“বুঝলেন ভাইজান, ক্লাশ ফোরে ইশকুলের নাটকে আমার অভিনয় দেইখা বাংলা স্যার বলছিলেন, এই পোলা তো একদিন উত্তম কুমার হইবো। হেডমাস্টার সাব একটা মেডেলও দিছিলেন। ” গার্ডের ইউনিফর্মটার এক পাশের বুক পকেট থেকে মেডেলটা বের করতে করতে অতীশদা হাসেন। মেডেল বলতে মরচে পড়া লোহার একটা চাকতির মতন। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, সেই চাকতির উপরে কোনকালে কিছু লেখা হয়তো ছিলো।
“ফিতাটা কই খুইলা পড়ে গ্যাছে!” এ কথাটা বলার সময় আমি প্রতিবারই অতীশদার চোখের দিকে তাকাই। কত বছর আগে পাওয়া একটা মেডেল! সেই মেডেলের ফিতা হারানোর জন্য একটা মানুষের দু:খবোধ দেখে অবাক হই প্রতিবারই।
“আহা! বাসে চইড়া শহরে আইসা কতবার উত্তম কুমারের বই দেখছি! শহরে তো আর আমার বাড়ীঘর ছিলো না। সিনেমা হলের সামনেই অনেক সময় ঘুমায়া পড়তাম।…….” শহরের কোথাও আমাদের পাঁচতলা দালান। সেই দালানের গেটে দারোয়ান অতীশদা। মাঝেমধ্যে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কিংবা কোন কোন বিকেল বেলা একটা টুলের ওপর বসে অতীশদার এইসব গল্প আমার শোনা হয়।
“আমার বইন আবার উত্তম কুমারের উপরে খুব খ্যাপা ছিল। ” এ কথা বলতে বলতে অতীশদা হো হো করে হেসে ওঠেন। সেই হাসির তীব্রতা আমার এতটুকু অগভীর মনে হয় না। “বুঝলেন ভাইজান! আমার বইনটা উত্তম কুমারের পোস্টারের সামনে খাড়াইয়া ঝাড়ি লাগাইত, ঐ ব্যাটা তুই সুচিত্রার লগে অত ঢলাঢলি করস ক্যান? আর একবার তো আমি সুচিত্রা সেনের একটা পোস্টার কিনছিলাম, ছিঁইড়া কুচি কুচি করে ফেলল। সে কী রাগ!”
এভাবে অনেক কথা হয় অতীশদার সাথে। সিগারেট আদান প্রদান চলে। অতীশদার সব কথাতেই উত্তম কুমার আসে। এর সাথে কখনোবা সুচিত্রা। আর অভিনেতা হতে না পারার যাতনা!
” ভাইজান! অভিনেতা হইবার বড় শখ ছিল। উত্তম কুমার হইতে না পারলেও আমি ঠিক নাম করতাম!” এই কথা বলে অতীশদা মাথা নীচু করে ফ্যালেন। আত্নপ্রশংসা করে লজ্জা পেয়ে যাওয়া প্রায় বুড়ো মানুষটার মুখ দেখে বড় মায়া হয় আমার! সেজন্যই হয়তোবা বলে উঠি, ” অপর্ণা সেন কী বলছে জানেন, উত্তম কুমার সম্পর্কে?” আমার এ কথায় অতীশদার চোখে লজ্জা পালিয়ে ঔৎসুক্য দেখা দেয়। “অপর্ণা সেন বলছে, উত্তম কুমার ছিলেন সব বাঙালি মেয়ের প্রেমিক, সব বাঙালি মায়ের ছেলে আর সব বাঙালি ছেলের হিরো।”
বিস্তৃত হাসিতে অতীশদার কুঁচকে যাওয়া মুখটা ভরে ওঠে, “হইবো না ভাইজান? এত বড় নায়ক আর আসছে কোনদিন?”
মাঝে মাঝে হয়তো বাড়িতে তৈরি কোন খাবারের বাটি নিয়ে সিঁড়ির নিচে অতীশদার ঘরে যাওয়া হয় আমার। সম্পূর্ণ নাটকীয়তা বর্জিত একটা ঘর। একপাশে রান্নার স্টোভ, নেতিয়ে যাওয়া চাদর, দুই একটা পুরনো কাগজ, আর দেয়ালে সাঁটানো উত্তম সুচিত্রার সাদাকালো পোস্টার। আমি হাসতে হাসতে মাঝেমধ্যে বলি, “সুচিত্রার ছবি দেখলে আপনার বোন রাগ করবে না?”
এ কথাতে সেই কুঁচকে যাওয়া মুখটা অন্ধকার হয়ে আসে। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি আমি। যে শব্দে শুধু দু:খরা লুকিয়ে থাকে! তারপর একটা জোর করে ফুটিয়ে তোলা হাসি। তারও পরে ভেঙে যাওয়া বুড়ো কণ্ঠস্বর। “বইনটারে কতদিন দেখি না। সেই যে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধইরা নিয়া গ্যালো। এরপর কত খুঁজছি জানেন? বইনরে খুঁজার জন্য বন্দুক নিয়া যুদ্ধে গেছি। ”
চোখের কোণায় শিশির বিন্দুর মতন জমে ওঠা দু ফোঁটা জল বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছতে মুছতে অতীশদা হাসেন একটু। “অবশ্য যেদিন দেশটারে স্বাধীন কইরা আসলাম, সেদিন সব কষ্ট ভুইলা গেলাম। কত আনন্দ ফূর্তি করলাম। কত স্বপ্ন দেখলাম!…..”
আমার খুব ইচ্ছে করে অতীশটার নুয়ে পড়া কাঁধটায় একটু হাত রাখতে। আমার খুব ইচ্ছে করে বলতে।
” এই দেশের প্রত্যেকটা ধূলিকণার স্রষ্টা আপনারা।
এই দেশের প্রত্যেকটা মানুষের কাছে আপনারা মহানায়ক। “
:awesome: :guitar: :tuski: ১ম
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
ছুয়ে যাওয়া একটা লেখা।
অতীশদা'দের জন্য :salute: :salute:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
:salute: :salute: :salute:
অফটঃ আমি কিন্তু উত্তম কুমারের বড় পাংখা...
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আমিও। 🙂
কি বলব ভেবে পাচ্ছিনা... অনেক অনেক :thumbup:
অসাধারন.................................
অতীশদা’দের জন্য :salute: :salute: :salute:
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
ধন্যবাদ রকিব , আদনান ভাই, শার্লী , আশহাব।
:just: :thumbup:
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
🙂
জাস্ট 🙂
অসাধারণ লাগল! খুবই চমৎকার একটা গল্প।
আরে! রনি ভাই!!
ভাল লাগল দোস্ত :thumbup:
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
:boss: :boss: :boss:
থ্যাংকু রাশেদ এন্ড জুবায়ের। 🙂
খুব কষ্ট লাগল। এইসব অতীশদারা মরে যায় না কেন তাড়াতাড়ি। একটা যুদ্ধ যারা জয় করল জীবন যুদ্ধে কেন তারা পরাজিত?
মহিব তুমি ভাইয়া আসলেই জাত লেখক। :hatsoff: :hatsoff:
ঐ.. :-B
তপু ভাই, শুধু শুধু ভয় পাওয়াইয়া দ্যান ক্যান?
অতীশদা :salute:
স্যালুট পৌঁছে গ্যালো বস। 🙂
অনেক প্ল্যানই বাস্তবে রূপ নেয় না, অনেক না বলে অধিকাংশ বলাই বেশী ভাল হবে। ভার্সিটিতে এসে কত প্ল্যান করা হয়েছে আমাদের রুমে, কিছুই হল না। এরকমই স্বাভাবিক।
কিন্তু সেই প্ল্যানগুলা একেবারে বৃথা যায় না। এক করতে গিয়ে অনেক সময়ই আরেকটা হয়ে যায়। এই যেমন তোর সেই প্ল্যানটা এই গল্পের মাধ্যমে পূর্ণতা পেল।
প্ল্যান কর বেশী বেশী, সব বাস্তবভিত্তিক না হলেও... কারণ একটা না একটা বাস্তবতার খুব কাছাকাছি এসে পড়বেই। 😛
অসুবিধা নাই! এখনো টাইম আছে। মুভি বানানোর চেয়ে গল্পই ভালো।
ঝামেলা কম!
একটাই খালি অসুবিধা। গল্পের নায়িকাদের শারীরিক ভাবে দেখতে পারবো না। কিন্তু মুভিতে। হয়তো প্রভারেই দেইখা ফেলতাম। পারলে একটু ছুঁয়েও দেখতাম 😛
আচ্ছা যা, তোর এই শখটা একদিন আমি পূরন কইরা দিমু। 😀
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
প্লীজ বস। একটু তাড়াতাড়ি করেন। 😀
প্রভার বাড়ি কি সিলেট 😛
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
কামরুল ভাই, এই ছিল আপনার মনে? 😛
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
মহিবের লেখার হাত সেরকম অদ্ভুত :boss:
অতীশদা সহ সকল মহানায়কদের :salute:
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
😀
স্যালুট পৌঁছে গ্যালো।
হুট করে শেষ করে দিলি মনে হচ্ছে। আর একটু বড় করা যেত। :clap: :clap: :clap:
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
যান। বড় কইরা আবার লিখব। 🙂
এটা কি সত্য কোন ঘটনা? শেষ দেখে সে রকম মনে হচ্ছে।
তোমার শব্দ চয়ন ভয়াবহ রকম সুন্দর।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
সত্য ঘটনা অবলম্বনে, বলতে পারেন।
মন্তব্যের নিচের লাইনটা মিথ্যে হইলেও শুনে বড় ভালো লাগল। 😀
পড়লাম। দারুন লাগতেছিল পড়তে।
কিন্তু শেষটা কেমন জানি। আরোপিত মনে হলো।
আচ্ছা ফয়েজ ভাইয়ের মন্তব্যের জবাবে কইলি, সত্য অবলম্বনে। তাইলে ঠিকি আছে...
ঠিক ধরৃছস। আমার নিজের কাছেই বানানো লাগতেছিল শেষ কয়েকটা লাইন। সত্য ঘটনা হইলেও শেষের লাইনগুলা ঠিক ঠিক হয় না। এর প্রধান কারণ অবশ্যই শেষের দিকে এসে উপস্থাপনার দুর্বলতা।
আর পুরান রোগ তো আছেই। তাড়াহুড়া! 🙂
অতীশদা সহ সকল মহানায়কদের সালাম।
মহিব,
ছোট গল্প হিসাবে ভালোই লেগেছে। তোমার লেখনী এতো ভালো তাই আরো বড় লেখা হইলে ভালো হইতো...এটাই সবাই চায়। আমার বরাবরের মতই ফারফেক্ট লেগেছে সবকিছু। 🙂
গল্পটা লিখে আসলেই তৃপ্তি পাই নাই।
একটু আঁতলামি করলাম। 😀
চমৎকার!
:boss:
তানভীর ভাই আর রবিন ভাইরে থ্যাংকু টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। 😀
চমৎকার কাহিনী। এই অনুভূতিটা যেন সকলেরই থাকে।
মহিব তের ফোন নম্বর টা দে তো....কদিন থেকে খুজছিলাম মনে মনে
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই