এথিনা বিষয়ক জটিলতা

বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমিতে আমরা তখন তৃতীয় টার্মে উঠেছি। শামীম, রাজু, রনিসহ কোর্সমেটরা অনেকে ল্যান্স কপোর্রাল, কপোর্রাল র‌্যাঙ্ক পড়ে ক্যাডেট ব্যাটালিয়ন পরিচালনায় অংশগ্রহণ করছে। ওদের সাথে আমরা সাধারণ জিসিরাও (জেন্টলম্যান ক্যাডেট) খানিকটা হাত মকশো করি মাঝে মধ্যে। দুই দুইটা টার্মের সিনিয়র, কম কথা নয়। এরই মাঝে একদিন একটা চিঠি এসে আমার মাথা ঘুরিয়ে দেবার অবস্থা করল।

চিঠিপত্র মোটামুটি ভালোই লিখতাম, পেতামও সমান তালে। বাবা, মা, বোন, আত্মীয়, বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র,শিক্ষক ইত্যাদি বহুবিধ সম্পর্কের মানুষের সাথে চিঠি লেনদেন আমার জন্য কমন ব্যাপার ছিল। দেশে-বিদেশে সব জায়গাতেই পৌঁছে যেত আমার চিঠি। একমাত্র বান্ধবী হিসেবে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং মার্কা চিঠি পেতাম সেতুর কাছ থেকে। তাও তার চিঠি জুড়ে ওর প্রাণপুরুষ ‘তসবীর’ (আমার ছয় বছরের রুমমেট) সম্পর্কে সাতকাহন থাকত। তাই আমার এইরকম অভ্যস্ত গন্ডীর পত্রালাপের মধ্যে একটা চিঠির সম্বোধন যখন “জান আমার” পেলাম তখন চোখে রীতিমত শর্ষেফুল দেখতে থাকলাম।

সারা চিঠি উল্টে পাল্টে কোথাও আমার নাম পেলাম না। প্রেরকের নামের স্থানে লেখা, “মুন্নী, বরিশাল”। প্রায় চার পৃষ্ঠার চিঠিটা গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, আবেগের ফল্গুধারা যেন। লিখেছে তার ভালোলাগার কথা, ভালোবাসার কথা, চোখে চোখ রেখে অবিরাম কথা বলার কথা। সাথে যোগ হয়েছে দোতলার ছাদে হাতে হাত রেখে হাঁটাহাঁটি, হিলিবিলি খেলে যাওয়া বাতাসের কথা, একমাত্র স্বাক্ষী হিসেবে গোল উজ্জ্বল চাদেঁর কথা। প্রতিটা লাইনে অতীতের কিছু না কিছু ভালোলাগার স্পর্শ আছে। অনবদ্য একটা প্রেমপত্র। বিএমএ’তে অবস্থানরত যে কোন ‘মাইল টেস্ট’ ফেল প্রেমিকের জন্য এক ধাক্কায় দশ পাওয়ার মতো তেজ সম্পন্ন একটা প্রেমপত্র!!

কিন্তু…..আমার জন্য উল্টা ঝামেলা হয়ে গেল। চিঠির বর্ণনার কোন কিছুই আমি মনে করতে পারছি না, মুন্নী নামে কাউকে তো নয়ই। মনে করতে পারছি না কারণ এসব কোন কিছুই আমার জীবনে ঘটেনি। খুব মনোযোগ দিয়ে খামটা দেখলাম। আমারই নাম, আমারই ঠিকানা – কোন ভুল নেই। এবার চিঠিটার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করলাম। বরিশাল ক্যাডেট কলেজে ছিলাম বলে ‘বরিশাল’ খানিকটা গুরুত্ব পেতে পারে কিন্তু “মুন্নী” কখনোই না। গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো (!) টেক্সট মার্কার দিয়ে দাগালাম। আমার সাথে কেউ রসিকতা করছে ভেবে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সন্দেহ করা শুরু করলাম। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দুপুরের নাতিদীর্ঘ ঘুমটা হারাম হলো, রাত্রের খাবার মাথায় উঠল (পরে অভিজ্ঞজনেরা বলেছে প্রথম প্রথম প্রেমপত্র পেলে নাকি এরকমই প্রতিক্রিয়াই হয়!!)।

