১.
আমাদের দাদী যখন অমাবস্যা রাতে প্রেতাত্মাদের গল্প শোনাতেন, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। অপঘাতে মৃত্যু হওয়া আত্মাদের অতৃপ্তি, নিশুতি রাতে তাদের প্রলাপ, নির্জন পোড়াবাড়িতে তাদের উপস্থিতি আর শ্মশানঘাটে মানুষের ঘাড় মটকে দেবার কাহিনী শোনানোর সময় দাদী কেমন যেন একটা আধিভৌতিক ভীতিকর আবেশ সৃষ্টি করে ফেলতেন। গায়ের রোম খাঁড়া হয়ে উঠত। ভয় ভয় চোখে দাদীর কোলে মুখ লুকিয়ে যখন গুটিসুটি হয়ে পড়ে থাকতাম, ভাইজান খুব খেপাত। আমার ভাইজান খুব সাহসী মানুষ। দাদীর গল্পগুলো কখনো সে বিরক্তির সাথে আবার কখনো তাচ্ছিল্যের সাথে নিত। তার মতে ভুত-প্রেত, আত্মা এসব নিতান্তই মানুষের মনগড়া কাহিনী।
আমি বরাবরই দাদীর গল্পগুলোতে বিশ্বাস করে এসেছি। আজ, এ সময়ে এসে বুঝতে পারছি, অতিপ্রাকৃতিক কিংবা অস্বাভাবিক হলেও এই ব্যাপারগুলোর কিছুটা আসলেই সত্যি। জ্বলন্ত প্রমাণ আমি নিজে। আমি একজন অতৃপ্ত আত্মা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন…আষাঢ়ে মনে হলেও সত্য…আমি একজন অতৃপ্ত আত্মা। আমার পরিচয় পরে দিচ্ছি। পৃথিবীর হিসাবে আমার বয়স আজ ৬৮ বছর হবার কথা। যদিও আমার জীবনচক্র থেমে গিয়েছিল মাত্র ৮ বছর বয়সে।
আজ থেকে ষাট বছর আগের কথা। সময়টা তখন খুব অশান্ত ছিল। দেশভাগের পরপরই মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ নামে এক ব্যক্তি রেসকোর্স ময়দানে নাকি ঘোষণা দিয়েছেন “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” আমি একজন সামান্য রাজমিস্ত্রির ছেলে। আব্বা পেটের দায়ে পরিবার নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকা চলে এসেছেন। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর রাখার প্রয়োজন আমাদের পড়েনা। কিন্তু কিছু মৌলিক অধিকারে আঘাত পড়লে ক্ষুদ্রতম প্রাণীটাও গর্জে উঠে। আব্বা মাকে এসে যা বললো তাতে বুঝলাম সামান্য ক্ষুধা পেলেও মায়ের কাছে গিয়ে বলতে পারবো না “মা ভাত দেও”…বলতে হবে ” আম্মিজান, খানা দো”। এত সুন্দর একটা ভাষা আমাদের থাকতে লোকগুলো কেন এমন বদখত ভাষায় আমাদেরকে কথা বলতে বলছে বোধগম্য হয়নি সেদিন। আসলে নোংরা একটা জাতির দুর্গন্ধযুক্ত রাজনীতি বোঝার বয়স হতেও তখন অনেকটা বাকি।
অশান্ত ভাবটা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করার দিকে মোড় নিল ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি, যেদিন খাজা নাজিমুদ্দিন নামক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন লোকটা পল্টন ময়দানে অতি ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে ঘোষণা করল, ” কোন জাতিই দু’টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনা। অতএব উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” বাঙ্গালীরা খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। বাংলার বুক থেকে সমস্ত সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা, উচ্চপদস্থ সকল সরকারী পদে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অবস্থান ছাড়াও আরো বিভিন্ন শোষণ সত্ত্বেও তারা মুখ বুজে ছিল। পিনপিন করা মশার স্বভাব হল, যতক্ষণ আপনি তাকে সহ্য করবেন সে বিভিন্ন উপায়ে ততক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করতে থাকবে। আপনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় মানুষটিও হন, তবুও শেষ পর্যন্ত অসহ্য হয়ে আপনি ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে তাকে শেষ করে টোকা দিয়ে ফেলে দিবেন।
বাঙ্গালীও তাই করলো। “রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ” নামক একটি সংগঠনের নেতৃত্বে ঢাকার ছাত্রজনতা সোচ্চার আন্দোলন গড়ে তুলল। ২০শে ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার প্রশাসন এক মাসের জন্য ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করল। গণিতের কোন হিসাব জানিনা, আব্বার কথায় জানলাম,” চারজনের বেশি একসাথে রাস্তায় জমায়েত হওয়া নিষেধ।” ভয়ে সেদিন সারারাত আজিমপুরের কাছে বস্তিটায় আমাদের ছোট্ট আশ্রয়ে মুখ বুজে পড়ে থেকেছি। প্রস্রাবের জন্য বাইরে যেতেও ভয় লেগেছে।
বাংলার অসীম সাহসী একদল যুবক অবশ্য সেদিন এই অন্যায় আইনের ভয়ে ঘরের কোনায় লুকিয়ে থাকেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল এবং ফজলুল হক হলে সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দেয়া হয়। রাতভর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণ-তরুণী চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় হস্তে ব্যানার লিখে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।” দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ আর পিনপিনে মশাকে রক্ত চুষতে দিতে রাজী নয়।
২.
