আমার পিতামহের গল্প বলতে ইচ্ছা করছে।এর সবটাই শোনা গল্প।
কুরবান আলি-অনেক ভাইবোনের মধ্যে ছোটর দিকে। মানে ঐ আরকি ঠিক ছোটটার একটু বড় । অন্য ভাইয়েরা লেখাপড়া জানে।একজন তো ফার্সি ও উর্দু কবিতা লেখেন।কয়েকজন কুরানে হাফিজ।আর কুরবান কিছুতেই পড়ালেখা মাথায় ঢুকাতে পারেনা।একটু বোকা কিসিমের সহজ সরল।
বাবা ১৭ বছরের কুরবানকে বিয়ে করিয়ে ঘরে আনলেন ৯ বছরের বধু।
বৌকে কুরবানের পছন্দ হল। কি লাজুক আর কি মিষ্টি !
্কুরবানদের বাড়িটি বিশাল গেরস্থ বাড়ি।কিন্তু অন্য বাড়িগুলোর সাথে এর তফাৎ হচ্ছে কঠিন পর্দা মেনে চলা হত সে বাড়িতে। অত বড় বাড়িতে তারা দেখা হওয়া দূরে থাকুক খুব বেশি কথা বলারই সুযোগ পেতোনা। বৌ ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত তাদের একান্ত হবারও কোন সুযোগ ছিলনা।দাদি/নানি শ্রেণির এক বয়স্কা তাদের সাথে ঘুমাতেন।রাতের বেলাতেই দুজনের নানা গল্প ,প্রদীপের আলোয় খেলা এসব হত।
একদিন ,বৌএর মুখ গম্ভীর।অনেক অনুরোধ উপরোধের পর সে মুখ খুলল।
-অন্যরা আপনাকে মুর্খ বলে হাসাহাসি করে।
-কারা?
-ভাবিজানেরা।
বৌর চোখ ছলছল করে উঠলো। কুরবান বুকে একটা ধাক্কা লাগল।বৌয়ের কাছে নিজেকে প্রমাণ করবার একটা তাগিদ অনুভব করল সে।
পরদিন ভোরে কুয়াপাড়ে অযু করতে গিয়ে কুরবান দেখল পানি তোলার বালতি যেখানটায় রাখা হয় সেখানে একটা গর্ত মত হয়েছে। কংক্রিটের উপর বালতির ঘষায় গর্ত হয় আর তার মাথায় পড়া ঢোকেনা!
কুয়াপাড়ে আধ ভরা বালতি ফেলে কুরবান বেরিয়ে গেল।
সারা এলাকা,আশেপাশের গ্রাম কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেলনা।কোথাও কোন চিহ্ন নাই।
এটা প্রায় দুইশত বছর আগের গল্প।তখন কাউকে কিছুদিন খুঁজে পাওয়া না গেলে মৃত বলে ধরে নেয়া হত।
কুরবানের পরিবার ও সেইরকম ধরে নিল,একজন বাদে।সে কুরবানের কিশোরী বৌ।
বাপের বাড়ি থেকে নিতে এলে যেতে চায়না,শ্বশুর বাড়িতে থাকবে বলে পণ করেছে সে।
এদিকে বাড়িতে কুমারী কিশোরী বধু বাড়িতে রাখা নিয়ে সমাজে কথা ওঠে। কুরবানের বাবা মা বৌকে আবার বিয়ে করতে পরামর্শ দেয়।একটা নির্দিষ্ট সময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যোগাযোগ না থাকলে ,স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষন না দিলে আপনা থেকেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়,এ কথা জানালেন।কিন্তু বৌ তার বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অনড়। কুরবানের বাবা মা হাল ছেড়ে দিলেন।
বৌটি আর বাপের বাড়ি যাবেনা বলে ঘোষণা দিল।কারন তারা ওকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়।
সে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে তার দৃঢ় বিশ্বাস যে তার স্বামী বেঁচে আছে এবং একদিন ফিরবেই,সেজন্যই বিয়ে করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
সেই শ্যামলা বরণ বধুটির দিন কেটে যায়, রাত বয়ে যায় ঐ একদিনের প্রতীক্ষায়।
অবশেষে ‘একদিন’ এলো।আঠারো বছর পরে বর্ষাকালের এক বৃষ্টিধোয়া দিনে।
নৌকা ভিড়লো বাড়ির ঘাটে।
কুরবান নেমে এলো নৌকা থেকে।বিশাল কয়েকটি বাক্স তোরঙ্গের সাথে নেমে এলো লম্বা ঘোমটা দেয়া এক অনিন্দ্য সুন্দরী।পায়ে তার চামড়ার জুতা,তাতে মুক্তা বসানো।গা ভর্তি গয়না।পরনের শাড়িতে সোনা রূপার সূতার কারুকাজ।ঘোমটার আড়ালে তার একজোড়া দুষ্টু চোখ উঁকি মারছে।
সারা গ্রামের বৌঝিরা ভেঙ্গে পড়লো তাকে দেখতে।
বাড়িতে ঢুকে কুরবান সবাইকে জানালো এটি তার নিকাহ করা নতুন বৌ।
হুগলির যে ধণাঢ্য ব্যাক্তির আর্থিক সহায়তায় সে তৎকালীন ভারতবর্ষের বিশিষ্ট সব মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে,এ তারই মাতৃহীনা,কিঞ্চিত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কন্যা।কুরবান ভাবতেই পারেনি যে তার প্রথম পক্ষ তখনো তারই প্রতীক্ষায়।বিদ্বান হবার নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল।প্রথম কিছুদিন বৌর কথা মনে পড়লেও পরে ভেবেছে খোঁজ না পেয়ে হয়তো সে দ্বিতীয়বারের মত নিকাহ করেছে।ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠা,প্রমাণের নেশা চিরকালই পুরূষদের ভালোবাসাকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছে।
যখন খবর পৌঁছাল তার কাছে তখন প্রথম বধু হেঁশেলে ছিল।স্তব্ধ হয়ে গেলো সে।
কুরবান তার কাছে গেল।কিন্তু দেখা দিলনা।কারন ধর্মানুযায়ী তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে।
হেঁশেলের বাইরে থেকে কোমল কন্ঠে ডাক দিল সে।তার কন্ঠ শুনে জ্ঞান হারালো বধু।
এতোদিন পরে সে বাপের বাড়ি যেতে চাইল।
তাদের দুজনার মাঝে যোগাযোগ ঘটাল আর কেউ নয়, নতুন বৌ।সে যখন তখন দেউড়ি পেরিয়ে বার বাড়িতে,কাছারি ঘরে চলে যায়।অকারণে জোরে জোরে হেসে ওঠে।যেদিন বড়বৌ চলে যাচ্ছিল,কি ভেবে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো বড়বৌকে। -আপাজান…আপাজান বলে কান্না জুড়ে দিল।
তার ছেলেমানুষী সামলানোর জন্য বড় বৌ থেকে গেল।কুরবানের সাথে বড় বৌয়ের আবার বিয়ে পড়ানো হল।
নতুন বৌ পেল এক মা।
কিন্তু দেড় বছরের মাথায় জ্বরে ভুগে মারা গেলো নতুন বৌ।
কুরবান আর তার প্রথম বৌকে কাছাকাছি আসবার সুযোগ দিতেই যেন চলে গেল সেই আদুরে পাগলি,নিঃসন্তান অবস্থায়।
কুরবান বেছে নিল মানুষকে আলোকিত করার কাজ।আর তার সংসার সামলায় বৌ।
পর্দার অন্তরালে থেকেই চাষবাস,ছোট একটা ব্যাবসার কাজ দেখাশনা করে সে।
দুটি পুত্র সন্তান জন্মায় তাদের।
বড়টি যখন বার আর ছোটটি আড়াই ,তখন এক সন্ধ্যারাতে সাপে দংশন করল কুরবানকে।
বৌ ওঝা ডাকতে চাইল,কিন্তু কুরবান মানা করল।
-কোন লাভ নাই,বৌ।সময় নাই আর।
কুরবান অযু করে এল,নামাযে দাঁড়ানোর আগে বৌকে বলল,আল্লাহ তোমাদের অবশ্যই হেফাজত করবেন।
সিযদারত অবস্থায় সে মারা যায়।
দুই ছেলেকে নিয়ে একা হয়ে যাওয়া বৌটি যেমন বিপদে পড়বে বলে ভেবেছিল সবাই,তেমন কিছু হলনা।সবকিছু স্বাভাবিক সুন্দর নিয়মে চলতে লাগল।চাষবাস,ব্যাবসা,বড় ছেলের পড়া সব।
একদিন,কুরবান মারা যাবার দুই বছর পরে ,এক বয়স্কা আত্মীয়া কুরবানের বৌয়ের সাথে রাতে এক ঘরে ঘুমাতে গিয়ে শুনল বৌটি যেন কার সাথে কথা বলছে।পালঙ্ক থেকে নীচে মেঝেতে বসে বড় এক ঘোমটায় মুখ ঢেকে বারান্দায় থাকা কারো সাথে কথা বলছে সে।ওই মহিলা পুরুষ কন্ঠও শুনতে পেল।
কার সাথে কথা বলছে বিধবা বৌ!কি কথা !
কান পেতে শুনে বোঝা গেল যে সংসারের নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা হচ্ছে।
পরদিন আত্মীয়া জিগ্যেস করে কোন সদুত্তর পেলনা।
পরের রাতে আবারো একই ঘটনা।এবার মহিলা খুব সন্তর্পনে উঠে সহসা দরজা খুলে দেখে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বারান্দা।কেউ নাই।আশেপাশেও কেউ নাই।
-কার সাথে কথা কইতেসিলা তুমি? অ বৌ কার সাথে কথা কও?
-কারো সাথে না।
-ছি ছি তুমি পরপুরুষের সাথে…
-না না ! এইসব কি বলেন !
-আমি নিজের কানে শুনলাম যে!
-আপনে ভুল শুনছেন।
-না আমি ঠিকই শুনেছি।কে ছিল !
-উনি আসছিলেন,উনার সাথে কথা কই।
-উনি মানে কে?কুরবান?
-জ্বী।
আধ্যাত্মিক ব্যাপার স্যাপার গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে ভালবাসে।এই ব্যাপারটিও তারা বিশ্বাস করল।
কিন্তু আর কেউ কোনদিন বৌটিকে রাতে কথা বলতে শুনলনা।প্রকৃতপক্ষে বৌটি কথা বলাই প্রায় বন্ধ করে দিল।
তার মাঝেও কিছুটা আচরণগত অস্বাভাবিকতা দেখা দিল।ওই ঘটনার আড়াই বছরের মাথায় বৌটি মারা যায়।ক্রমশঃ
[বিঃ দ্রঃ কুরবান আলির বড় ছেলে ফজলুল বারী আমার পিতামহ।উনার গল্প পরের পর্বে আসবে।
কুরবান আলির দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সোনারূপার সুতার কারুকাজ করা শাড়ি টি এখনো আছে।আর কিছু নাই।
আমার ধারনা প্রথম বৌটির মাঝেও মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল।যদিও তা কেউ বলেনি কখনো।সমস্যার কারনেই তার মাঝে দ্বৈতসত্ত্বা কাজ করত।সে নিজেই হয়ত রাতে দুই রকম গলায় কথা বলত।নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই এইভাবে বের করত।]
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। 🙂
ঠিকাসে রায়েদ !
এটেনশান হইয়া বইসা থাকো।
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
হাজার বছর ধরে আর হাসুলী বাঁকের উপকথার মিশেল একটা অনুভূতি পেলাম। উফ!! :boss:
পূর্বপুরুষের কাহিনী জানতে পারা (মুখে মুখে হোক আর লিখিত হোক) সৌভাগ্যের ব্যাপার। প্রথমে পিতা তারপরে পিতামহ আমি অনেক ছোট থাকতেই মারা গেলেন। চাচারা খুব একটা বেশী কিছু জানেন না বা মনে না নাই বা তাদের বলা হয় নি। তাই আমার আর জানা হলো না আশুগঞ্জের চর চারতলা গ্রামে সরকার বাড়ির গোড়াপত্তন কবে, কিভাবে?
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়! 😀 (সম্পাদিত)
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
মোকাব্বির,
হয়তো তুমি ই লিখবে নতুন ইতিহাস,তাই আগেরটুকু ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
আমাকে এইসব খুব টানে।জানো আমি পিছনের ১৩ পুরূষ পর্যন্ত বংশলতিকা সংগ্রহ করেছি।
লিখব।
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
অসাধারণ। আস্তে ধীরে দিয়ে দেন! এসব কাহিনী পড়তে খুব ভাল লাগে। কল্পনা শক্তির ধার পরখ করা হয় আমার! 🙂
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
পরের পর্বের জন্য এটেনশান হইয়া বইসা থাকলাম।
ধন্যবাদান্তে,
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১
["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]
গুড শাওন !
ইচ্ছে হলে :teacup: খাবার ব্রেক নিতে পার। 🙂 🙂
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
আমার পূর্বপুরুষের কাহিনী লিখতে উদ্দীপ্ত হলাম 😉
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
লিখুন ভাইয়া।
অপেক্ষায় থাকলাম।
🙂
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
:boss:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
:boss: :boss: :boss: আপনাকে
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ধন্যবাদ রাজীব,
ঢাকায় একটা মজার শীত পড়সে।আসো গুড়ের :teacup: খাই।
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
আহা গুড়ের চা, একটু কুয়াশা, শীতে কাঁপতে থাকা হাতে জিভ না পুড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক! :(( :((
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\