আমার জীবন, আমাদের জীবন : থমকে যাওয়া মুহূর্ত
১. ক্লাস নাইনের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষার প্রায় শেষ মুহূর্তে হঠাৎই একটা শোরগোল, একটা খারাপ কিছুর গুঞ্জন টের পেলাম। পরীক্ষার ইনভিজিলেটর দুইজনের মধ্যে একজন আরেকজনকে বলে হুড়মুড় করে চলে গেলেন। কি হল জানতে না জানতেই মিনহাজ ভাই ক্লাসের দরজার সাথের তালাটা খুলে দিয়ে ফর্ম লিডারকে রিকোয়েস্ট করে গেলেন জানালা আটকে দিয়ে দরজা বন্ধ করে তবেই বের হতে। খাতা জমা দিয়ে বাইরে বের হতেই শুনি কোন টিচারের বাচ্চা নাকি খেলতে যেয়ে পুকুরে ডুবে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক – কলেজ মাইক্রোবাসে করে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইভাকুয়েট করা হচ্ছে। ডাইনিং হলে যেতে কোন লাইন ধরতে হলো না। খেতে বসতে না বসতেই জানলাম ডেমোন্সট্রেটর শাহআলম স্যারের (ক্যামিস্ট্রি) মেয়ে। খাওয়ার চেয়ে উতকন্ঠিত গুনগুনই বেশি হচ্ছিল। হঠাৎই পর্দার ফাঁক দিয়ে কলেজ মাইক্রোবাসের সাদা ঝলক দেখা গেল। আমরা জানলাম মেয়েটা চলে গেছে, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়নি।
এরপরের হিসাব নিকাশ খুব সহজ। অতি অল্প সময়ে সাদা কাপড় পড়ে প্রস্তুত হয়ে যায় সেই ছোট্ট মেয়েটি। আমরা গেমস টাইমে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে জানাজার নামাজ পড়ি (এটাই কলেজে পড়া একমাত্র জানাজার নামাজ)। ভূতগ্রস্তের মতোন সারিবদ্ধভাবে প্রথম ও শেষ দেখা দেখি কোনদিন না দেখা মেয়েটিকে। তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যাই। কিন্তু স্যারের চোখে মুখে স্থায়ী হয়ে থেকে যায় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বোঝা বহনের স্পস্ট চিহৃ।
২. ক্যামিস্ট্রি ল্যাবে আমাদের ক্লাসের সময় সহায়তা করতেন ঢালী আংকেল। সৌম্য চেহারা এবং স্থিতধী চরিত্রের ঢালী আংকেল সবসময়ই অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। ক্লাস টুয়েলভের শেষের দিকে এক ল্যাবরেটরী ক্লাসে আমি এসিড – টেস্টটিউব নিয়ে ব্যস্ত। পাশ থেকে শুনলাম আমাদেরই একজন ঢালী আংকেলকে জিজ্ঞাসা করছে, “আংকেল আপনার ছেলে আর্মিতে না”? কথাটা কানে যেতেই চট করে চোখ তুলে তাকালাম। দেখি ঢালী আংকেলের মোটা ফ্রেমের চশমার পিছনে চোখে চিকচিক করছে গর্বের আভা। তিনি টুক করে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে দিলেন। ক্লাসের পরে জানলাম ভাইয়া কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের এক্স ক্যাডেটও বটে। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে এরকম একটা তথ্য এতদিনে জানলাম! অথচ কলেজের সব কর্মকর্তা কর্মচারীর ছেলে বা মেয়ে যারাই ক্যাডেট কলেজে পড়েছেন তাদের খবর আমরা ঠিকই রাখতাম।
এরপর লম্বা একটা সময় এ বিষয়ে আর কিছুই জানার সুযোগ হয়নি। কিন্তু যখন জানলাম তখন মনে হয়েছিল এরকম জানাটা না জানলেই ভালো হত। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সিয়েরা লিওন থেকে ছুটিতে দেশে ফেরার পথে বেনিনে বিমান দূর্ঘটনায় আমাদের যে ১৫ জন শান্তিরক্ষী কর্মকর্তা মৃত্যুবরণ করেন তার মধ্যে ঢালী আংকেলের ছেলে ক্যাপ্টেন ফরিদও একজন। আমি মনে করতে পারি না শেষ কবে অশ্রুপাত করেছি। কিন্তু সেসময় আমি সত্যি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কম্ব্যাট পোষাকের সাথে অশ্রু বড় বেমানান হলেও মনে হয়েছিল এ তো এক সতীর্থের জন্য কান্না। এ তো এক বড় ভাইয়ের জন্য কান্না। আত্মায় আত্মায় সম্পর্ক যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়, আর ক্যাডেট কলেজের সাথে যদি আমার সম্পকর্টা আত্মায় আত্মায় হয় তবে এই কান্না একজন আত্মীয়ের জন্য কান্না। এই কান্নায় কোন বাধা থাকা উচিৎ নয়।
উৎসর্গ : যারা পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে ভারী বোঝা প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াচ্ছেন।
************
এখানের অভিজ্ঞতাগুলোও আগে এক জায়গায় (বেক্সকা রিইউনিয়ন সাময়িকী’ ২০০৮) শেয়ার করেছি। কিন্তু ওখানে পৃষ্ঠার অভাবে অনুভূতির প্রকাশ অনেকটাই সীমিত ছিল। এখানে সেটাকেই ঘষামাজা করে, আরও কিছু যোগ করে নতুন করে দেয়ার প্রয়াস পেলাম।
(সমাপ্ত)
...............
