ভাল থাকিস পলেন

২০০৫ থেকে  ২০১২ ,মাঝে সাতটা বছর কেটে গেছে, আমাদের সবার জীবন টাই এখন অন্যরকম, জীবনের পালাবদলে আমরা আলাদা একেকজন অন্যরকম মানুষ হয়ে গেছি। অনেক অনেক দিন ভাবি, পলেন কে নিয়ে কিছু লিখব।কিন্তু আমরা তো সেই টিপিক্যাল বাঙ্গালি, যা ভাবি তা করে উঠতে বছর পার হয়ে যায় । বড়সড় উপলক্ষ না পেলে আমরা কোন কাজ ই করিনা। আজ ১১ ই ফেব্রুয়ারি, পলেনের আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আজ ৭ বছর।  অর্ধেক ক্লাসমেটের বার্থডে মনে থাকেনা, কিন্তু ফেব্রুয়ারি আসলেই কেন যেন মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে , ক্লাসমেটগুলা এক জায়গায় হলে ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন যে বিষাদ টা ভর করে, আমরা অনেকে এখনও পলেন কে স্বপ্নে দেখি, সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে একটা কান্না দলা বেধে গলায় আটকে থাকে। আরেকটা ক্লাসমেট কে যে বলব ,তাও পারিনা,কারণ এই অনুভূতি টা যে আমাদের সবার ই একরকম।

পলেন চলে যাওয়ার পর কলেজে আমাদের বাকি দিনগুলা ছিল আসলেই ছন্নছাড়া। এই অনুভূতি টা বোঝানো যাবেনা,বুকের মধ্যে হাহাকার টাইপ। তখন ভাবতাম কলেজ থেকে বেরিয়ে পলেনের বাবা মায়ের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখব,তারা যেন ৪৯টা মেয়ের ভিড়ে একজন পলেন কে মনে করে কাঁদতে না পারেন। কিন্তু আমরা যা ভাবি,কেন যেন অধিকাংশ সময় টা আর হয়ে ওঠেনা। প্রথম প্রথম পলেনের বাসায় আমরা দলবেঁধে ক্লাসমেট রা যেতাম। ওই বাসায় গেলেই আমাদের মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরুত না আন্টি আঙ্কেল এর কষ্ট দেখে,পলেনের ছোট বোনটাও নিজের অজান্তে শৈশব কে আড়ালে রেখে দিত।অনেক পরে জেনেছি যে পলেনের বোনটা আমাদের উপর অভিমান ছিল,কেন আমরা পলেনের জন্য ন্যায়বিচার চাইছি না।  যে কথা টা না বললেই না, আন্টি আঙ্কেলের কাছে কয়েকটা উড়ো চিঠি ছিল,যাতে বলা হয়েছিল, পলেনের চলে যাওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ দায়ী, সেই সূত্র ধরে আন্টি আঙ্কেল আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করতেন যেন আমরা যা জানি তা বলে দেই,আমরা যেন মুখ খুলি, কোন চাপ কে পাত্তা না দিয়ে পলেনের জন্য ন্যায়বিচার এর জন্য তাদের পাশে দাড়াই। অসহায় বাবা মায়ের শেষ ভরসা ছিলাম আমরা। কিন্তু তাদের কোনভাবেই যে বুঝাতে পারতাম না, আমরা যদি আসলেই কিছু জানতাম ,তাহলে আমাদের কে অনুরোধ টাও তাদের করা লাগতনা, ক্লাসমেট যারা শেষপর্যন্ত ওর সাথে ছিল,তারা সবাই জানি এই অভিযোগ টা যে অসম্ভব, আমরা কেমন করে কাউকে বুঝাব যে ,আমরা ছয় বছর পলেনের পাশে থেকেও, কেন ওর অভিমানটুকু বুঝতে পারলাম না, কি জন্য পলেন সুইসাইড করল,তার কারণ টা পর্যন্ত জানতে পারলাম না। আমরা নিজেরাই যে এর উত্তর টা জানিনা,অনেক বড় একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন রেখে গেছে পলেন আমাদের জন্য।  যারা আমাদের বাবা মা,তারা সন্তানের মঙ্গল চিন্তায় অনেক আশঙ্কা করতেই পারেন, না বুঝতেই পারেন কলেজ আমাদের কিভাবে আগলে রেখেছিল ছয়টা বছর, পলেন চলে যাওয়ার পর প্রতিটা স্যার ম্যাডাম নিজের সংসার ছেড়ে কিভাবে সবসময় আমাদের পাশে থেকেছেন, কিন্তু যারা ক্যাডেট ,তারাও পরে অনেকসময় এই বিষয়ে সন্দেহের আঙ্গুল তুলেছে, তীব্র অভিমান আর না বুঝাতে পারার অসহায়ত্ব টা তখন আমাদের কে কুরে খেয়েছে। আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন মনে এসেছে,কিন্তু কেন জানি আমাদের কথা বেশিরভাগ ই বিশ্বাস করেনি। কলেজ থেকে বের হওয়ার পর বাইরের অনেকেই তীব্র কৌতূহল  নিয়ে জিজ্ঞাসা করত, “ আসল কাহিনী কি রে” ,সত্যি কথা টা বলে যখন তাদের মুখের দিকে তাকাতাম,অবিশ্বাসের ছায়া থাকত স্পষ্ট। প্রথমদিকে খারাপ লাগত,পরে সয়ে গেছিল।

পলেন চলে যাওয়ার মাস দুয়েক পরে কলেজে থাকতেই একদিন হাউস বেয়ারা খবর দিল,জুনিয়র ব্লকে কোন একটা ক্লাস নাইন বাথরুম এ শাওয়ার স্ট্যান্ড এ ওড়না বেধেছে সুইসাইড করবে বলে,সেদিন আমরা সবাই ছুটে গেছিলাম জুনিয়র ব্লক এ,সবার অনুরোধে জুনিয়র টা কে বের করার পর জানা গেল,সিনিয়র এর কাছে পানিশমেন্ট খেয়ে সে মরতে যাচ্ছিল। আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল,একটা ক্লাসমেট হারানোর কষ্ট যে কত তীব্র তা যদি ওকে বোঝাতে পারতাম……

আমরা সবাই এখন যার যার মত ভালো আছি , একসাথে হলেই চিল্লাপাল্লা,হাসাহাসি আর কলেজ লাইফের স্মৃতির সাতকাহন , শুধু একটাই অপূর্ণতা, আমরা ৪৯ জনের জায়গায় যদি ৫০ জন একসাথে হাসতে পারতাম………

ভালো থাকিস পলেন অভিমানের দেশে…… অনেক অনেক ভালো

১,৭৯৬ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “ভাল থাকিস পলেন”

  1. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    ভাল থাকিস রে বোন .........


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    ভালো থাকেন আপু


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  3. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    ক্যাডেট কলেজে থাকতে শুনেছিলাম।প্রচণ্ড খারাপ লেগেছিল।
    আপু লুব্ধক হয়ে বেচে থাকুক আপনাদের আমাদের সবার মাঝে।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
    • সামিয়া (৯৯-০৫)

      হুম, আসলেই ও আমাদের সবার মাঝে না থেকেও আছে। কালকে থেকে এই পোস্টে ঘুরাঘুরি করছি, কি লিখব বুঝতেসি না। ১১ তারিখটা আমি ভুলি না কেন?
      সেইদিন হাঁটতে হাঁটতে ওর বাসার ওইদিকে গেসিলাম। কেমন জানি লাগল। যেতে চেয়েও যাই নাই।

      জবাব দিন
  4. রিদওয়ান (২০০২-২০০৮)

    সকালে উঠেই ঘটনাটা শুনতে পেয়েছিলাম আমরা। আমাদের কলেজে পলিন আপুর ব্যাচমেটরা সেই ভোরে খবর পেয়ে তিন হাউসেই পোস্টারিং করেছিল। ক্যাডেট কলেজের এই এক সমস্যা, আবেগের কোন মূল্য নেই। সেই পোস্টারগুল কলেজ কর্তৃপক্ষ ছিড়ে ফেলে। পলিন আপু ঘুমিয়ে থাকুক পরম শান্তিতে, স্রস্টা সহায় হোন তার।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।