যুদ্ধের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে টের পেতে লাগলাম । এলাকায় পাক আর্মি যেমন তাদের লোকবল বৃদ্ধি করতে লাগলো, সাথে সাথে মুক্তি বাহিনী ও দিন দিন শক্তিশালী হতে লাগল। বাঙ্গালী বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিমের নেত্রীত্বে মানিকগঞ্জ ,তাল তলা এলাকায় ভয়াবহ সম্মুখ সমরে নাকানি-চুবানি শুধু নয় প্রকৃত অর্থেই ওরা ‘পানিতে চুবানি’ খেতে লাগলো ।
বাজার ঘাটে গানবোটের সমারোহ বাড়লো । মুক্তি বাহিনীর ভয়ে থানার ঘাটির আশে পার্শের বাজার, দোকানপাট জ্বালিয়ে ওরা surrounding perimeter পরিষ্কার দৃষ্টিগোচরে নিয়ে আসল। যুদ্ধের আবহে গ্রামের মানুষ আতংকে দিন কাটে ।খামাখা গোলাগুলি , লোকজন ধরে বেধড়ক পেটানো চলতে লাগলো। সপ্তাহ দশ দিনেই হঠাৎ এই অভাবানিয় পরিবর্তন !
ঠিক এক সপ্তাহ পর আবার আসলো আর্মিরা আমাদের বাড়ীতে । as usual , কেউ নেই ! বাড়ীর মসজিদের বৃদ্ধ নোয়াখালীর ইমাম সাহেব ছাড়া সারা বাড়ী শুন্য ! এবার শুধু অল্প বয়স্ক অফিসারের ( সম্ভবত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হবে) নেতৃত্বে কিছু জওয়ান ও রাজাকার এসেছে। চেয়ারম্যন সাহেব ঢাকা থেকে এখনো ফেরেন নাই বলে বাড়ী জ্বালিয়ে দিতে হবে।হুকুম ।
সারা বাড়ী তল্লাশির ফাঁকে ফাঁকে ইমাম সাহেবের সাথে কথোপকথনে এই অল্প বয়স্ক অফিসার সাহেব বাঙ্গালী, এবং তার বাড়ী নোয়াখালী হুজুরের বাড়ীর কাছে পিঠে কোথাও প্রকাশ পায়।তাই সে দয়া পরবর্শে ইমাম সাহেবকে আরও এক সপ্তাহের সময় দিয়ে ফেরত যান। সাথে সাথে পরের সপ্তাহে হাজির না হলে ওর আর কিছুই করার থাকবেনা বলেও ওয়ার্নিং দিয়ে যান ।
আমরা আবার সকলে বাড়ী ছাড়া। এবার নদীপথে মাইল ৫-৬ দূরে নানা বাড়ী ‘কলাকোপা’। পার্শ্ববর্তি নবাবগঞ্জ থানায় বিখ্যাত খ্রিস্টান অধ্যুষিত বান্ধুরার কাছে।
গ্রামের নাম সাদাপুর। ইসামতি নদী ঘেঁসে এই জনবসতী।নদীর এতো কাছে যে রান্না ঘর থেকে নদী সাকুল্যে দশ হাতও দূরে হবে না। এদিককার সব বাড়ীর Toilet গুলো নদীর উপরে।চারটা খুঁটির উপর টিনের মাচান করা ছোট্ট একটি ঘর। নিচে তাকালে নদীর ঘোলা পানি।খুবই ইন্টারেস্টিং ।
সারেং বাড়ী। নানাদের পূর্ব পুরুষরা সমুদ্রগামি জাহাজের navigator, বাংলায় সারেং বা সুকানি ছিলেন, তাই বাড়ীর নাম সারেং বাড়ী।
এখানে মাস খানেক অবস্থানে উল্লেখ যোগ্য এমন বিশেষ কিছু নেই, শুধু মাঝে মাঝে গান বোঁট যাতায়াতের সময় নদীর দুই পাড়ের দিকে লক্ষ্যহীন ঝাকে ঝাকে গুলি বর্ষণ এবং আমাদের পূর্ব থেকেই একটি মাটির ঘরের পেছনে আশ্রয় নেয়া, সবই গাঁ সহা হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি মাঝে মধ্যে ভেসে আসা পিছ মোড়া করে হাত বাঁধা মৃদু ঢেউ এ দোলা লাশ গুলিও ।মাথা পানির নিচে শুধু দু হাত বাধা পীঠের অংশ ও পেছনটুকুই নদীতে ঢেউ এর দোলায় ভেসে যেতে দেখা যেতো । কারোরই আগ্রহ দেখিনি লাশ তুলে সৎকার করার। এতই গাঁ সহা হয়ে গিয়েছিল ব্যাপার গুলি।
(চলবে)
