আমার ক্যাডেট কলেজের স্বর্ণালি দিনগুলি- (ছয়)

আজিজুল হাকিম, এফ সি সি/১৯৭২~৭৮

আমাদের গিয়াস । ফর্সা’ একহারা ময়নার মার সদা হাসি খুশী ‘ময়না’। রবীন্দ্র ভবনের আমাদের সহপাঠী বন্ধু টি। ওর মা তৎকালীন বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম এর সব চেয়ে জনপ্রিয় ” আলেখ্য অনুষ্ঠান ” এর প্রিয় চরিত্র “ময়নার মা” পরিচালনা করতেন বলে ওর এই নাম।কোন দিন কারো সাথে ঝগড়া বা ঝুঁট ঝামেলায় জড়িয়েছে বলে শুনিনি। সবার প্রিয়, শান্ত শিষ্ট মানুষ। সেই যে একদিন খবর এর শিরোনাম হবে, কে জানতো ? সম্ভবত আমরা তখন ক্লাস এইটে। সপ্তাহে একটি দিন গামেস এর সময় ক্লাব এক্তিভিটিজের সুযোগ পাই। ‘আর্ট ক্লাব, ড্রামা ক্লাব, এই ক্লাব, সেই ক্লাব, কারো ওই দিকে নজর নাই। সবার লক্ষ্য ” ক্যান্ও ক্লাব “।একমুখী প্লাস্টিক চেয়ার ফিট করা সরু বিদেশী ছিপ নৌকা । শুধু দুই জন ধারনোক্ষম , ছোট হালকা বৈঠা দিয়ে বাইতে হয়। বিলেতের হ্রদ গুলিতে যেমন দেখা যায়।অত্যন্ত দ্রুতগামী ।শুধু মাত্র সাঁতারে পারদর্শীরাই ক্যান্ও ক্লাবে যোগ দিতে পারতো। আর এই স্বপ্নের ক্যান্ও ক্লাবে নাম লিখানোর জন্যে একটু আধটু মিথ্যা বলা জায়েজ ছিল।বন্ধুরা সবাই জানতো ।

যাহোক ওই দিন ক্লাব ডে , সকলেই উত্তেজিত । আর ডিউটি মাস্টার ও নরম মানুষ পড়েছে।আমাদের খুশী আর ধরে না। গেইম্স ড্রেসে সবাই ডবল মার্চ করে কলেজ গেইট দিয়ে বেরিয়ে দিঘী পর্যন্ত যাই।বিশাল দিঘী। কেবলই নতুন করে সংস্কার এর জন্যে কাটা হয়েছে। দীঘির পাড়ে সারি সারি “ক্যানো” সাজানো। কলেজ গেইট এর বাইরে বেরিয়েই আর কে কার কথা শুনে ! সবাই ঝাপিয়ে পড়লো কে আগে “ক্যানো” দখল করতে পারে। দশ-বারোটি “ক্যানোর” জন্যে সকলের কাড়া কাড়ি।ডাকা ডাকি, হাঁকা হাঁকি, অনুনয় বিনয়, চিল্লা চিল্লিতে মুখরিত দীঘির পাড়। ডিউটি মাস্টার বা তার আর শৃঙ্খলার কোন নিশানই রইল না। যে যেভাবে সম্ভব “ক্যানো” নিয়ে দীঘিতে বিচরণ করে আনন্দে মেতে রইল। শেষ বাঁশিটি বাজা পর্যন্ত। যথা রীতি আবার ডবল মার্চে সবাই ফিরে আসলাম ।

এর পর প্রেপ, ডিনার শেষে ‘ লাইটস অফ ‘ এর ঠিক আগে হাউজের পেছনের জানালায় রবীন্দ্র হাউজের বন্ধু রফিক এসে হাজির। গিয়াস কে দেখেছিস কেও? না কেউ দেখেনি।ওদের রুম মেট , হাউজ মেটরা ভেবেছিলো কলেজ গেটের বাইরে যাবার সুযোগে বুঝি কলেজ ‘বাঙ্ক’ করে শহরে গেছে।কিন্তু হাউজের কোন বন্ধু বা কাউকে না বলে? হতেই পারে না, আর গিয়াস ওরকম ছেলেই নয়। আস্তে আস্তে সকলের ভিতর একটা আতঙ্ক এসে দানা বাঁধতে লাগলো । দীঘিতে ডুবে যায়নিতো ???

লাইটস অফ, তবু নির্ঘুম সকলে শুয়ে আছি খবর এর আশায়। বারোটা নাগাদ খবর এলো ও শহরে ওর বাসায় বা অন্য কোথাও যায়নি । আতংকটা ভঁয়ে রুপ নিলো। ওদের হাউজ মাস্টার ভুঁইয়া সাহেব কে খবরটা জানানো হল। ততঃ ক্ষণে সিনিয়ার রা সহ সার্চ পার্টি রেডি হয়ে গেলাম। প্রিঞ্চিপাল, এডজুটানট্, শিক্ষক রা সহ অনেকেই আমরা গভির রাতে দীঘিতে নামলাম। ফ্লাড লাইট এনে জালানো হল।বাকি রাত শ খানেক লোক পানিতে ডুবে ডুবে কতই খুঁজা খুঁজি করলাম, মিললো না। আবার আশায় বুক বাঁধলাম, নিশ্চয়ই টাউনেই কারো বাসায় রাত কাঁটিয়ে হয়তো সকালে ফিরে আসবে । আমরা মিছা মিছি প্যনিক করছি! ভোঁর হোল, দিনের আলোও ফুটলো কিন্তু আমরা কেও দীঘি থেকে ফিরে এলাম না। দশটা নাগাদ বড় জাল নিয়ে জেলেরা আসলো। দীঘির এধার থেকে ওধার পর্যন্ত জাল টানা হল বেশ কয়েক বার। নেই কিছুই । যখন আমরা কেবল ভাবছিলাম শহরের হাঁসপাতাল গুলিতে খবর নেবার , ঠিক সেই সময় । বিচ্ছিন্ন এক জেলের ঝাকি জালে কি জেনো একটা উঠে এলো । আমি জেলের তিন চার ফুটের মধ্যে দাড়িয়ে। ৩৭ বছরের পুরানো নয়, যেন গত কাল ঘটে যাওয়া ঘটনা। জাল ওর কোণুই তে বেঁধে উঠিয়ে এনেছে। মনে হচ্ছিলো ও শুন্যে বসে আছে। নিষ্প্রাণ। কিন্তু এক ফোঁটা পানিও সম্ভবত পান করেনি।তাই ভেসে উঠেনি।

কলেজের পাম্প মেশিন এর পানি উঠার পাইপ বরাবর সব থেকে গভীর খাদ যেখানটায় , সেখান থেকে , যেনো অতলান্ত কোন সাগর থেকে উঠে এলো মৎস্য মানব, “আমাদের গিয়াস”। এর পরের ঘটনা আমাদের কোন সহ পাঁঠিরই আর মনে নেই। থাকবার কথা ও নয়। (চলবে)

১,৬৩৯ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “আমার ক্যাডেট কলেজের স্বর্ণালি দিনগুলি- (ছয়)”

  1. আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

    আজি্জ ভাই -মনটা ভারী হয়ে গেল গিয়াস ভাইর ঘটনা শুনে।
    গিয়াস ভাই কী ভাল সাঁতার জানত?
    ঘটনাটা ঘটার সময় কেউ টের পায় নি?
    এফসিসি্তে কী ক্যানো ক্লাব এখনো আছে?

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      - না 'ও' মোটেই সাঁতার জানতো না।
      - ঘটনা কখন ঘটে কেও জানেনা বা দেখেনি। সবাই ব্যস্ত ছিল 'ক্যেনো' দখল নেয়ার জন্যে। ও সম্ভবত স্লিপ করে একেবারে পানি উঠার পাইপের খাদের গভীরে পরে যায় এবং মৃত্যু হয় (সম্ভবত ভয়ে) 'হার্ট ফেলিউর' এ।
      - আমি জানিনা এফ সি সি তে এখনো ক্যানো ক্লাব আছে কি না।


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
      • আমার ছেলে FCCতে পড়ে । শহীদুল্লাহ হাউস । আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি, কিন্তু কাউকে ঐ দিঘীর আশেপাশে দেখি নাই । সম্ভবত ক্যেনো ক্লাব নাই ।
        আপনার লেখা আমার স্ত্রীকে দেখেয়েছি । ভূল করেছি । কারন তিনি অত্যন্ত বেশী কষ্ট পেয়েছে । বারবার বলছে, ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে দিয়ে ভূল করেছে ।

        জবাব দিন
        • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

          ভাই খাইরুল,
          আপনি বা ভাবী, আপনারা ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে দিয়ে ভুল করেননি।আমার ক্যাডেট নম্বর ৮৫৮, এর পর জানিনা কত হাজার ক্যাডেট FCC তে পড়েছে।কোই আর কখনো আমরা শুনেছি এমন কোন দুঃসংবাদ ? এটা নিছক দুর্ঘটনা বইতো অন্য কিছু নয়। বাড়ীতে পড়াশুনা করলেও ঘটতে পারত । আমরা বাবা-মা রা, (বিশেষ করে 'মা') বাড়ী বসে শুধু আমাদের সন্তানদের নিরাপত্ত্যা ও সহি সালামত থাকার জন্য দোয়া করতে পারি।আমিন।
          (ভাবীর জন্যে সান্ত্বনা ঃ আমার দুই টি মাত্র সন্তান (ছেলে)।বড়টি 'ব্যাংকক' এর 'এবেক ভার্সিটি' আর ছোটটি 'ইউ কে' র 'কার্ডিফ উনিভার্সিটি' তে পড়ে।আল্লাহ কে ভরসা করে শুধু বিদ্যার্জনের জন্যে অনেক কষ্টে বুক বেঁধে ওদের মা'র এই আত্মোৎসর্গ ।) - আজিজ।


          Smile n live, help let others do!

          জবাব দিন
          • ধন্যবাদ আজিজ ভাই । আমার স্ত্রী তাই করেন । আমার একটি মাত্র ছেলে । Cadet Tahmid । ক্যাডেট নম্বর ২৯১২ । অষ্টম শ্রেনী ।

            Cadet college দেই কারনঃ শারিরিক গঠন ঠিক থাকবে, খেলাধুলা করতে পারবে ( ঢাকায় সম্ভব না), নিয়ামনুবর্তিতা শিখবে, ভাল বন্ধু-বন্ধব পাবে, লেখাপড়াও নিয়মিত করবে ।

            দোয়া করবেন ।

            জবাব দিন
            • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

              আপনি খুবই ভাল কাজ করেছেন। ছেলে বড় হয়ে কি হবে সেটা আল্লাহর তালার হাতে। তবে এটা আমি আপনাকে অগ্রিম জানাতে পারি যে, সে একটি "বিশাল ওল্ড ফৌজিয়ান পরিবার " পাবে, যারা আজীবন ওর যে কোন প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে, পরিচিত হোক না হোক ! - আজিজ।


              Smile n live, help let others do!

              জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আজিজ ভাই, ধন্যবাদ আমাদের কস্টের স্মৃতিটা তুলে আনার জন্য। গিয়াস ভাই যখন মারা যান আপনারা সম্ভবত তখন ক্লাস নাইনে। আমাদের কলেজে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরের ঘটনা। রবীন্দ্র হাউসে আমি যে কক্ষে ছিলাম, সম্ভবত ১৯ নম্বর- সেটিতেই গিয়াস ভাইও ছিলেন। উনাকে হারিয়ে আমরা কিছুদিন ওই কক্ষে ৭ বাসিন্দা ছিলাম। মানুষ হিসাবেও গিয়াস ভাই ভালো ছিলেন। কোনোদিন ধমক দিয়ে কথা বলেছেন বলেও মনে পড়ে না। ওই সময়টা ছিল পুরো কলেজের জন্য ভীষণ দুঃখের।

    স্মৃতির আরেকটা অংশ হলো, গিয়াস ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুরো কলেজে 'ভুতের ভয়' ছড়িয়ে পড়লো। বিশেষ করে জুনিয়রদের মধ্যে। আমরা শুনতাম ভয়ে অন্য কক্ষে, অন্য হাউসে ছেলেরা রাতে তাদের বেডগুলো কাছাকাছি এনে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। কিন্তু আমাদের কক্ষের বাসিন্দা বড় ভাই গিয়াস ভাই 'ভুত' হয়ে আমাদের ঘাড় মুচড়ে দেবেন এমনটা কখনো মনে হয়নি। তাই আমাদের বেডগুলো কখনো 'ক্লোজ' করতে হয়নি।

    এখনো মাঝে-মধ্যে স্মৃতিতে গিয়াস ভাইয়ের মায়াময় মুখটা ভেসে উঠে।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      রাতে ৬ নম্বর পর্ব লিখে অনেক ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। বিয়োগ ব্যথা সব সময় বেদনা দায়ক । প্রায় ৪০ বছর আগের মৃত্যুটা যেন হঠাৎ চোখের সামনে এসে সব ঝাপসা করে দিতে চাইলো।গিয়াস এর করুন মৃত্যুর ঘটনাটা ছাড়া ক্যাডেট জিবনের রোজনামচা অসমপূর্ণ থেকে যেতো । অন্যদের কাছে এই বেদনা বিধুর সত্যটি ক্যাডেট কলেজ জিবনের ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার গল্প হিসাবে ভাল লাগতে পারে! আর এই ভাল লাগাতেই আমি কৃতজ্ঞ । ধন্যবাদ ।


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অনেক আগেই পড়েছিলাম, কিন্তু মন্তব্য করার কোন ভাষা পাইনি। খুবই কষ্টের ঘটনা।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।