ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে সকালে ঘুম থেকে উঠে পিটিতে যাওয়া। আমি তার ব্যতিক্রম নই। সকালে এত আরামের ঘুম রেখে কার পিটিতে যেতে ভাল লাগে? যদিও সেপ্টেম্বর মাসের রাজশাহীর গরমে রাতের ঘুম কতটুকু আরামের সেটা বলাই বাহুল্য। মরার উপরে খাড়ার ঘায়ের মত আছে লোডশেডিং। কারেন্ট গিয়ে ফ্যান পুরোটুকু থামার আগেই তিন হাউজ থেকে তারস্বরে চিৎকার শুরু হয়
এএএএএ শাজাহান ভাই, জেনারেটর ছাড়েন
যদিও তারিক বা কাসিম হাউজের চিৎকার শাজাহান ভাই পর্যন্ত পৌঁছায় না, খালিদ হাউজের পিছনেই জেনারেটর রুম, আমাদের চিৎকারই শাজাহান ভাই শুনলে শুনতে পেত মনে হয়।
গত রাতে যদিও একবারও লোডশেডিং হয় নি, কিন্তু এই গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এখন জেপি নেই, জেপিশিপ এখনও দেয় নি। মানে ক্লাস ইলেভেনের সবাই এখন জেপি। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর। কথায় আছে মনের জেপিই বড় জেপি। সাধারণত ক্লাস ইলেভেন যেকোন রুটিন ফলিনে যায় ক্লাস ১২ এর সামান্য আগে। মাঝেমধ্যে একসাথে, মাঝেমধ্যে পরে। নিজেদের লর্ড ভাবলে যা হয় আর কি! ক্লাস ১২ ব্যাপারটা দেখে, দেখে কিছু হালকাপাতলা কথা হয়, শেষে আবার যা ছিল তাই। একাদশ শ্রেণী যেভাবে চলিতেছিল সেভাবেই চলিতে থাকিবে, ইহাই ধ্রুব সত্য। পিটিতে এখন ক্লাস ১১ লেট করে না বললেই চলে, প্রথমদিক তো! মারাত্মক হোপলেস ক্যাডেটও এখন মারাত্মক হোপফুল। যদি হয়ে যায় আর কি! পিটিতে লেট না করলেও পিটিতে ভালমত পিটি করতে ক্লাস ১১ এবং ১২ সবারই মারাত্মক অনীহা। কোনমতে দুই চক্কর দৌড়ে এসে সিনিয়র গ্রুপের পিছনে রেস্ট পজিশনে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাবখানা এমন যে ৪ বছর তো অনেক করলাম, এখন নাহয় ২ বছর একটু আরাম করি। ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে পিটি করা। আমি আবার ব্যতিক্রম থাকব কেন? কোনমতে রেস্ট পজিশনে ঝুলে ঝুলে দাঁড়িয়ে থেকে পিটি শেষ করে পিটি ব্রেক অফের হুইসেল শুনতেই ঊর্ধশ্বাসে হাউজের দিকে দৌড়। গোসলের সিরিয়াল ধরতে হবে, তারচেয়ে বড় কথা ২ নাম্বার বাথরুমের সিরিয়াল দিতে হবে। ২ নাম্বার বাথরুমের ঝর্ণা দিয়ে পানি বেশি পড়ে, বাকী দুইটা অত সুবিধার না।
ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং হলে যাওয়া যতটা কঠিন, তারচেয়ে কঠিন হচ্ছে বাটলার ভাইয়ের নোটবুক এড়িয়ে ডাইনিং হলে ঢোকা। এই লোকের আসল কাজ হচ্ছে খাবার পরিবেশন ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখভাল করা। উনি এই কাজ বাদে নাম লেখায় বিশেষ পারদর্শী। ডাইনিং এ লেট করে আসার জন্যে নাম লেখা, পরোটা হাত দিয়ে খাওয়ার জন্য নাম লেখা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনমতে বাটলার ওরফে নজির ভাইয়ের নোটবুক থেকে রক্ষা পেয়ে ডাইনিং এ ব্রেকফাস্টে বসা গেল। ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে ব্রেকফাস্টে ব্রেড খাওয়া। পরোটা প্রতিদিন দিলে ক্যাডেট প্রতিদিনই পরোটা খাবে। আজকে ব্রেকফাস্ট নিয়ে কোন মনঃকষ্ট নেই। পাশের ক্লাস সেভেন দেখি হালকা ওয়াক ওয়াক করছে, বমি ঠিক করে নি, কিন্তু বমি করার ঠিক আগের মুহূর্তের করসৎ। সময় কত দ্রুত যায়।
ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে একাডেমিতে মার্চ করে যাওয়া-আসা করা। কি সুন্দর একটা শেড আছে, যেটা শুধু বৃষ্টির সময় ব্যবহার হয়। ঐ শেড দিয়ে আসা-যাওয়া করলে কি সমস্যা সেটাই বোধগম্য না। ক্লাস নাইনে থাকতে একই বই দুই বছর পড়তে হবে এই চিন্তায় ক্লাস টেনে ব্যাপক টানাটানি পড়ে গিয়েছিল। এখন সেই কাজ করলে একদম ধরা খেতে হবে। এই চিন্তায় কোনমতে ক্লাসে মনযোগ বসানোর চেষ্টা করে সবাই। মিনিট দশেক পরে দেখা যায় জনাকয়েক ক্যাডেট বাদে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যে কয়জন জেগে থাকে তার মধ্যে কিছু হোপফুল ক্যাডেটও থাকে, যদি হয়ে যায় আর কি! “এই বছর কোনমতে পার করে পরের বছর পড়ব” এই দলের লোকজনের সংখ্যাও নেহায়েৎ কম না, কিন্তু এর মধ্যেও কিন্তু আছে। যারা বোঝে যে এই দলে পড়ে গেলে একদম ধরা খেতে হবে, কিন্তু তারা “কালকে থেকে শুরু করব পড়ালেখা”র দলে পড়ে যায়। এই কালকে টা আর কখনো আসে না। এই কালকের অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লাস ইলেভেন শেষ হয়ে যায়। ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে ক্লাস শেষে লাঞ্চে মার্চ করে যাওয়া। জুনিয়র স্কোয়াডের প্রপারলি মার্চ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ পিছনে জেপি থাকে। এখন যদিও জেপি নেই, কিন্তু প্রত্যেকটা ক্লাস ইলেভেনের ক্যাডেটই এখন জেপি। অঘোষিত জেপিদের ছড়াছড়ি এখন। জেপিরা সাধারণত জুনিয়র স্কোয়াডের পিছনে পিছনে যায়, কিন্তু এই সময়ে দেখা যায় কিছু অতি উৎসাহী একাদশ শ্রেণীর ক্যাডেট জুনিয়র স্কোয়াডের পিছন পিছন হেঁটে হেঁটে যায়। ভাবখানা এমন যে “আমরা তো গল্প করতে করতে চলে গিয়েছিলাম”। কিন্তু মনের মধ্যে যে সুপ্ত এক ফিতার বাসনা ঘুরপাক খায় সেটা বুঝতে কারো বাকী থাকে না। সে সময়ের এডজুটেন্ট ছিল বেশ কড়া। বেশ বলতে ভালই কড়া। উনার একটা লাল রঙের গাড়ি ছিল। যেটা ১১০ একর দূর থেকে দেখা যেত। একাডেমি থেকে মার্চ করে ডাইনিং এর দিকে সবাই যাচ্ছে, ঠিক এ সময় দেখা গেল সেই লাল টুকটুক গাড়িটা প্রিন্সিপাল বাংলোর সামনে দিয়ে আসছে। সেকেন্ডের মধ্যে দেখা গেল সবাই মার্চ করছে। অযথা থাপ্পর খাওয়ার কোন মানেই হয় না। পরে দেখা গেল গাড়ির মধ্যে এডজুটেন্ট নেই। গাড়ি চালাচ্ছিল শফিক ভাই।
ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে চুপচাপ বোরিং টেবিল। টেবিল হবে প্রাণবন্ত। ডাইনিং টেবিল হচ্ছে গুজবের কারখানা। ওমুক স্যারের পোস্টিং হয়ে যাবে, নতুন প্রিন্সিপাল আসবে, এডজুটেন্ট বেশীদিন থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্লাস ১২ এইসব টেবিলে বসে গল্প করত, আর টেবিল থেকে এইসব গুজব ছড়িয়ে যেত প্রত্যেকের কাছে। ক্লাস ১২ এসব বলার সময় বেশ জ্ঞানী একটা ভাব ধরত, যেন এডজুটেন্ট তার বদলীর খবর তার সাথেই আলাপ করেছে। ক্লাস ১১ আবার তার মধ্যে তাদের অল্প বয়সে পেকে যাওয়া মন্তব্য করত। যেন ইহজগতের সকল বিষয়ের জ্ঞান তার হাতের মুঠোয়। ইহজগতের সকল জ্ঞান তার হাতের মুঠোয় থাকলেও রসায়ন প্রথম পত্র বইয়ের ন্যূনতম জ্ঞান তার মধ্যে অনুপস্থিত। সমস্যা নেই, কাল থেকেই পড়ালেখা শুরু হবে।
ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে আফটারনুন প্রেপ। ভাত ঘুমের সময়টা নষ্ট করে এসব নষ্টামি কার ভাল লাগে? কোনমতে আফটারনুন প্রেপে গিয়ে শুরু হয় ভাতঘুম দ্বিতীয় পর্ব। গেমসের সময় আকাশটা মেঘলা ছিল। গেমস শুরু হবার পরে সিএসএম স্টাফ হঠাৎ বলে উঠল, “এএএই আমি বাঁশি দিব, বাঁশি দিলে বৃষ্টি নামবে, বৃষ্টি নামলে সবাই হাউজে দৌড়ে ছলে যাবে”। আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে গানটা যে লিখেছিল সে যদি এই স্টাফকে চিনত তাহলে কষ্ট করে আর গান লেখত না। এক বাঁশিতেই কাজ হয়ে যেত।
ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে স্যান্ডো গেঞ্জি আর মোজা পড়া। ইভিনিং প্রেপ আর নাইট প্রেপে ১১শ আর ১২শ শ্রেণীর ক্যাডেটরা এই দুই জিনিস এড়িয়ে চলে। অনেকে ধরা খায়, অনেকে খায় না। যারা ধরা খায় না তারা মোটামুটি মহামানব শ্রেণীতে পড়ে। কিছু ক্যাডেট আছে যারা জুতাটাও অনেক কষ্টে পড়ে। জুতাটাকে খড়ম বানিয়ে খটাস খটাস করে হাঁটে। তারা মহামানবের থেকে এক শ্রেণী উপরে। টিচাররাও তাদের আর কিছু বলেন না, কারণ তাদের পিছনে বাক্যব্যয় করা অনর্থক। এর চেয়ে গাছকে কথা বলা শেখানোর চেষ্টা করা সহজ।
ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে রাতের বেলা লাইটস অফের পরে নাইট ডিএমের ঘোরাঘুরি। কেন লোকটা ঘুম নষ্ট করে অযথা হাঁটাহাঁটি করছে? ১১শ আর ১২শ শ্রেণীর দিন শুরু হয় রাত ১১ টার পরে। লকারের নীচের চিপা আরও অনেক সৃজনশীল উপায়ে লুকানো জায়গা থেকে বের হয় নোকিয়া ১১০০ মডেলের হ্যান্ডসেট। ১১ টার পরে শুরু হয় তাদের কথা। সারাদিন কি কি করল সেই কথা, সারাদিনে কি কি খেল সে কথা, কোন স্যার কিভাবে কথা বলে সে কথা, ওপাশ থেকে হাসির শব্দ আসে, মনে হয় এই হাসির জন্য জীবন দিয়ে দেয়া যায়। ওপাশের মানুষটি মনে হয় জানেও না এপাশের মানুষটা কত কষ্ট করে কত ঝুঁকি নিয়ে তার সাথে ৫ মিনিট কথা বলার জন্য জেগে আছে। তার সাথে কথা বলার জন্য এপাশের মানুষটার আগামীকালের পিটি মাফ নেই, ক্লাস মাফ নেই, কিছুই মাফ নেই বরং ধরা খেলে অনেক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তবুও ছেলেটা সারাদিনে একবার তার কন্ঠ শোনার জন্য জেগে থাকে। বেশি না, মাত্র ৫-৬ মিনিটের কথা বলা। ওপাশের মানুষটা কি জানে যে ক্যাডেটদের একটা অপছন্দের জিনিস হচ্ছে সকালে ঘুম থেকে উঠে পিটিতে যাওয়া?
অসাধারণ অপছন্দের লেখা 😛
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
অনেক দিন পর কলেজে ফিরে গেলাম। আহা এ লেখাটা আগে চোখে পড়েনি কেন?
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
ভালো লেখা হয়েছে, ভাই।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য