আমাদের মুমিত

মুমিতের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে আমার কৃত্রিম ঝগড়া হত। কৃত্রিম ঝগড়ার ক্ষেত্রে বিষয় তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। তাই আমাদের বিষয় ছিল একটা মেয়ে। ক্যাডেট কলেজে- গেমস টাইমে কিংবা ডিনার থেকে একাডেমিক ব্লকে আসার সময় আমরা তাকে নিয়ে আলোচনা করতাম। মুমিত তার বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা নিয়ে আমাকে বলত-
– মহিব, এসব ছাড়। বুঝলি?
তারপর একদিন মেয়েটা আমাকে চিঠি লিখল। চিঠিটা মুমিতের হাতে দিয়ে আমি একটা গা জ্বালানো হাসি দিলাম। কিন্তু মুমিতের মুখের বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা আমি মুছে যেতে দেখলাম না।
চার বছর পর সেই মেয়েকে যখন শেষ চিঠিটা লিখলাম- মুমিত আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল।
– দোস্ত। মন খারাপ করিস্‌ না।
সেটাই ছিল আমার কাঁধে মুমিতের শেষ হাত রাখা। মুমিত আমার বন্ধু ছিল। মুমিত আমার ভাই ছিল।

ক্যাডেট কলেজে আমরা বাবা-মা থেকে দূরে থাকতাম। সে বয়সের একটা ছেলে- কষ্টের কোন মুহুর্তে বাবা-মা’র কোলে আশ্রয় খুঁজে। আর আমাদের আশ্রয় ছিল বন্ধুরা। তাই বোধহয় আমাদের সম্পর্কটা শুধুমাত্র নাম-সর্বস্ব বন্ধুত্বকেও ছাড়িয়ে যায়।
মুমিত আমাদের একজন ছিল।

ইন্টার পরীক্ষার পর ঢাকায় আসলাম ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করতে। পান্থপথে আমাদের কলেজের ছয়জন একটা বাসায় উঠলাম। আমি, বাহা, শাফায়াত, জামিল, তানিম আর কায়সার। প্রথম কয়েকদিন সবাই খুব ভাব নিয়ে কোচিং-এ গেলাম। ভর্তি পরীক্ষায় কোন ধরণের প্রশ্ন হয় সেটা নিয়ে ব্যপক আলোচনা করলাম। কোন ভার্সিটির পরীক্ষা কখন হবে- সেটার খবরাখবর নিতে লাগলাম। এবং একদিন সবাই লেখাপড়া সম্পর্কিত সবকিছু বাক্সবন্দী করে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

মুমিত ওর কোন এক আত্নীয়ের বাসায় থাকত। আর্মির জন্য কোচিং করত। কোচিং-টা ছিল আমাদের বাসার সামনে। তাই প্রায়সময়ই আসত। আমরা একসাথে কার্ড খেলতাম কিংবা চায়ের দোকানে বসে বসে আড্ডা দিতাম।

আমার আবোল-তাবোল গানগুলো মুমিত খুব মনোযোগ দিয়ে শুনত। নতুন কোন গান লিখলেই আমি আমার খুব কম শ্রোতাদের একজন- মুমিতের কাছে যেতাম। আর খুব লজ্জার ভান করে মুমিতকে বলতাম।
– দোস্ত। একটা গান লিখছি।
মুমিত তার বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা মুখে এনে বলত।
– শোনা।

এরই মধ্যে মুমিত আইএসএসবি’তে চান্স পেল। আমার এখনো মনে আছে আইএসএসবি বোর্ড থেকে বের হয়েই আমাদের বাসায় ছিল। আর আমাদের জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না। আমি বললাম।
– ঐ গাধা, কাঁদিস কেন? তুই তো এখন আর্মি অফিসার। আর্মি অফিসার কাঁদলে কী দেখতে ভালো লাগে?

মুমিতের সাথে শেষ দেখা হলো ওর শেষ জন্মদিনে। একদিন বিকেলে বাসায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি মুমিত সাতটা বার্গার নিয়ে হাজির হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম।
– ব্যাপার কী? হঠাৎ খাওয়া-দাওয়া।
তানিম বলল- আজকে মুমিতের বার্থডে।

৮ নভেম্বর ২০০৫। দুইদিন পর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা। সকাল আটটার দিকে নাস্তা করে সবাই- এতদিনের জমে থাকা পড়াগুলো কিছুটা লাইনে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। এমন সময় তানিমের মোবাইলে ফোন এল। হঠাৎ আমরা তানিমের চিৎকার শুনতে পেলাম। আমরা তানিমের কাছে ছুটে গেলাম। দেখলাম তানিমের চোখ থেকে পানি নেমে প্রায় পুরো মুখটাই ভিজে গেছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল।
– তানিম, কী হইছে?
– দোস্ত। মুমিত মারা গেছে।
সেদিন সকালে- আর্মির জন্য মুমিত বাসার পাশের পুকুরে সাঁতার প্রাকটিস করছিল। সাথে ছিল ওর বড় ভাই। হঠাৎ-ই মুমিত ডুবে যায়। মুমিত বাঁচার জন্য অনেক চিৎকার করেছিল। কিন্তু আশেপাশের মানুষজন তাকে বাঁচাতে সাহস পায় নি। পুকুরটায় ঐ মাসেই নাকি আরো দুইজন ডুবে মরেছে। পুকুরটার দোষ আছে।

মুমিতের কবর- চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ঠিক পাশে। গত বছর ৮ নভেম্বর আমাদের কলেজে অনেকেই চট্টগ্রাম ছিলাম। হয়ত দুই একবার কোন কাজে পাঁচলাইশ থানার দিকে গিয়েছিলাম। কিন্তু মুমিতের কবরের কাছে যাওয়ার কথা আমাদের মনে হয় নি।

মুমিত অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকত। মুমিতের আঁকা ছবি দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যেতাম। মারা যাওয়ার কয়েকদিন মুমিতকে বলেছিলাম।
– দোস্ত। আমার ব্যান্ডের ফার্স্ট এলবামের প্রচ্ছদ তুই আঁকবি।
আমার কেন যেন মনে হয়- মৃত্যুর পরের জগতে মুমিতের হাতের কাছে সবসময় রঙ- তুলি- ক্যানভাস থাকে। যখন ইচ্ছা হয় মুমিত অদ্ভুত সব ছবি আঁকে- যেমন আঁকতে দেখেছি ক্যাডেট কলেজের ছয়টা বছর। পরকালের রহস্যময় জগতে- মুমিতের সঙ্গে আমার দেখা হবে। আমি মুমিতকে জিজ্ঞেস করব।
– দোস্ত। প্রচ্ছদটা আঁকছিলি?
মুমিত তার চির-চারিত বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা মুখে নিয়ে- অসম্ভব সুন্দর একটা ছবি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলবে।
– তোরা আমাকে ভুলে গেছিস। তাই বলে আমিও ভুলে যাব- সেটা ভাবলি কী করে?

[লেখাটা মূলত সচলায়তনের জন্য। তাই ক্যাডেটদের জন্য অনাবশ্যক কিছু কথা চলে এসেছে। সরি। থ্যাঙ্কু]

১,৯৪৮ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “আমাদের মুমিত”

  1. মুমিতের জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সবগুলো মৃত্যুই মন খারাপ করে দেয়। কিন্তু অনেক মৃত্যুর বাস্তবতা সম্বন্ধেই জানতে পারি না। লেখায় মুমিতের চরিত্র আর অন্তর্ধান এমনভাবে ফুটে উঠল যে মনে হল মুমিতকে আমি চিনতাম।

    "তোরা আমাকে ভুলে গেছিস। তাই বলে আমিও ভুলে যাব- সেটা ভাবলি কী করে?"

    শেষ লাইনে এবারও ধাক্কা খেলাম। আমারও মনে হয়, মৃতদেরকে আমরা যতটা মনে রাখি, তারা আমাদেরকে তার চেয়ে বেশী মনে রাখে। কারণ কি হতে পারে? জানি না।

    জবাব দিন
  2. আমারা আমাদের মুমিতকে আরও বেশি করে মিস করব। আমি আমার হারিয়ে যাওয়া কোন বন্ধুকেই সামনা সামনি দেখি নাই, তাই সবার একটা প্রতিচ্ছবি কল্পনা করি। যেটাতে সবাই আমার হীরো...।

    জবাব দিন
  3. যতদূর গেলে পলায়ন হয়,ততদূর আর কেউ পারেনা যেতে...

    মুমিতও পারবেনা।তোর মত কাছের মানুষদের ভালবাসায় ভিজে কাছে কাছেই থাকবে।

    ও যদি কোনদিন দূরে চলে যায় তার দায় আমাদেরই।অন্তত এই ব্যাপারে আমরা নিজেদের দায়ভার যেন আর না বাড়াই।

    মুমিত ভাল থাকুক...

    জবাব দিন
  4. যাক আমরা যে আমাদের চলে যাওয়া বন্ধুদেরকে মনে রেখেছি তাতে বেশ ভালো লাগ্লো।আমরাও যেমন মনে রেখেছি রেজা কে।

    দোয়া করি যাতে ওরা ভাল থাকে।
    আর এইটা ঠিক যে আমরা তাদের ভুলে গেলেও তারা আমাদের দিকে ঠিকি চেয়ে আছে।

    জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    সেটাই ছিল আমার কাঁধে মুমিতের শেষ হাত রাখা। মুমিত আমার বন্ধু ছিল। মুমিত আমার ভাই ছিল।

    পড়তে পড়তে এই লাইনে এসে বুকের মধ্যে একটা হ্যাচকা টান লাগল। বন্ধু ছিল মানে কি? এক অজানা আশঙ্কায় আস্তে আস্তে আগে বাড়তে থাকলাম। আর ঝাপসা চোখে আবিস্কার করলাম আমার আশঙ্কাটা সত্যি হয়ে উঠেছে!!
    কি যন্ত্রণা, কি যন্ত্রণা.........

    আল্লাহ মুমিতকে ভালো রাখুন।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  6. কিরে ভাইরা তোমাদের হয়েছেটা কি? খালি মন খারাপ করে দাও? আর এক অজানা আতংকের দিকে ঠেলে দাও....আল্লাহ্ যেন কোন দিনও আমাকে এই পরিস্থিতির মধ্যে না ফেলে...তার আগে যেন আমিই.....হয়ে যায়।

    জবাব দিন
  7. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    এক গ্রুপে থেকে আই এস এস বি'র ৪ টা দিন পার করেছি...
    এক সাথে গ্রীন কার্ডের আনন্দ ভাগাভাগি করেছি...
    যখন মেডিকেল চলে...শেষ দিন ও আসে নি, ভেবেছিল মেডিকেল হবে না ঐ দিন কারন আগের দিন বলে দিয়েছিল, হঠাৎ করেই ঐ দিনই হওয়ায় ও খবর পায় নি, আমি ওকে ফোন করে খবর দিলাম...যাবার সময় বলে গেল...থ্যাঙ্কস দোস্ত...তোর জন্যই এক দিন আগে বাড়ী যেতে পারব...দেখা হবে বিএমএ তে......
    খবর টা শুনে সবার প্রথমে ওর নম্বরেই ফোণ দিলাম......
    এক সাথে যাওয়া হল না রে মুমিত...

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।