আজ ১৪ই জুন – বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। আমার ছোট্ট বিশ্বে অবশ্য রক্তদান দিবসটি হচ্ছে ১লা জুন। ৩৭ বছর আগে এই দিনটিতে প্রথম শুরু করি রক্ত দেওয়া। ঢাকার মহাখালীর কলেরা হাসপাতালে আমার মেয়ে তখন তার প্রানের জন্যে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ছোট্ট মেয়ে আমার – মাত্র এক মাস হয়েছে তখন তার বয়েস। এই এক মাসের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সময় কেটেছে হাসপাতালের বিছানায়। প্রথমে তার ছোট্ট হাতে সূচ ঢুকিয়ে সালাইন দেওয়া হচ্ছিল। পরে দেখা গেল ঐ ছোট্ট হাতে আর সূচ ফোটাবার মত শিরা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এবার পায়ের শিরাতে সূচ ঢুকালো ডাক্তারেরা। কিছু দিন পরে দেখা গেল পায়ের শিরাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মাথার সুন্দর ঘন কাল চুল কামিয়ে ফেলে এবার মাথার মধ্যে সূচ ঢুকিয়ে ডাক্তাররা সালাইন দিতে লাগল। মাথার মধ্যে সূচ ঢোকান অবস্থাতে একটা ছোট্ট বাচ্চা কি ভাবে সারাক্ষণ থাকবে। আমার মা থাকতেন তার সাথে সারাক্ষণ – দিনে আর রাতে।
আমিও এক দিন পর পর রাত কাটাতাম আমার মেয়ের সাথে। সারাক্ষণ কাঁদতো আমার মেয়ে। ইচ্ছা মত কোলে নিতে পারতাম না – কারণ সূচ, টিউব, ইত্যাদি লাগান তার শরীরে। মাঝে মাঝে কান্না থামিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। হয়তো বলতে চাইতো – কেমন বাবা তুমি, আমার কষ্ট লাঘব করতে পারো না?
ডাক্তারেরা জানালো রক্ত দিতে হবে। সেই প্রথম রক্ত দিলাম আমি। আমার আর মেয়ের একই রক্তের গ্রুপ। আমার সামান্য একটু রক্ত পেয়েই তার চেহারা যেন আরও ফুটে উঠল। এমনিতে ফর্সা রং, অসুস্থ শরীরে ফ্যাকাশে লাগতো। এখন রক্ত পেয়ে গোলাপী আভা ফুটে উঠল তার চেহারায়। অনেকক্ষণ ধরে আমার মেয়ের সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
পরের বছর ১লা জুন চোখের সামনে ভাসতে থাকল আমার মেয়ের সেই সুন্দর চেহারা। আজীমপুর কবরস্থানে যেয়ে দাড়ালাম তার ছোট্ট কবরটার পাশে। একটা শেফালী গাছের নীচে তার কবর তাই চিনতে কষ্ট হল না। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফেরার পথে কি যেন মনে হল, পিজি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে যেয়ে হাজির হলাম। বললাম আমি রক্ত দান করতে এসেছি। নিজে থেকে রক্ত দান করা তখনও অতটা চালু হয়নি। আমাকে বেশ খাতির করল সবাই। এর পর থেকে প্রতি বছর ১লা জুন এলে ব্লাড ব্যাংকে যেয়ে রক্ত দিতে হাজির হতাম। একটানা ১০ বছর নির্দিষ্ট দিনে যেয়ে রক্ত দেবার ফলে ব্লাড ব্যাংকের সবাই আমাকে চিনে গিয়েছিল। এবার ডিরেক্টর অনুরোধ করলেন আমি যেন বাংলাদেশ বেতারকে একটা ইন্টারভিউ দিতে রাজী হই। রেডিওর লোককে তিনি আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন। আমি রাজী হওয়াতে ফোন করে তখনি তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন তিনি।
আমাকে প্রথম প্রশ্ন করা হল – আচ্ছা আপনি স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেন কেন?
– আমি স্বার্থপর তাই।
আমি জানি আমার কথা অনেক সময় লোকে ঠিক বুঝতে পারে না। এবারও তাই হোল। একটু থতমত খেয়ে এবার প্রশ্ন এলো – একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
– দেখেন, ১০ বছর আগে আমি প্রথম যখন রক্ত দিই তখন দেখি আমার এই সামান্য রক্ত একটা ছোট্ট বাচ্চার চেহারাতে কতটা পরিবর্তন আনতে পারে। ঐ চেহারাটা আমার সামনে ভাসে। মনটা খুবই ভাল হয়ে যায় এই সামান্য দানটুকুর বিনিময়ে। আমি স্বার্থপর, তাই এই ভাল লাগা বোধটুকুর জন্যে প্রতি বছর একবার করে এসে রক্ত দিয়ে যাই।
তাদের আরও কিছু প্রশ্নের উত্তরে আমি যা জানতাম তাই বললাম। বললাম এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি যে রক্ত দিচ্ছি সেটা আমার আমার শরীরে ফিরে আসবে। রক্ত দিয়ে আমার কখনো কোন রকম খারাপ বোধ হয়নি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
শেষ প্রশ্ন করলো – আপনি কি দেশের মানুষের প্রতি কিছু বলবেন?
– হ্যাঁ, আমি চাই যে দেশের মানুষ রাজনীতিক নেতাদের মত ‘স্বার্থহীন ভাল মানুষ’ না হয়ে, সাধারণ মানুষের মত ‘নিজ স্বার্থপরতার’ কারনেই রক্ত দানে এগিয়ে আসুন। এখন যেমন বিপদের দিনে রক্তের প্রয়োজনে দালালদের পিছনে পিছনে ঘুরে রক্ত যোগাড় করতে হয়, তার বদলে সবাই একটু একটু করে রক্ত দান করলে প্রয়োজনে সব সময় রক্ত পাওয়া যাবে। এই রক্ত অন্যের এবং আপনার বিপদের দিনে কাজে লাগবে এবং রক্ত দান করার ফলে নিজে থেকেই আপনার মন এমন এক প্রশান্তিতে ভরে যাবে, তখন দেখবেন কতটা ভাল লাগছে। এই ভাল লাগা অনুভুতির তুলনা নেই।
:boss: :boss:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ,
শুভেচ্ছা রইল তোমার পরীক্ষার খবরে। ক্যাডেট কলেজের ছেলে-মেয়েরা খুব একটা রাজনীতিতে ঢোকেনি। তোমার কি ভবিষ্যতে তেমন কোন ইচ্ছা আছে?
সাইফ ভাই,
ছাত্রজীবনে একটা স্বপ্ন ছিল, বাস্তবে নেমে হোঁচট খেয়ে গেছি।
ভোটের রাজনীতিতে নামার ইচ্ছে নেই। তবে জ্ঞানের রাজনীতিতে ঢুকার ইচ্ছে আছে পুরো মাত্রায়। দোওয়া করবেন।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
সাইফ ভাই ::salute::
আমার ব্লাড গ্রুপ বি নেগেটিভ। চেষ্টা করি রেগুলার ডোনেট করবার, কেননা আমাদের দেশে নেগেটিভ গ্রুপ অনেক রেয়ার। তবে প্রয়োজনের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে পজিটিভ গ্রুপেরও রক্ত পাওয়া যায় না। আমাদের সবারই এজন্য নিয়মিত রক্তদান করা উচিৎ।
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
জুনায়েদ,
ঠিক বলেছো - নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত কম পাওয়া যায়। CCTV-তে একটা খবর দেখলাম এক চাইনীজ মহিলা পুলিস যার নেগেটিভ গ্রুপ সে বছরে বেশ কয়েকবার করে রক্ত দিয়ে যাচ্ছে। সবাই যদি তোমার মত করে চিন্তা করে তা'হলে এই সমস্যাটা অনেকটা ক'মে আসবে।
কি চমৎকার একটা লেখা...
রক্ত দেয়া নিয়ে অনেকের এখনো অনেক বাধো বাধো অবস্থা আছে, অনেক ডাক্তারদেরও দেখছি অদ্ভুত অদ্ভুত এক্সিউজ দিতে, এই ব্যাপারটাই আমাকে অবাক করে সবচেয়ে বেশি।
সামিয়া,
অনেক ধন্যবাদ। আসলে রক্ত দেওয়াতে ভয়ের কিছু নেই - বরং অনেকের ধারনা এটা শরীরের জন্যে ভাল। আর মেয়েদের জন্যে এটাতো কোন সমস্যা নয়, এমনিতে প্রতি মাসে তারা শরীর থেকে রক্ত ঝড়িয়ে ফেলে এবং তাতে কারও কোন অসুবিধা হয় বলে শুনিনি।
::salute::
চেষ্টা করি নিয়মিত রক্ত দেবার, আরো নিয়মিত হতে হবে।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আহসান,
শুনে খুশী হলাম। বাংলাদেশে এখন তোমার মত রক্ত দাতাদের সঙ্খ্যা কি বাড়ছে?
:boss: :boss: :boss:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
অভিনন্দন সাইফ ভাই এই স্বার্থপরতার জন্য। :thumbup:
আমি অনিয়মিত দাতা। নিয়মিত হলে অনেক ভালো হতো। চেষ্টা করবো।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
লাবলু,
একেবার কখনো না দেবার চাইতে অনিয়মিত দাতা হওয়া অনেক ভাল। এতে অন্তত প্রয়োজনে রক্ত দিতে তোমার ভয় থাকবে না।
আমার সব চাইতে বড় বোনের সার্জারীর পর রক্তের প্রয়োজন হওয়ার খবরে আমি যেয়ে রক্ত দিয়ে আসলাম। রক্ত দেবার অভ্যাস থাকাতে চিন্তা করতে হয়নি। তিনি সেদিন যে কি খুশী হয়েছিলেন - সেই চেহারাটা আমার আজও মনে আছে।
আসলে কত সামান্যতে আমরা অন্যকে খুশী করতে পারি এবং নিজেও খুশী হতে পারি।
আমি ৪ মাস পরপর নিয়মিত রক্ত দেই। আমার মনে হয় সিসিবিতে ব্লগার প্রোফাইলের পাশে রক্তের গ্রুপ থাকলে ভাল হবে। এডু/মডু ভেবে দেখবেন কি?
সাকলায়েন,
তোমার দৃষ্টান্তে অনেকেই অনুপ্রানিত হবে আশা রাখি।
স্বপন মামা,
অপূর্ব আপনার লেখা। "আমি স্বার্থপর, তাই এই ভাল লাগা বোধটুকুর জন্যে প্রতি বছর একবার করে এসে রক্ত দিয়ে যাই" এই সরল স্বীকাক্তিমূলক কথা খুব কম মানুষই প্রকাশ করতে পারে। আপনার প্রতি রইল অগাধ শ্রদ্ধা। আপনার আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
শাহীন কঙ্গো থেকে।
শাহীন,
ধন্যবাদ তোমাকে। কঙ্গো থেকে কবে ফিরবে তোমরা? এবারের একুশে বই মেলাতে 'অলখ আমেরিকা' নামে আমার একটি বই প্রকাশ পেয়েছে। মনে হয় না যে কঙ্গোতে সহজে যোগার করতে পারবে বইটি। নীচের লিঙ্কে ঐ বইয়ের কিছু গল্প পাবে পড়ার জন্যেঃ
:boss: :boss: পৃথিবীতে স্বার্থপর মানুষদেরও প্রয়োজন আছে...... :just: :hatsoff:
মীম,
আসলে যদি একটু গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখো তবে দেখবে আমরা যা কিছু করি তা কিন্তু কোন না কোন ভাবে এক ধরনের স্বার্থের সাথে জড়িত। তবে ঠিক এভাবে দেখতে বা চিন্তা করতে অভ্যস্ত নই আমরা।
সাইফ ভাই,
আপনার অন্য কোন লেখায় পড়েছিলাম আপনার কন্যার কথা।আজো পড়ে খুব মন খারাপ হলো।কোন বাধাই আপনার বহুল কর্মময় জীবনে ছেদ টানতে পারেনি -- এটা আমাকে অবাক করে।এতো টাফ কি করে হলেন বলুন তো!
রক্ত দান করার সচেতনতা বোধ হয় একটু বেড়েছে দেশে, কিন্তু আমাদের চাহিদা সামলানোর জন্য জনগণের দলে দলে রক্ত দিতে এগিয়ে আসা উচিত। হাসপাতালে কাজ করার সময় দেখছি, লোকে বাবার জন্যেও রক্ত কিনতে চায় কিন্তু নিজে দিতে ভয় পায়। ওই সব মুহুর্তে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে অন্য পেশেন্ট ফেলে রেখে এঁদের কনভিন্স করানোর সময় পর্যন্ত হাতে থাকতোনা। কখনো কখনো উদ্ভট অজুহাত শুনলে মেজাজও খারাপ হয়ে যেতো।যেমন: একজনকে তার বাবার জন্যে রক্ত দিতে বলা হলে সে জানালো সে কয়দিন আগে বিয়ে করেছে তাই এখন রক্ত দেয়া সম্ভব নয় যদিও তার খুব ইচ্ছে। তার এই কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলামনা।
নূপুর,
অনেক ধন্যবাদ তোমার মন্তব্যের জন্যে। ঠিক কথা বলেছো -অন্তত একবার দুইবার করে যদি সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় রক্ত দিতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তবে পরে আর রক্ত দান করতে অনিহা প্রকাশ করবে না।
এখানে দেখেছি বছরে কয়েকবার করে রক্ত গ্রহণকারী গাড়ী (বেশ বড় বাসের আকারে এবং রক্ত গ্রহণ করার ল্যাব সেখানেই) আমাদের অফিসে এসে দাঁড়িয়ে আছে এবং একথা জানিয়ে সবার কাছে ইমেইল চলে এসেছে যাতে সুবিধা অনুযায়ী রক্ত দাতাগন এসে রক্ত দান করতে পারে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমেরিকাতে আসার পর আমি আর রক্ত দিতে পারিনি। এখানে কারা কারা রক্ত দিতে পারে আর কারা পারে না সেটা বেশ কড়া করে মানা হয়। যারা ১৯৮০ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ৬ মাস বা তার বেশী বিলাতে বাস করেছে তাদের রক্ত নেওয়া হয় না। আমি '৮৪-'৮৬ এই দুই বছর বিলাতে কাটাবার ফলে ঐ আইনে পরে গেছি। (ঐ সময়টাতে সম্ভবত বিলাতে 'ম্যাড-কাও' রোগ দেখা দিয়েছিল তাই এই সতর্কতা)
এ ছাড়া আরও কিছু নিয়ম-কানুন আছে - নীচে লিঙ্ক দিলাম যদি কেউ জানতে আগ্রহী হয়ঃ
Blood Donor Qualifications and Eligibility Information
এই লেখাগুলোতে আসলে কিছু বলার থাকে না।
রক্তদান-এর ব্যাপারে প্রচলিত কিছু ভীতি মানুষের মন থেকে দূর করাটা বেশ জরুরী। উপরে নূপুর ভাই যেমন বললেন; এমন ঘটনা বাস্তবে নিজের চোখেই দেখা।
সিসিবির একটা ব্লাড ব্যাঙ্ক ডাটাবেইস থাকা উচিৎ।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..