কয়েকদিন ঢাকার বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম ভাইয়া। এসেই এক বসায় আপনার শেষ পাঁচটা পর্ব পড়ে শেষ করলাম। প্লিজ দয়া করে ভাববেননা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলির কথা জানার আগ্রহ আমাদের নেই।এত গুরুত্বপূর্ণ লেখায় কমেন্টে কি লিখবো ভেবে সাহস পাইনা, তাই কমেন্ট করা হয়ে ওঠে না।কিন্তু আপনার প্রত্যেকটা পর্বের জন্যই অধীর হয়ে আগ্রহ করছি।তাড়াহুড়া করে শেষ না করে যেভাবে লিখছেন সেভাবেই চালিয়ে গেলে খুব খুশি হবো ভাইয়া।শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, তার পরের ইতিহাসটুকুও।
আর আমি ভাবছিলাম আপনার লেখাটা শেষ হলে সবাই মিলে সিসিবি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা যায় কিনা এটাকে ই-বুক হিসেবে প্রকাশ করতে...
ভালো থাকবেন।
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
ধন্যবাদ ভাই। এটাতো আসলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়। ওই সময়ে আমাদের "পালায়ন বৃতান্ত "। এই আফসোস থেকে কক্ষনোই পরিত্রান পাবো না, কেন আমরা আর বছর পাঁচেক বড় হইনি?? নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসে মরেছি শুধু !!
Smile n live, help let others do!
(সম্পাদিত)
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
আগের লেখাগুলোর মতই গা ছমছমে...
আপনার এই সিরিজটা খুব-ই আগ্রহের সাথে পড়ছি।সময়ের অভাবে মন্তব্য করা হচ্ছিলোনা।
কোন কোন ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ বিস্মিত করে আমাকে, এত সতেজ।
লেখাগুলো যদি একটু দীর্ঘ করতেন কষ্ট করে, খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায় একেকটা কিস্তি।
আর বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই কিছু বানানভুলের কথা।যেমন: বোট (বোঁট নয়), গা সহা (গাঁ সহা নয়)।
আগের একটা পর্বতেও দেখেছিলাম বাংলায় কথা বলা একজন পাকিস্তানি অফিসার, আর এ পর্বে একজন খোদ নোয়াখালির অফিসার, এদের পরিচয় কি জানা যায়? আমার বেশ আগে থেকেই এ ব্যাপারে একটা কৌতুহল ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতজন বাঙ্গালী আমাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছিল।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
(সম্পাদিত)
Smile n live, help let others do!
আগের পর্বের ওই বাংলা বলা জুনিয়র অফিসারই 'নোয়াখালি বাড়ী' বাঙ্গালী অফিসার! ওঁর পরিচয় আর জানা যায় নাই, কিন্তু ওঁর কাছে আমরা পরিবারের সকলেই কৃতজ্ঞ।( আমাদের বাড়ীটি না জ্বালিয়ে রক্ষা করার জন্য )
Smile n live, help let others do!
আজিজ ভাই আপনার সিরিজটি প্রথম থেকে একটানে পড়ে শেষ করলাম। অসাধারন বললেও কম বলা হবে। :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff: আপনার কাছে একটাই অনুরোধ সিরিজটি যতটুকু সম্ভব বড় করবেন। আমরা আজ আপনার চোখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা দেখতে চাই.........
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
বিষদ বর্ণনা করলে এর তিন/ চার গুন হয়ে যেত । কত কিছু যে বাদ পরে যাচ্ছে ! শুধু যে গুলি না লিখলে আমার দেখাটা অসম্পূর্ণ বলা হবে, সেই গুলিই লিখছি।বড় সমস্যা হোল আমার বাংলা লিখায়, (এক আঙ্গুল দিয়ে ) আর বাংলা বানানে। ইশ যদি একটা সেক্রেটারী থাকতো !
Smile n live, help let others do!