২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জমায়েত হতে থাকে।
সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী বিদ্রোহী ছাত্রদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। জানেন তো একতার শক্তি অনেক বড় শক্তি। সে শক্তির কাছে পুলিশের হুংকার বিড়ালের ডাক বলে প্রতীয়মান হয়। আন্দোলন আরো জোরদার হয়। সরকার এবার তার পোষা পশুগুলোকে চূড়ান্ত পাশবিকতার লাইসেন্স দিয়ে দেয়। পশুগুলো নিরস্ত্র ছাত্রজনতার উপর নির্বিকারে গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে আব্দুল জব্বার, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরো অনেকে নিহত হন।
সমগ্র ঢাকা তখন উত্তপ্ত। আমার বয়স তখন আট। এসব কিছু বোঝার বয়স তখনো হয়নি। শুধু বুঝলাম আমার দেশে আশ্চর্য কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যারা পাখির মত মানুষ মারে।
দিনটা ছিল ২২শে ফেব্রুয়ারি। পাশবিক এই ঘটনায় সারা ঢাকা উত্তাল। সমস্ত অফিস, দোকানপাট, পরিবহন, রেডিও স্টেশন তখন বন্ধ। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন তখন জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সকাল এগারোটায় মিল ব্যারাক পুলিশ লাইন মসজিদ প্রাঙ্গণে হাজার হাজার জনতা রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতদের জানাজায় অংশগ্রহণ করে।
সকালবেলাতেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম অদম্য সাহসী এই মানুষগুলোকে দেখতে। তখন বুঝিনি ইনারা জাতীয় বীর হয়ে গেছেন। জানাজায় আমিও অংশ নিলাম। কি অদ্ভুত এই মানুষগুলো ! সমগ্র পৃথিবীর মানুষ যখন “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” নীতিতে বিশ্বাসী, এই মানুষগুলো নির্ভীকচিত্তে বুলেটের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। সামনের সারি থেকে বাঙ্গালীকে শিখিয়ে দিয়ে যায় বিপ্লবের অর্থ।
জানাজা শেষে জনতার স্রোত শ্লোগান দিতে দিতে কার্জন হল মুখে রওনা হতে থাকে। এত কিছু বুঝি না, সবার সাথে গলার রগ ফুলিয়ে শুধু চিৎকার করছিলাম “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।” অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছিল।মিছিলটা তখন কেবলি নবাবপুর রোডে ঢুকেছে। আমি আমার কণ্ঠের সমস্ত উচ্চতা উজাড় করে শ্লোগান দিচ্ছি। হঠাৎ বুকের বামপাশে অদ্ভুত একটা ব্যাথা অনুভূত হল। আমি মুখ থুবড়ে পড়লাম। জনতার স্রোত কিঞ্চিত ছত্রভঙ্গ হলেও এগিয়ে যেতে থাকে দৃপ্ত পদক্ষেপে। আমাকে ওদের সাথে শামিল হতে হবে। কোন এক অদ্ভুত কারণে আমি পারিনা। রাস্তার উপর পড়ে থাকি। অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যে নবাবপুর রোডে পুলিশের কিছু ভ্যান আসে। তারই একটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। লালবাগ থানার পাশে একটি গর্ত খুড়ে তিনটি মৃতদেহের সাথে আমাকেও জ্যান্ত পশুর মত পুতে ফেলা হয়। কোন শেষকৃত্য বা জানাজা হয়না। আমি হয়ে যাই একটি অতৃপ্ত আত্মা।
৩.
