।