অনেকদিন পর রাজশাহী গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। ভ্রমণ সঙ্গী সহকর্মী Monirul Karim । দু’জনেরই ইচ্ছে কাজের ফাঁকে রাজশাহী ঘুরে দেখা যতদূর সম্ভব, যতটুক সম্ভব। এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে এসেছিলো বিপুল। রাজশাহীর ছেলে। আমাদের মতলব শুনে বলল, ‘শার, আগে চলেন পুঠিয়া রাজবাড়ি যাই, ফেরার পথে পদ্মার পাড়, আর কালকেরটা কাল দেখা যাবে’। আমাদের সময় মোটে পরের দিনের বিকেলের ফ্লাইট পর্যন্ত। তার মধ্যে তিনটে অফিসিয়াল মিটিং সেরে, বিকাশের এজেন্টদের দু’একজায়াগায় ঢুঁ মেরে, বেড়ানোর জন্যে সময় বের করা সহজ কথা নয়। আমি বললাম কাজ হয়ে গেলে যদি সময় থাকে একবার তাবিবের সাথে দেখা করে যাবো।
ফতেহ আলম ইবনে তাবিব রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র,এই কলেজেরই প্রিন্সিপ্যাল। তাঁকে চিনি প্রায় ৩৩ বছর ধরে। সকালে শুনলাম, তাবিব হজ্বে গেছে।মন একটু খারাপ হল, তাও ক্যাডেট কলেজ ঘোরার আশা ছাড়লাম না।
বারোটার দিকে শহরের কাজ শেষ, বিপুলকে বললাম তিনটা পঁচিশে ফ্লাইট। ক্যাডেট কলেজ ঘুরে ফ্লাইট ধরতে পারবো তো? সে উত্তর দেবার আগেই বললাম, মিষ্টিও কিন্তু কিনতে হবে। রাজশাহীর মিষ্টি ভালো, অন্তত তিরিশ বছর আগে ভালো ছিলো আমি জানি। মিষ্টি ছাড়া ঢাকায় ফেরা উচিৎ হবেনা’। বিপুল বলল, তাহলে আর দেরি করা যাবেনা।
দুপুরেই হোটেল চেক আউট করে গাড়িতে উঠলাম। ক্যাডেট কলেজ ঘুরে যেন এদিকে আসতে না হয়। হোটেল থেকে বেরিয়ে পদ্মার সমান্তরাল কিছুদূর গিয়ে কাজলা পেরিয়ে নাটোর রোডে উঠে বিপুলের গাড়ি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে লাগলো, পনর মিনিটে পৌছে গেলাম বানেশ্বর। এখান থেকে ডানের রাস্তায় সারদাহ পুলিশ একাডেমি আর রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ। রাজশাহী থেকে বানেশ্বর সাড়ে নয় কিলোমিটার আর সেখান থেকে ক্যাডেট কলেজ ১০ কিলো মিটারের মত। বিপুল বলল, বাশেও আসা যায় শার, সোময় একটু বেসি লাগে এই যা’। বানেশ্বর থেকে আগে ঘোড়ার গাড়ি, রিক্সা যেত কলেজ পর্যন্ত এখন টেম্পু যায়, সম্ভবত বাসও যায়। খুব একটা ভিড় টিড় নেই এরাস্তায় , সময় থাকলে দিব্যি ধীরে সুস্থে প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।
ক্যাডেট কলেজের গেটে গিয়ে আটকা পড়তে হল। অত্যন্ত কঠিন দাররক্ষী। বিভিন্ন রকম প্রশ্নট্রশ্ন করে ঘাবড়েদেবার চেষ্টা করলো। একবার মনে হল, তাবিব নেই জেনেও কেন এলাম! শেষ পর্যন্ত কী ফিরেই যেতে হয়! মুনীর ক্যাডেট কলেজের ছেলে নয়। ওকে নিয়ে ফিরে যাওয়া মানে, আমার ফুটানি শেষ। অবশেষে ওহী নাজেল হল, দাররক্ষীর উপর । তিনি মেইন অফিস পর্যন্ত যাবার অনুমতি দিলেন। অফিসে প্রথমেই দেখা হয়ে গেল একাউন্টস অফিসারের সাথে। অতি সজ্জন মানুষ। মির্জাপুরে আমার সহকর্মী ছিলেন। তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তাঁর কাছ থেকে এডজুটেন্টের নম্বর নিয়ে ফোন দিলাম।