একসময় বুঝতে পারি আমি আসলে আর কোন বন্ধন দিয়ে আমার শরীরের সাথে বাঁধা নেই। ইচ্ছা করলেই ঘুরে বেড়াতে পারি। কিন্তু সবসময় গভীর একটা চাপা কষ্ট থেকে যায়, যেটা চাইলেও উপেক্ষা করা কঠিন। বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। মা আমাকে না পেয়ে কখনো কাঁদছেন, কখনো পাথর হয়ে যাচ্ছেন। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম তাকে “মা, এই যে আমি। তোমার পাশেই আছি মা, তোমার চিন্তার কিছু নেই।” আশ্চর্য ব্যাপার মা আমার কথা কিছুই শুনে না, কিছুই বুঝে না। আমার আকুল “মা” ডাক অদৃশ্য কোন দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার ফিরে আসে। একসময় আমি হাল ছেড়ে দেই। অভ্যস্ত হয়ে যাই। অভ্যস্ত হতে পারে না আমার মা। আমার শোকে একসময় তার মৃত্যু হয়।
আমার কথা বলার সঙ্গী ছিল আমাকে যে তিনজনের সাথে গর্তে পুঁতে দেয়া হয়েছিল তারা। ১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তান সরকার বিপুল প্রতিবাদের মুখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় তখন বিধাতা একতা সুযোগ দেন আমাদেরকে মুক্ত হবার। বাকি তিনজন সে সুযোগ নিয়ে মুক্ত হয়ে গেলেও আমি থেকে যাই অদ্ভুত এক নেশায়। কারণ “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগানটা তখন পরিণত হয়েছে “বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই” শ্লোগানে।
বাঙ্গালী বড় খ্যাপাটে জাতি। একটা কিছু মাথায় চেপে বসলে কার্যসিদ্ধি হবার আগ পর্যন্ত তা মাথা থেকে নামে না। এই খ্যাপাটে জাতির খ্যাপাটে এক নেতা ছিলেন। বড্ড গোঁয়ার। তিনি একদিন ঘোষণা দিয়েছিলেন “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।”
আশ্চর্য ব্যাপার খ্যাপাটে জাতিটা সত্যি সত্যি সমুদ্র পরিমাণ রক্ত বিসর্জন দিয়ে একদিন “স্বাধীনতা” নামক চির আরাধ্য বস্তুটা ছিনিয়ে আনে। পশ্চাৎদেশে লাথি দিয়ে এদেশ থেকে পাকিদেরকে বিতাড়িত করা হয়। সে অনেকদিন আগের কথা। তখনকার কথা যখন “বাঙ্গালী” নামক জাতিটার মধ্যে দুর্ভেদ্য একতা ছিল। অহংবোধ ছিল। এই দুই বস্তু বহু আগে এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিধাতা প্রদত্ত দু’বার মুক্তির সুযোগ হাতছাড়া করে আমিও আজ আটকে গেছি এই চক্রে।
৩.
যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে অনেক ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। দেশের জন্য দরদ ছিল এরকম প্রকৃত কিছু নেতার হত্যা যার মধ্যে অন্যতম। বুকে পাথর চেপে হলেও মেনে নিয়েছি সেগুলো। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও এরকম মর্মান্তিক ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছে। কিন্তু সে সকল জাতি অপূরণীয় সেসব ক্ষতিকে জেদে পরিণত করে আরো উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে।
দুঃখের ব্যাপার আমরা সত্তর-আশির দশকেই আটকে গেছি। সত্যি কথা বলতে কি, এ দেশে এখন জীবিত আমার জেনারেশানের উপর আমি প্রচণ্ডভাবে হতাশ এবং বিরক্ত। দেশের মূল দুই রাজনৈতিক পরাশক্তির একটি রাজাকারদের আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত, আরেকটি দল অন্য দেশের পদলেহনে ব্যস্ত। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে জাতিটা তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া তাদের ভিত্তি এত নড়বড়ে হয় কিভাবে ! মাঝে মাঝে মনে হয় আমার জেনারেশানে দেশপ্রেমী যত মানুষ ছিল, সবাই সম্ভবত দেশ স্বাধীন করতেই শহীদ হয়ে গেছেন। থেকে গেছে কিছু সুবিধাবাদী মহল। যারা দেশের সমস্ত ইতিহাস-ঐতিহ্য বিদেশী সংস্কৃতির কালিমায় রাঙ্গাতে ব্যস্ত। যার শিকার পরবর্তী প্রজন্ম।
এবারের একুশে বইমেলায় দেখলাম অনেকে একুশের ইতিহাস সম্পর্কেই জানেনা। তাদের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি আর ১৪ই ফেব্রুয়ারির মাঝে কোন পার্থক্য নেই। ওদেরকে দোষ দেই না, ওদেরকে জানাবে কে?
ঠিক নির্দেশনায় চললে একটা জাতির উন্নতি করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জাপান মাত্র ৫০ বছরে পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে প্রযুক্তিতে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ৪০ বছরে একটু একটু করে শুধু পিছিয়েই গেছি। রফিক আজাদের কণ্ঠে শুনি “ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব।” যে দেশের শতকরা ৪০ জন মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে জীবনযাপন করে, যে দেশে সোনাবরুর মত কিশোরী ক্ষুধার তাড়নায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়, যে দেশের প্রতিটা শিশু মাথায় হাজার হাজার ডলার ঋণের বোঝা নিয়ে জন্ম নেয়, সেদেশে প্রতিবছর ১২০০ কোটি টাকা কিভাবে বিদেশী নোংরা সংস্কৃতি আমদানি করতে চলে যায় ?
মাঝে মাঝে অবাক লাগে, কিভাবে রক্তের দামে কেনা সভ্যতাটা মানুষ বিনামূল্যে বিকিয়ে দেয়, গরীব-দুঃখীদের দু’বেলা ডালভাতের দামে কিনে আনে নোংরা সংস্কৃতি। মনে হয় আমি বেঁচে গেছি। জব্বার-বরকতেরা হয়তো আজ বিধাতার কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা পান।
হুমায়ুন আহমেদ নামের একজন পাগলাটে লেখক আছেন শুনেছি। তার লেখা প্রতিটা প্রতিটা বই একসময় কলকাতার বাজারে বের হবার আগেই শেষ হয়ে যেত। কলকাতায় বাংলাদেশী সভ্যতার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফটা সেখানকার প্রশাসন খুব তাড়াতাড়িই বুঝে গিয়েছিল। আইন করে এদেশি বই বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়। আমরা উদার জাতি। এসব আমাদের খুব একটা ভাবায় না। ভারতের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল দূরদর্শন বিটিভির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েও ঘুণাক্ষরে কখনো বাংলাদেশী অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে না। আমরা আইন করে এদেশের প্রেক্ষাগৃহে “চিকনী চামেলি” দেখা বাধ্যতামূলক করে তাদেরকে সাধুবাদ জানাই।
কাঁটাতারের বেড়ার উপর ফেলানীদের মৃতদেহ ঝুলতে থাকে দু’দিন ধরে। ওদের গলিত লাশ আমরা টনকে টন ইলিশ আর জামদানী শাড়ী দিয়ে বরন করে নেই। এতেই থেমে থাকে না। কৌশলে বর্ডার উন্মুক্ত করে দিয়ে সেদেশি চোরাচালানী দ্রব্যের রমরমা ব্যবসা এদেশে গড়ে উঠার সুযোগ দেই। এদেশের দ্রব্যমূল্য কিংবা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
দেশের সমস্ত সাহসী পুত্রদের এক ঝটকায় হারিয়ে যেতে দিতে আমরা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করি না। দু’দিনের বি,ডি,আর বিদ্রোহে নিহত অফিসারের সংখ্যা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অফিসারের সংখ্যাকেও দিব্যি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ছাড়িয়ে যায়। স্বামী বা বাবা হারানো মা-মেয়ের পচা গলিত লাশ জাপটে ধরে করুন আহাজারির দৃশ্য আমাদের মনে একটুও দাগ কাটেনা। উন্নতির আন্দোলন সৃষ্টিকারী যে কোন দেশীয় ধারনা অন্ধকারেই রয়ে যায়। আলো বাতাস দিয়ে পরিচর্যা করি বিদেশী সংস্কৃতি।
৪.
নিয়তিকে মেনে নিয়েছিলাম। রক্তের দামে কেনা এ বাংলা এভাবেই হারিয়ে যাবে। হয়তোবা আস্তে আস্তে অন্য কোন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হিসাবে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকবে কিংবা যারা দেশটির জন্মই চায়নি তাদের হাতে চলে যাবে। আর আমি অতৃপ্ত এক আত্মা ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াব রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতদের রক্তমাখা ঢাকার রাজপথে।
অবাক ব্যাপার আমাকে আজো স্বপ্ন দেখায় আজকের তরুণ সমাজ। আশ্চর্য হলেও সত্য আজকের বহু তরুণের বুকে আমি সেই প্রাচীন স্বপ্নগুলোর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। টি,এস,সি মোড়ে চায়ের স্টলে সেদিন একজন যুবককে আক্ষেপ করে বলতে শুনলাম…”এতগুলো সাইন আপ সত্ত্বেও গুগল তাদের ডুডল হিসাবে শহীদ মিনার ব্যাবহার করলো না আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে।” এই গুগল-ভূগোল বাপু আমি বুঝি না। একটা কথাই বলেছিলাম ” ওরে পাগল খোকা, ওরা কি বুঝবে ভাষার মর্ম ? ওদের রক্তে শ্বেত-লোহিত রক্তকণিকা বয়, আমাদের রক্তে যে “বাংলা” বয়ে চলে।”
আমার কথা হয়ত ওরা শুনতে পায় না। কিন্তু আমি ওদের ধমনী দিয়ে বয়ে চলা রক্তে জাগরণের স্রোত দেখি। ওদের রক্তে “বাংলা” দেখি। বায়ান্নর জব্বার-বরকতদের মত কিংবা একাত্তরের হামিদুর-মতিউরদের মত ওদের রক্তেও একটা “আগুন” পাই। জানি সমস্ত ভিনদেশী সংস্কৃতিকে ডাস্টবিনে পাঠিয়ে দেশী সংস্কৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলবে ওরাই। হয়ত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। হয়ত আমার অতৃপ্ত আত্মার বয়স সেদিন ষাট থেকে একশ হবে, তবু আমি নিশ্চিত এই তরুণ প্রজন্ম যেদিন দেশ পরিচালনায় যাবে, সেদিন দেশে কোন পরিবারতন্ত্র থাকবে না । আজকের দূষিত বাংলাদেশ আর সেদিনকার বাংলাদেশে বিস্তর ফারাক থাকবে।
স্বপ্ন দেখি ‘৫২ র ভাষা আন্দোলনের দিন যেমন বাংলার সকল দল একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিল, এদেশের উন্নতির জন্য একদিন এই তরুণ সমাজ একই ভাবে এক কাতারে দাঁড়িয়ে কাজ করবে।
আর সেদিন আমি ‘৫২ র আট বছরের অহিদুল্লাহ’র অতৃপ্ত আত্মা অপরিসীম এক তৃপ্তি নিয়ে মুক্ত হয়ে চলে যাব স্বর্গের পানে। মা’কে বহুদিন দেখিনি…মা’কে দেখতে খুব মন চায়।
**১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ নবাবপুর রোডে ভাষা শহীদদের জানাজা পরবর্তী বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। অনেকের সাথে নিহত হয় “অহিদুল্লাহ” নামের আট বছরের একটি বালক। জনশ্রুতি আছে ঐদিন কিছু লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে, তার ভিতর অহিদুল্লাহ একজন। হয়তোবা ভাষা শহীদদের সাথে তার নাম উচ্চারিত হয় না। কিন্তু আমার কাছে অহিদুল্লাহ একজন ভাষা-সৈনিক।**
দেশের কান্ডকারখানা নিয়ে এরকম লেখা পড়লে খুব ভাল্লাগে।
ভাষাসৈনিক অহিদুল্লাহ এর কথা জানা ছিল না।অন্য অনেক নাম না জানা শহীদ এর মত।
উইকিতে বলা আছে ২২ শে ফেব্রুয়ারীতেও চার জন নিহত হয়েছিলেন। এই চারজনের নাম খুজছিলাম। একজনের নাম জানা গেলো, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। যদি জানা থাকে তাহলে বাকি তিন জনের নাম দিয়ে দিও।
আর উইকির তথ্যটা যদি ভুল থাকে, শুধরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
অহিউল্লাহ'র ব্যাপারে আমি উইকি থেকেই জানতে পারি ভাই...
খুব ভাল হয়েছে লেখা। :boss:
:salute: