২০০২ থেকে ২০০৮।আমার ক্যাডেট লাইফ।ভালোয় মন্দে মিশিয়ে কেটেছে জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এই ছয়টি বছর।যেকোন ক্যাডেটের এই ছয়টি বছর কাটে অনেক ঘটনাবহুল।আমিও ব্যাতিক্রম না,মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ক্যাডেট লাইফ একটু বেশিই উরা-ধুরা।কলেজের গল্প করতে কার না ভালো লাগে?ছয় বছরের ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে আমার এই সিরিজ ‘ক্যাডেট কলেজ কড়চা’।আগেই বলে নেই ঘটনাগুলো ক্রমানুসারে সাজানো নয়।যেটা আগে মনে আসবে সেটাই লিখবো আগে।
আমাদের (২০০২-০৮) ছয়টি বছর কেটেছে আফসোস করতে করতে।আমরা কলেজে গিয়েই শুনেছি বের হয়ে যাওয়া ব্যাচগুলোর দুর্ধর্ষ কাজকর্মের কথা,শুনেছি কলেজ পালিয়ে মরডান মোড়ে গিয়ে শাবনুরের সিনেমা দেখে পুষ্টির মিষ্টি নিয়ে কলেজে ফেরার কথা,শুনেছি আগের এক্স ক্যাডেটদের বীরের মতো জুনিয়র পিটানোর কথা।তারা নাকি জাম্বুরা,কাঁঠাল,পেয়ারা এমন কোন ডাল নেই যা দিয়ে জুনিয়র পিটায় নাই।আমরা না পারছিলাম আগের ক্যাডেটদের মতো দুঃসাহসী হালাকু খাঁ হতে, না পারছিলাম এখনকার ক্যাডেটদের মতো কলেজে বসে ট্যাব বা স্মার্টফোন ব্যাবহার করতে।অর্থাৎ দুইদিকেই আমরা মাইনাস।আর সবার কথা জানিনা আমার এই ব্যাপারগুলো নিয়ে একটা গোপন কষ্ট ছিল।ছোটবেলায় অনেক বাঁধা নিষেধের মধ্যে বড় হয়েছি বলেই হয়তো ক্যাডেট কলেজ ছিল আমার জন্য মুক্ত স্বাধীন এক জগত।টাইট বেল্ট,চকচকে জুতোর চেয়ে সাদা শার্টের প্রথম বোতাম পর্যন্ত ঢিলেঢালা টাই,কনুই পর্যন্ত গোটানো পাঞ্জাবিই আমাকে বেশী আকৃষ্ট করতো।
সেভেনে গিয়ে আমার রুমমেট পেলাম টাঙ্গাইলের শাহরিয়ার,জামালপুরের আমিন আর শেরপুরের সালাহউদ্দিনকে(তিনজনই এখন বাংলাদেশ আর্মির গর্বিত অফিসার) ।আমাদের চারজনের বাড়ি কাছাকাছি হওয়াতে বোঝাপড়াটাও ভালো হয়।অল্প কয়েকদিনেই অনেক কাছের মানুষ হয়ে যাই চার জন।প্রথম টার্ম ছিল ৭ দিনের,কিছু বুঝে না উঠতেই শেষ।ডাইনিং হলে ঢুকতেই একটা বোটকা গন্ধ ছাড়া খারাপ লাগার মতো আর কোন ঘটনা ঘটেনি ততোদিনে।গন্ধের কারণেই হোক বা খাবারের কারণেই হোক ক্লাস সেভেনের ক্যাডেটরা ডাইনিং এ খাবার শুরু হবার কিছুক্ষনের মদ্ধেই দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে দৌড় দিতো বাইরের দিকে।বমির প্রচণ্ডতার কারনে এক ক্লাসমেটের নামই হয়ে গেল “বোমারু”।ক্লাস সেভেন নিয়ে বলা শুরু করলে আমি আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত্রিকেও হার মানাতে পারবো।আজকে দুইটা ঘটনা বলি সেভেনের।
সাতদিনের টার্ম শেষ সেকেন্ড টার্মে আমরা।ঐ টার্মেই বুঝে গেলাম পিকচার আভি বাকি হ্যায়।ততদিনে আমাদের উপর সিনিয়র এবং স্টাফদের সমন্বয়ে কড়া ডোজে বুলডোজার চলছে।নভিসেস ড্রিল এর প্র্যাকটিসে স্টাফদের সীমাহীন পাঙ্গা আর হাউজে এসে গাইড বা অন্যান্য ক্লাস এইট এর ভাইয়াদের হাতে মাইর।আর উপরি হিসেবে ফলিন করে ডাইনিঙে যাবার সময় পশ্চাৎদেশে পেছনের ক্লাসমেটের লাত্থি খাওয়া।