অনেক খুঁজেও কমেন্ট করার মতো কিছু পেলাম না।
কখনো নিরবতাই সবচেয়ে বেশি সরব......।
তোমার হৃদয় কি বলেছে তা এই ব্লগের কারও জানতে বাকি নেই।
Life is Mad.
কেমিষ্ট্রি স্যার ছিলেন, নামটা একদম মনে করতে পারছিনা, উনার ওয়াইফ, প্রেগন্যান্ট ছিলেন, কি এক জটিলতায় মারা গেলেন। স্যার এর এক ছেলে কোন এক ক্যাডেটে পড়তেন, তিনি আসার পর আমরা জানাজা পড়লাম, রাত মনে হয় দশটা।
কি বলবো দোস্ত বুঝতেছিনা..
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
সায়েদ ভাই নতুন টুশকি না দিয়ে এইটা কি দিলেন। মনের উপর দিয়ে অত্যাচার গেল।
তাড়াতাড়ি টুশকি দেন তো একখান ।
১ম ঘটনাটি মনে করে মন খারাপ হল। ২য় ঘটনাটি জানা ছিল না। স্পষ্টতই কষ্ট পেলাম।
ধন্যবাদ বস শেয়ার করার জন্য
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
সেই ঘটনার পর থেকে শাহ-আলম স্যারকে দেখেছি সিগারেট খেতে...নিয়মিত...অন্তত আমরা কলেজে যতদিন ছিলাম। কলেজ হাসপাতালে স্যারের স্ত্রীর সেই মর্মান্তিক কান্না আজো আমার চোখে ভাসে। প্র্যাকটিকাল ক্লাশে স্যার একদিন বলছিলেন,"এখান থেকে চলে যাব পোস্টিং নিয়ে। এখানে থাকলেই মেয়েটার কথা বেশী মনে পড়বে।"
ঢালী আংকেল ছিল আমাদের ব্যাচের নাসিরের কি রকম যেন আত্মীয়। তাই কলেজে থাকতে ফরিদ স্যারের অনেক গল্পই নাসিরের কাছ থেকে শুনতে পেতাম। ফরিদ স্যার আর্মিতে চান্স পাবার পরে (তখনো বিএমএ'তে জয়েন করেননি) এক দিন সকাল বেলা দেখছিলাম কলেজ হসপাতাল থেকে বাবা এবং মা এর সাথে হেটে হেটে আসছিলেন। সকাল বেলা আমরা তখন মাঠে ছিলাম আ্যথলেটিক্স উপলক্ষে। মাঝখানে ফরিদ স্যার আর একপাশে তার বাবা আর অন্য পাশে মা। খুব সুখী একটা পরিবারের দৃশ্য ছিলো সেটি। তিনজনের চোখে মুখেই ছিল অনাগত সুখের দিনগুলোর স্বপ্ন।ছেলের সাফল্যে গর্বিত পিতা মাতা। আ্যথলেটিক্স গ্রাউন্ডে এক স্যার এসেছিলেনও আমাদের অনুরোধে। আর্মিতে যারা ইন্টারেস্টেড ছিলো তাদেরকে ব্রিফ করার জন্য। সেই ফরিদ স্যারের মৃত্যু সংবাদ যখন শুনি, তখন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। এয়ারপোর্টে তার বাবা-মা'র অশ্রুসিক্ত মুখ টিভি'র পর্দায় দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।
প্রকৃতি কেন এত কষ্ট নিয়ে আসে আমাদের জীবনে???
আহসান ভাই,
আমি অপেক্ষা করে ছিলাম আমার এই আর্টিকেলটায় আপনার পার্টিসিপেশনের জন্য। থ্যাংকস।
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি সবাইকে এত আপন লাগে কেন? যাকে কোনদিন দেখিনি তার জন্য হৃদয় এত কাঁদে কেন? তারপর হঠাৎ করেই সবার ভিতরে আমি আমার নিজেকেই খুঁজে পাই। সত্যিই বুঝি না
Life is Mad.
মানুষকে এক মুহূর্তে আপন করে নিতে সবাই পারেনা। তুমি পারো বলেই এমন হয়...। আমি মনে করি এটি একটি অসাধারন গুন...। তবে হ্যা, কষ্ট পেতে হয় অনেক...।
থ্যাংকস আহসান ভাই।
আপনি এত বড় করে বলেছেন যে নিজেকে সেইরকম ভাবতে অযোগ্য লাগছে।
দোয়া করবেন।
Life is Mad.