বেতের মত মেদহীন মোবাশ্শির। পরিচয় পর্বে জানাগেল তিনি রাজশাহীর এক্স ক্যাডেট, এর আগে কিছুদিন মির্জাপুরে কাজ করেছেন, ফেসবুকে তার নাম মোবাশ্শির অভি এবং আমরা লাঞ্চ না করে ফিরতে পারবো না। আমাদের একটু তাড়াহুড়ো ছিলো ফ্লাইট শিডিউলের কারণে। অভি প্রথমে বলে ছিলো আপনারা ঘোরাঘুরি করতে করতে লাঞ্চ রেডি হয়ে যাবে। আমাদের তাড়ার কথা শুনে সে নিজেই আমাদের সফর সঙ্গী হয়ে গেলো।
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ আমার কাছে নতুন নয়। এর আগে আমাই অন্ততঃ তিনবার ইন্টার ক্যাডেট কলেজ স্পোর্টসের জন্যে আমি এই কলেজে এসেছি। এই কলেজের ১১০ একর জায়গার সবটা না হোক, অনেকটাই চিনি। তারপরও অনেক কিছু নতুন মনে হচ্ছিল। যেমন একাডেমিক ব্লকের নাম হয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নামে, লাইব্রেরির নতুন নাম হয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের নামে। কলেজে একটি মিউজিয়াম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্তম্ভ হয়েছে। ডাইনিং হলের চেহারা পাল্টেছে । রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ভিত্তি প্রস্তর লাগানোর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত নভেম্বরে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হবে। সেই হিসেবে দালান কোঠার বয়স হয়ছে। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যায় অনেক বেড়ে গেছে। মোবাশ্শিরের কথায় বুঝলাম বাজেট না বাড়লে ভবিষ্যতে দূরুহ হয়ে যাবে কলেজের সব কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিলো পদ্মার পাড়। প্রথম যেবার আসি তখন, কলেজের বাউন্ডারি ওয়াল ছিলো না। আখের বন পেরিয়ে পদ্মা দেখতে এসেছিলাম।আমাদের সাথে মিঃ এবারউদ্দিন ছিলেন। পদ্মার ওইপারে অনেক দূরে অস্পষ্ট কুয়াশার মত কিছু ঘর বাড়ি দেখিয়ে বলেছিলেন ওপারে মুর্শিদাবাদ। পদ্মা এখন শীর্ণ হয়ে গিয়েছে। মাঝ বরাবর চর পড়েছে। আখের ক্ষেতের বদলে আমবাগান, পিকনিক স্পট তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা নাগরিক পরিবর্তণ এসেছে।
নদীর পাড়েই দেখা হল পাবনা ক্যাডেট কলেজের মেডিকেল অফিসার, আর কয়েকজন শিক্ষকের সাথে। পাবনা ক্যাডেট কলেজের ছেলেদের নিয়ে তারা এসেছেন রাজশাহী বেড়াতে। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ডাক্তারের সাথেও দেখা হল।
গাড়িতে উঠতে গিয়ে আবার অভিভূত হতে হল মোবাশ্শির অভি অতিথেয়তায়। আমাদের হাতে কলেজের স্মারক উপহার তুলেদিয়ে খুব পরিচিত বন্ধুর মত বিদায় জানাল সে। অথচ এর আগে কখোনোই ওর সাথে দেখা হয়নি আমার।
গাড়িতে উঠতে উঠতে বিপুলকে বললাম, হাতে সময় নেই পথে কোন জায়গা থেকে মিষ্টি নিলেই হবে। কথাটা পছন্দ হলোনা বিপুলের। সে বলল, ‘আপনি বুললেই হবে !রাজশাহী থেকে ভুল ভাল মিষ্টি কিনে লিয়ে গেলে বদনাম হবে শার, আপ্নেকে আসল দোকানে লিয়ে যাবো।
বললাম , দেরি হয়ে যাবেনা?
বিপুলের কনফিডেন্ট উত্তর, উড়িয়ে লিয়ে যাবো শার।
আপনার এবসেন্স ফিল করছিলাম।
ঝড়ের মত সেটা উড়িয়ে নিয়ে গেলেন।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত গতিময় ছবিব্লগ পেয়ে পাঠে ও চোখের উভয় সুখই হলো....
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
্ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
১৯৮৯ তে আমি প্রথম রাজশাহীতে যাই। বড়বোন তখন মাত্রই মাইগ্রেশন নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ক্লাস শুরু করেছেন। ভাইয়া উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। তাদের বাড়িটি পদ্মানদীর পাড় ঘেঁসে। পাশেই পর্যটনের অফিস; ছোটখাট একটি চিড়িয়াখানাও আছে সেখানে। আমি মুমিসিং এর মানুষ; আমরা যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখি। নোংরা জলে ড্রেন উপচে পড়ে খানিক বৃষ্টি হলেই। সদা নিরব মিউনিসিপ্যালিটি। আমি তখনো দেশের বাইরে যাইনি কোথাও। রাজশাহীতে এসে আমার মনেহলো আমি বুঝি বিদেশে এলাম। কী পরিচছন্ন শহর; মানুষগুলোও দেখি অন্যরকম করে কথা বলেন। আমার কাছে সবকিছু বড় মিঠে লাগলো!
আপা কলেজে চলে গেলে ভাইয়াও অফিসে; আমি ড্রাইভারটিকে বিদায় করে রিকশায় রিকশায় ঘুরেফিরে বেড়াই। ক্ষুধা পেলে তিলের খাজা কিনে খাই। কোনদিন সটান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই, সবার সাথে গল্প করি। বাড়ি ফিরে আসি ওদের লাল বাসে। বাড়ি ফিরবার পথে চিড়িয়াখানায় ঢুঁ দিই। গোটা দশেক বানর, কিছু হাঁস মুরগি আর পাখ পাখালি নিয়ে এই চিড়িয়াখানা। দর্শনার্থীরা কেউ এলেই তিনটে বানরছানা হাত পেতে রাখতো খাবারের আশায়। বাদামওয়ালার থেকে বাদাম কিনে বাচ্চাগুলোকে দিতাম খেতে। কী যে মায়া লাগতো এদের দেখতে!
মিসড ইউ, ভাইয়া!
্ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
সাইদুল ভাই অনেক দিন না এলে মনে হয় ঘরে বন্দি হয়ে আছি, আর এলে মনে হয় "কেন খমোকা ঘরে বন্দি হয়ে আছি!"
রাজশাহি যাবার সু্যোগ পাই নি- আফসোস।
সেন্ট্রদের স্বভাব ইউনিভার্সাল। দু'দন্ড পরেই যাকে পঞ্চাশবার সালাম ঠুকবে, তাকেও প্রথমে কিছুক্ষন ভোগাবে।
্ধন্যবাদ
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
:clap: :clap:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
রাজশাহি যাওয়া হয়নি কখনো, আপনার চোখে দারুন ভাবে দেখলাম 🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
বেশ ক'দিন বিরতির পর সিসিবিতে এসে আপনার উপস্থিতির সাড়া না পেয়ে ভাবছিলাম ।
গরম লেখার সরব উপস্থিতিতে আমাদের বরাবরের মতোন ঘুরিয়ে আনলেন ফ্রি ফ্রি ।
:boss: :boss:
বেশ কয়েকবার রাজশাহী গিয়েছি।
তবে কলেজে গিয়েছি একবারই, ২০০০ সালে, আই সি সি ক্রিকেট কম্পিটিশনে।
জেসিসি সহ তিনটি কলেজের একই ডিজাইন হবার কারণে আর সি সি এবং মির্জাপুরকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই আপন লাগে।
ঈদ মোবারক, সাইদুল ভাই। 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