এইট এর ভাইয়ারা বলতেন “অমুক প্রপার হাইট” আর এই প্রপার হাইটের প্রপার লাত্থিটা এসে আঘাত করতো সদ্য বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করা আমাদের কচি মন আর খাকি পড়া পাছায়।আমার গাইড ভাইয়া ছিলেন সাদা মনের মানুষ,কিছুই বলতেন না প্রথম প্রথম।শুধু শারীরিক শাস্তি দিয়েই বোঝাতে চাইতেন যে কত ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।বারবার বুঝিয়ে যখন উনার মনে হলো যে আমি বুঝার পাত্র না,উনি হার্ড লাইনে গেলেন।আমাকে হ্যান্ডস ডাউন করিয়ে পাছার উপর হ্যাঙ্গার চালালেন,এক বার ধপ করে শব্দ,তারপরই নিস্তব্ধতা।ততোখনে ভেঙে গেছে আমার গাম্বুস সাইজের মোটা হ্যাঙ্গারটা।আমি অবশ্য ততোটা ব্যাথা পাইনি কারণ মারার আগে ভাইয়া আমার পশ্চাৎদেশে দুই ভাঁজ করা টাওয়েল বিছিয়ে নিয়েছিলেন যাতে আমার কষ্ট একটু কম হয়,আগেই বলেছি আমার গাইড ছিলেন একদম সাদা মনের মানুষ।
এরকম ঘটনা দুর্ঘটনার মাঝেই শেষ হয়ে গেল সেকেন্ড টার্ম।আমরা তখন অনেক অভিজ্ঞ।হ্যাঙ্গার ছেড়ে আমরা তখন লকার স্টিকের মাইর খাই,বমি তো দূরের কথা মাঝে মাঝে সিনিয়রদের চেয়েও বেশী খেয়ে ফেলি ডাইনিং এ।আসলেই পেটে খেলে পিঠে সয়।আমার রুমমেট আমিন ততোদিনে ভাইয়াদের মোজার বল বানাতে বানাতে একে প্রায় আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।সেকেন্ড টার্মের টার্ম এন্ড নাইটে আমাদেরও খেলতে ইচ্ছে হলো।হাউজ বেয়ারা মফিজ ভাইকে এক প্যাকেট বিস্কুটের মাধ্যমে হাউজ অফিস থেকে জোগাড় হলো ব্যাট।রাত বারোটা বাজতেই জানালায় কম্বল টানিয়ে,দরজায় লকার ঠেস দিয়ে শুরু হলো খেলা।আমরা তখনো জানিনা যে টার্ম এন্ড নাইটে আসলে কেউই ঘুমায় না।খেলা শুরু হবার আধা ঘণ্টা যেতে না যেতেই দরজায় কড়া নাড়লেন অ-তিথির অতিথি।এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে দরজা কিভাবে খুলতে হয় সেটাই মনে করতে পারছিলাম না।কয়েক মিনিট পর ছিটকিনি খুলে দিলাম আর দেখলাম দাঁড়িয়ে আছেন অলটারনেট ব্যাচের সবচেয়ে ভয়ংকর ভাইয়াটি।
রুমে ঢুকে বিছানা সরানোর প্যাটার্ন দেখেই বুঝতে পারলেন যে উনি ইডেন গার্ডেনে দাঁড়িয়ে আছেন।ক্লাস সেভেন রাতের বেলায় কম্বল টানিয়ে ক্রিকেট খেলছে,এটা দেখে উনার রাগ বিহ্বলতায় রুপ নিল।এই ভাইয়ার স্বভাব ছিল যখনই কোন জুনিয়রের সাথে কথা বলতেন উনার হাত থাকতো জুনিয়রের গালে।দুই হাতে সমানে চড়াতেন আর কথা বলতেন।(আমাদের ব্যাচই ছিল উনার চড় খাওয়া লাস্ট ব্যাচ।একটা দুর্ঘটনার পর উনি আর কাউকে থাপ্পড় দেননি কোনদিন।সেই ঘটনায় একটু পর আসছি।)ভাইয়া বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে ব্যাট আর বল নিয়ে চলে গেলেন।যেতে যেতে বললেন “আগামী টার্মে প্রস্তুত হয়ে এসো,আই মাইসেলফ ইজ এনাফ টু মেক ইউর লাইফ হেল”।এই ইংরেজি থ্রেট খেয়ে বুঝলাম আমরা শ্যাষ।ছুটিটাও ভালো কাটলোনা,সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করি কি যে হবে এবার কলেজে গেলে।