শেষমেষ সহ্য করতে না পেরে খুব কাছের বন্ধু শামীমকে “বস্তু” দেখালাম। ও খুব একচোট হাসল। তারপর পুরো চিঠি পড়া শুরু করল। খানিক্ষণ মাথা ঘামিয়ে হঠাৎ করেই ও আমার আরেক বন্ধু শিব্বিরের কথা বলল – যে কিনা কেবল তখন বিএমএ’তে যোগ দিয়েছে। আমার অন্যান্য হিসাবও
এবার মিলতে শুরু করল। শিব্বির এখানে আসার আগে ওর আত্মীয়দের (!) আমার ঠিকানা দিয়ে এসেছিল। আমার কাছে শিব্বিরের নামে কোন চিঠি আসলে তা যে ওর হাতে সহী সালামতে পৌঁছে যাবে তাতে নিশ্চয়তা ছিল শতভাগ। সেই ধারাবাহিকতাতেই মুন্নী চিঠি পাঠিয়েছে। আবেগের তোড়ে শিব্বিরের নামটা উড়ে পুড়ে গিয়েছিল বলেই না এত ঝক্কি। শিব্বিরের হাতে চিঠি পৌঁছে দিতেই আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন।

এর ছয় মাস পরে আমরা সবাই যখন ঘটনাটা একরকম ভুলতে বসেছি, তখন শামীম আর রাজু কবর থেকে সেটাকে তুলে রীতিমত জ্যান্ত করে ফেলল। ওরা আমার চিঠি পাওয়ার প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে কাকে “বাকরা” বানানো যায় তা ঠিক করে ফেলল। হামিদ কোম্পনীতে আমি,
রনি, আশিক আর মোস্তফা কোম্পানীতে শামীম, রাজু মোট এই পাঁচজন বরিশাল ক্যাডেট কলেজে (মোট ১৪জন ছিলাম আমরা তখন বিএমএ’তে) একসাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি বলে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নাড়ী নক্ষত্র জানি। একটা অপ্রত্যাশিত ধামাকা টাইপ প্রেমপত্র কাকে সবচাইতে বিচলিত করতে পারে তা নির্বাচন করতে শামীম, রাজু মোটেও ভুল করেনি।

বিএসসি’র পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার দুদিন আগে আমার রুমে বসে আমি আর আশিক পড়ছিলাম। সেখানে শামীম এসে জড়ো হওয়ায় একটা আড্ডার পরিবেশ সৃষ্টি হল। শামীমই জানালো ও আর রাজু মিলে একটা প্রেমপত্র লিখে ঢাকা থেকে মোশতাক ভাইয়ের (শামীমের বড় ভাই) সহায়তায় পোস্ট করার ব্যবস্থা করেছে এবং সেটার প্রাপক আমাদের ‘রনি’। চিঠিটা যে কোন সময় রনির হাতে এসে পৌঁছানোর কথা। এই কথাগুলো শেষ হওয়া মাত্রই (কোন সন্দেহ নেই – কো ইনসিডেন্স) রনি বিচলিত চেহারা নিয়ে আমার রুমে ঢুকল এবং ঠাশ করে একটা ‘এয়ার মেইল’ খাম সবার সামনে টেবিলের উপর রাখল। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো রনির চেহারায় হাসি, বিব্রত, অবাক, অবিশ্বাস, বোকাভাব সব মিলিয়ে যে একটা বিচিত্র অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল তা কেবল আমাদের স্মৃতিতেই তোলা থাকবে। সব ঘটনা জানি বলে আমাদের একটু অভিনয়ের আশ্রয় নিতে হল। চোখ কপালে তুলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি”? রনি বিড়বিড় করে কি যেন একটা বলল। ততক্ষণে আশিক খামের ভিতর থেকে চিঠি বের করে পড়া শুরু করেছে। দুই লাইন পড়তে না পড়তেই আশিকের সে কি উদ্ধাহু নৃত্য, আর সে কি ঠা ঠা হাসি – কিছুতেই যেন শেষ হতে চায় না। খানিকটা ধাতস্থ হলে চিঠিটায় যা পাওয়া গেল, তা মোটামুটি এরকম:

