শিক্ষকের মৃত্যু নেই

মানুষের মৃত্যু আছে। শিক্ষকের কি মৃত্যু আছে? মনে হয় না।

একবার আমার এক শিক্ষক আমার বর্তমান কর্মস্থলে শিক্ষক নিয়োগের ইণ্টারভিউ-এ এক্সটার্নাল সাব্জেক্ট এক্সপার্ট হিসেবে এসেছিলেন। রেজিস্ট্রার অফিসে বসেছিলেন। সন্ধ্যার পরে সিলেকশন বোর্ড বসবে। আমি বিকেলে অফিস আওয়ারের পরে রেজিস্ট্রার অফিসে গেলাম তাঁর সাথে দেখা করতে। কুশালাদি বিনিময়ের এক পর্যায়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি মাহবুব!! পড়াতে টড়াতে পার কিছু?” আমি তো বেশ হতবাক হয়ে গেলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শিক্ষক আমার কর্মস্থলে এসে সবার সামনে আমাকে এ আবার কি ধরনের কথা জিজ্ঞেস করছেন! আমি কাঁচুমাঁচু করে বললাম, “আপনারা কিছু তো শিখিয়েছেন স্যার। সেগুলো দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছি।” তিনি সাথে সাথে বললেন, “না না!! কিচ্ছু পার না!! আমিই তো পারি না। কাউকে কিছুই শেখাতে পারছি না। তোমরা তাও ক’জন ছিলে যাদেরকে কিছু শেখাতে পেরেছি। এখন কাউকেই কিছু শেখানো যাচ্ছে না।” আমি এতক্ষণে স্যারের মনোভাব বুঝতে পারলাম। আসেপাশে আমার কর্মস্থলের যারা এতক্ষণ দুই গুরু-শিষ্যের কথপোকথন শুনছিলেন, তাদের সবার চেহারায় দেখি মুচকি হাসি।

আজ দুপুরে, বছরের এই প্রথম দিনে, পরিবার সমেত অনেক সম্মানিত হয়েছি। ক্যাডেট কলেজের আমাদের সময়ের এক প্রিন্সিপাল স্যারের মিসেস (আমরা তাঁকে ম্যাডাম ডেকেছি সবসময়, যাঁকে নিয়ে আমি আমার আগের কোন এক লেখাতেও কিছু কথা লিখেছিলাম) কদিন আগে হঠাত ফোন করলেন। আমি তখন গাড়িতে, ইউনিভার্সিটির পথে, “আহমদ, কেমন আছো বাবা? বলতো, আমি কে?” আমি সালাম দিয়ে বললাম, “ম্যাডাম আপনি কিভাবে ভাবলেন যে আমি আপনাকে চিনতে পারব না।” উনার কণ্ঠে সেই পরিচিত স্নেহের হাসি শুনলাম, “বাবা, এক তারিখ দুপুরে তুমি তোমার বৌ-বাচ্চা সহ আমাদের বাসায় লাঞ্চ করবে।” এমন দাওয়াতে না যাওয়া আর নিজেকে অসম্মান করা একই কথা, “অবশ্যই যাব ম্যাডাম।”

গত দুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু সহ ঢাকার বাইরে ছিলাম। গাজিপুরের ময়মনসিংহ প্রান্তের এক খামার বাড়িতে দুই পরিবার মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম দুদিনের জন্য। ৩০ এবং ৩১ শে ডিসেম্বর ঘুরে ৩১ তারিখেই বিকেলের মধ্যে ঢাকায় বাসায় ফিরেছি। কারন, প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দাওয়াতে যেতেই হবে। ইন্টার-ক্যাডেট কলেজের বিভিন্ন ইভেণ্ট-মিটের সময়ে টার্ম শেষে ছুটি না পাওয়া ক্যাডেটদের জন্য যে মানুষটা তাঁর বাসা থেকে আমড়া-চকলেট এসব পাঠাতেন, তাঁর দাওয়াত অগ্রাহ্য করার মত হতভাগা এখনো হইনি। প্রিন্সিপাল স্যারের বাসা থেকে বিকেলের পরে বৌ-বাচ্চা সহ রওনা দিয়ে প্রথম-সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরেই বৌ জানাল, “তোমাদের ব্যাচের অমুক আপার ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম তোমাদের অমুক স্যার ইন্তেকাল করেছেন।” আমি আমার সেই ক্লাসমেটকে ফোন করে না পেয়ে ফেসবুকে ঢুকলাম, দেখি আমার এক জুনিওর, যে নিজেও আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্যারের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে।

এই স্যারের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত। তাঁকে নিয়েও আমি আমার আগের সেই লেখায় বেশ কিছু কথা লিখেছিলাম। ছাত্র জীবনে আমাকে তিনি তাঁর অফিশিয়াল এ্যাসিস্ট্যাণ্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে অনেক বকা-ঝকা দিয়ে কাজ শিখিয়েছেন। তিনি হলেন আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক যাঁকে নিয়ে আমি এই লেখার প্রথম দিকে আমার কর্মক্ষেত্রের একটা ঘটনা লিখেছি। স্যারের বেশ বয়স হয়েছিল। দীর্ঘদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। আমার বাবা যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন, স্যার তখনই সেখানে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। এখন পর্যন্ত বাবাকে স্যারের মৃত্যুসংবাদটা দেইনি। আমার বাবাও শিক্ষক, সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০০৫ সালে। বাবাকে কেন যেন ইদানিং পরিচিতজনের এধরনের মহাপ্রয়ানের সংবাদ দিতে মনে খচখচ করে। ধীরে সুস্থে দেই।

আচ্ছা, আসলেই কি শিক্ষকের মৃত্যু হয়? আগের লেখাটাও এই কথাটা দিয়েই শেষ করেছিলাম।

৭,৮১১ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “শিক্ষকের মৃত্যু নেই”

    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। শিক্ষকদের সাথে আমার স্মৃতিগুলো আমার জীবনের অনেক বড় সঞ্চয়। অনেক সুন্দর করে মন্তব্য করেছেন। আবারো ধন্যবাদ, যদিও আপনার পরিচয় বুঝতে পারছি না, সম্ভবত আপনি এই ব্লগের লেখকদের কেউ নন।


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন
  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    চমৎকার পোষ্ট।

    মৃত্যু হচ্ছে বাস্তবতা থেকে প্রস্থান। যা কিছু বাস্তব, ঘটমান সেখান থেকে আপনার আমার অনুপস্থিতিই মৃত্যু। দৈহিক মানুষের মৃত্যু হয়, কর্মের নয়। যেখানে শিক্ষকের অবদান অপরিসীম তাতে শিক্ষকের মৃত্যুর প্রশ্নই ওঠেনা। তারা অনুপস্থিত থাকেন মাত্র।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।