তা এভার বলি ভাইয়া কেন চড় থাপ্পড় মারতে মারতে কথা বলা বন্ধ করলেন।আমার এক ক্লাসমেট সর্দিজ্বরে আক্রান্ত। দুপুরবেলা বাথরুমে যাচ্ছিল গোসল করতে।এক হাতে টাওয়েল আরেক হাতে সোপকেস।ভাইয়া তার রুম থেকে ডাক দিলেন R****N রুমে আসো।রুমে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন ব্লেড আছে?ক্লাসমেট বললো জি না ভাইয়া নেই।ভাইয়া ওকে দুই হাতে চড়াতে চড়াতে জিজ্ঞেস করলেন নেই কেন?গাইড বলে নাই ব্লেড আনতে?আমার বন্ধুটি নাকের মধ্যে একটা সুড়সুড়ি পাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলো যে ভাইয়া যদি চড় মারা না থামায় তবে বিপদ অতি আসন্ন।কিন্তু দুই ক্লাস সিনিয়রকে এই কথা বলতেও সাহস লাগে।তো যা হবার তাই হলো,তীব্র বেগে লিম্ফোসাইট মেশানো নাকের হলুদ জলে লেপটে গেলো ভাইয়ার হাত।সেই কুক্ষণে ভাইয়া মনে হয় পণ করেছিলেন “থাবড়াতে থাবড়াতে কথা আর না আর না”।
এই ভাইয়া আমরা ক্লাস এইটে ওঠার পর কোন এক কারণে কলেজ আউট হয়ে যান।এতো চড় থাপ্পড় খেয়েও ভাইয়ার চলে যাবার কথা শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।
ও হ্যা আরেকটা কথা,ভাইয়া সেই টার্ম এন্ড নাইটের ক্রিকেট খেলার কথা কাউকে বলেননি।নিজেই হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন,তাই পরের টার্মে আর কোন ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়নি এই ঘটনা নিয়ে।তাদের ব্যাচের কাছে আমরা প্রহৃত হয়েছি আরও অনেক পরে,উনারা ইলেভেনে ওঠার পর।সেই ঘটনা নাহয় অন্য আরেক দিন
বলি।
ব্যাপক লিখেছেন ! :thumbup: সিরিজ খানা তাড়াতাড়ি এগিয়ে নিয়ে যান! নেক্সট পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ...
ধন্যবাদ।এক্সাম শেষ অতি দ্রুত লিখে ফেলব 🙂
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।
অসাধারণ লাগলো ভাই...। আরও নতুন লেখা চাই
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
ধন্যবাদ 🙂
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।
টাওয়েল বিছাইয়া মারত??? 😉 😉 😀 😛 :))
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
আরে ব্যাটা ঐটা এক্সপেরিমেন্টাল :))
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।
টাওয়েল বিছাইয়া এক্সপেরিমেন্টাল, ফাইনাল কি বেডে? 😀
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
x-( x-(
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।
দারুণ হচ্ছে। সিরিজ চলুক।
ধন্যবাদ 🙂
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।
:)) :))
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
ভাই কথা কিন্তু সত্য 😀
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।
ডাইনিং হলের দুর্গন্ধের ব্যাপারটা বুঝলাম না।
আমরাও সময় সময় পাথর মেশানো ভাত,
গন্ধওয়ালা ভাত,
হালকা ফাকুন্দা পড়া ব্রেড খাইছি
কিন্তু তাই বইলা
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
রাজীব ভাই গন্ধটা হয়তো দুর্গন্ধ ছিলোনা কিন্তু ক্লাস সেভেনের কাছে জায়গাটা নতুন হওয়াতে অপরিচিত গন্ধটাকেই দুর্গন্ধ মনে হতো। 🙂
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।