প্রিয় রনি,

খবর কি ‘জান’? কেমন আছ? ভালো আছ নিশ্চয়ই। ভালোই যদি না থাক তবে আমায় ভুলে আছ কি করে? অবশ্য বিএমএ’র মতোন জায়গায় কতটুকু ভালো থাকা যায় তা আমার কাছে পরিস্কার নয়।

সোনা – তোমার মনে আছে, আমি বলতাম আমার একটা নিজস্ব আকাশ আছে। আমার সেই আকাশটা তুমি। আমার প্রতিটা ভোর হয় তোমাকে ঘিরে। ভোরের অরুণিমা তোমার কথাই মনে করিয়ে দেয়। রাতে ঘুমানোর সময় যে ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে সে তো শুধুই তুমি। তবেই বলো –
আমাকে দেয়া কথা তুমি ভুললে কি করে? হতে পারে আমাদের পরিচয় অল্প সময়ের। কিন্তু তাতে যে অতলান্তিকের গভীরতা…..। আমি আমার কথা রাখলাম। এইবার তোমার পালা। একটা মেয়ে যে কতটা ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করতে পারে তার উদাহরণ তুমি পাবে।

তোমার চিঠির অপেক্ষায়, ফোন নম্বর হাতে করে বসে আছি।

ইতি,
তোমারই “এথিনা”

এইবার রনি পড়লো আমাদের তোপের মুখে। বলো বাবা এই মেয়ে কে? কি করে? কোথায় পরিচয়? দেখতে কেমন? ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনজনের আড্ডার পরিবেশ চারজন হওয়াতে হাট বাজার হয়ে উঠল। মুন্নীর চিঠি পেয়ে আমার যা হয়েছিল রনিরও তাই হল। ঘুম হারাম হল, খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠল, আর বোনাস হিসেবে পড়াশুনা চাঙ্গে উঠল। এক পর্যায়ে ওর টেনশন দেখে তো ভয়ই পেয়ে গেলাম – পরীক্ষায় আবার লাড্ডু খেয়ে না বসে। যাই হোক, প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে রনি কাগজ কলম নিয়ে বসল। এথিনাকে লেখা রনির চিঠিটা যথারীতি মোশতাক ভাইয়ের হাত ঘুরে আমাদের হাতে এসে পৌঁছুল। আমরা চিঠির পাঠোদ্ধারে দেরী করি না –

প্রিয় এথিনা,

আমার মনে হয় ইউ আর এ্যান ইমাজিনারী ক্যারেক্টার – আমার বন্ধুরা ফাইজলামি করছে। তা যদি না হয়ে থাকে তবে তোমার সাথে আমার Mentor’s এ কোচিং করার সময় পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু কি করব বল সময়ের সাথে এখানের ঘাম ঝরানো দিনগুলো আমার স্মৃতি থেকে তোমার
চেহারাও সরিয়ে ফেলেছে। তোমাকে দেয়া কথাও আমি ভুলে গেছি। ইন ফ্যাক্ট আদৌ কোন কথা দিয়েছিলাম কি না তাতেও আমার ঘোর সন্দেহ আছে।

যাই হোক, তোমার ফোন নম্বরের অপেক্ষায় রইলাম। ভালো থাক।

ইতি,
রনি

আমাদের কল্যাণে “এথিনা” গল্পটা পাখা মেলে উড়াল দিল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে এবং জাপান, কানাডা, মালয়েশিয়ায় আমাদের বন্ধু মহলে। অবশ্যই গোপনীয় অংশ গোপন রেখে। সবার মুখে “রনি-এথিনা” “রনি-এথিনা”। এথিনা দেখতে কেমন তারও একটা বর্ণনা বেরিয়ে গেল। গুজব যেমন দ্রুত ডালপালা মেলে, এথিনাও তেমনি ডালপালা মেলতে শুরু করল। কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয়েছে এদিকে রনি – এথিনার মধ্যে।

পরবর্তীতে কমিশন পূর্ববর্তী ব্যস্ততার সময় এথিনা চিঠি লেখা একরকম বন্ধই করে দিল। কমিশনের পর কয়েক মাস এথিনা ব্যাপারটা বেশ চাঙ্গা ছিল মুখে মুখে। পরে একান ওকান হতে হতে রনির কাছে আসল সত্য বেরিয়ে পড়েছিল। প্রসঙ্গটা নিয়ে এখনও আমাদের মাঝে তুমুলভাবে হুল্লোড় ওঠে।

ও হ্যাঁ, বিএসসি পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে রনি খুব ভালো নম্বরসহ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। রনি এখন তার জীবনে আসল এথিনার সাথে টোনাটুনির সংসার করছে। পাঠক, ওদের জন্য দোয়া করবেন।

***********

গল্পটা পূর্বে আরেকটা ম্যাগাজিনে (এমআইএসটি’র ইইসিই ডিপার্টমেন্টের Impulse) ছাপা হয়েছিল। প্রায় চোখে না পড়ার মতোন অল্প কিছু পরিবর্তন (মাইর থেকে বাঁচার ক্ষুদ্র প্রয়াস আর কি) করে এখানে সবার সাথে শেয়ার করলাম।

২,৯৫৮ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “এথিনা বিষয়ক জটিলতা”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আমাদের সায়েদ ভাইও কিন্তু উনার এথিনাকে(আমাদের ভাবী)নিয়া টোনাটুনির সংসার করতেসেন। ইয়াহুতে নক করলেই মুচকি হাইসা কন-তোর মামির লগে কথা কইতাছি...আমিও আর কাবাব মে হাড্ডী না হয়া সালাম দিয়া চইলা আসি।
    ঝাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন-মামির কথা কয়া আমারে ব্লাফ দেয় না তো? নাকি মামির নাম কইরা আফ্রিকান কুনু মডেলের লগে কতথা কয়... 😀 (আমি পলাই এইবার)

    জবাব দিন
    • সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

      পুরো ঘটনাটা মাত্র আড়াই/তিন মাসের। আমরা সেই সময় টানা সাড়ে পাঁচ মাস ছুটি পাই নাই (এটাই নিয়ম)। আর পাসিং আউটের আগ দিয়ে এথিনা (!) চিঠি লিখা বন্ধই করে দিছিল। প্রাপকের ঠিকানায় গেলে কি পাইত জান 😀 ? কয়েকজন ব্যাচেলর মিলে ভাড়া করা একটা ফ্ল্যাট 😛 😛 !! আর এথিনার চিঠি তো তৈরী হোত আমাদের রুমেই 😛 ।


      Life is Mad.

      জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    নাকি মামির নাম কইরা আফ্রিকান কুনু মডেলের লগে কতথা কয়…

    ভাতিজা/ভাতিজির গায়ের রঙ কি হইব চিন্তা করতেছি... :dreamy:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    এট্টা পুরানো দিনের হিন্দি গান মুনে পইড়া গেলঃ
    "আজকাল তেরেমেরে পেয়ার কা চার্চে হ্যায় জাবান পার,
    সাব কো মালুম হ্যায় আউর সাবকো খাভার হ্যায়!"
    (সাদা শাড়ি পরা পুরানো দিনের হিন্দি নায়িকা মুমতাজের তুষারশুভ্র মধ্যদেশ এখনো মনে দোলা দেয়...)

    অফ টপিকঃ পড়ুন "তেরে মেরে" = "রনি এথেনা"

    প্রশ্নঃ কমেন্টটা কি একটু উল্টাপাল্টা হয়া গেছে?তাইলে মডু ভাইজান মুইছা দিয়েন মাইন্ড খামুনা 😛

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।