নস্টালজিয়াঃ সময়ের পালাবদল

নস্টালজিয়াঃ সময়ের পালাবদল
আহমদ মাহবুব-উল-আলম
[আহমদ, সিসিআর, ১৯৮৮-’৯৪]

১। ক্যাডেট কলেজে ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় ক্লাস টুয়েলভের বড় ভাইদের দানবাকৃতির মনে হতো। সময় গড়ালো, আমরা যখন টুয়েলভে, নতুন ইণ্টেক যখন ক্লাস সেভেনে ভীতু-ভীতু চেহারা নিয়ে ভর্তি হতো, ভাবতাম ওদের মা-বাবা-দের কোন দয়া-মায়া নেই, এইটুকুন বাচ্চাদের কেউ ক্যাডেট কলেজে পাঠায়!!

২। আমাদের সময়ের এক প্রিন্সিপাল ম্যাডাম (মিসেস প্রিন্সিপাল) একবার তাঁর বাসায় তিনশ ক্যাডেটকে একসাথে দাওয়াত করে শবে বরাতের হালুয়া রুটি খাইয়েছিলেন। আরেক প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ছুটিতে না যাওয়া কিংবা ছুটির আগেই কলেজে ফিরে আসা ক্যাডেটদের জন্য তাঁর বাসা থেকে রেগুলার আমড়া, চকলেট এসব পাঠাতেন, এক্সকারশনে বা ইণ্টার ক্যাডেট কলেজ ইভেণ্টগুলোতে ক্যাডেটদের সাথে কলেজ বাসে চেপেই তিনি জার্নি করতেন; আমার স্পষ্ট মনে আছে, এমন এক জার্নিতে তাঁর পরনে ছিল সাধারন সুতি শাড়ি, ইন্ডিয়ান মিনু শাড়ি। সেই ম্যাডাম এখনো দেখা হলেই প্রায় গাল টেনেই আদর করেন, আর বলেন, “তোমরা এত্তটুকু ছিলে, আর তোমাদের বাবুগুলো এখন কত্ত বড়”… একবার রিইউনিয়নে সেই প্রিন্সিপাল (তিনি এবং তার পরিবার সেসময় দাওয়াতপ্রাপ্ত অতিথি ছিলেন) স্যার এবং ম্যাডামের সাথে ছবি তুলতে চাইলে ম্যাডাম পাশ থেকে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে তাদের দুজনের মাঝে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলেছিলেন। ছবিটা এখনো আমার কাছে আছে।

৩। বিয়ের পরে যখন রিইউনিয়ন এটেণ্ড করছি, একজন শিক্ষক আমাকে সস্ত্রীক প্রায় জোর করে হাত ধরে টেনে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসায় নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বললেন, “দেখো কাদেরকে ধরে নিয়ে এসেছি”! আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছি এই কারনে, আমি সেই শিক্ষকের সাব্জেক্টে দূর্বলতম ছাত্রদের একজন ছিলাম। আরেকজন শিক্ষক, যাঁর সাব্জেক্টে আমি ইন্টারমিডিয়েটেও বলতে গেলে টেনে-টুনে পাশ করেছি, তিনি এক এক্স-ক্যাডেট কাপলের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার বৌ-কে তার পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউণ্ড (সাব্জেক্ট) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় আমি আর হাসি চাপাতে পারিনি, কারন আমার বৌ সেই স্যারের সাব্জেক্টের কাছাকাছি একটা সাব্জেক্টে জাহাঙ্গীরনগর থেকে বিএসসি-এমএসসি করেছে। স্যারও সেদিন আর হাসি চেপে রাখেননি। সেই স্যারের মৃত্যুর সময় সিএমএইচে আমাকে দেখে ম্যাডাম (স্যারের মিসেস) আমার হাতটা ধরে কেঁদেছিলেন। আমি সেদিন বুঝলাম, একজন দূর্বল ছাত্রও শিক্ষকের কাছে, এমনকি শিক্ষকের পরিবারের কাছেও কতটা ভালবাসার পাত্র হতে পারে। সেই ম্যাডাম তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে, এমনকি তাঁর মাকেও সাথে নিয়ে, গত রোজার ঈদে আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ তাঁদের সুযোগ্য সন্তান আমারই কলেজের জুনিয়র সেই ক্যাডেটের প্রতি, আমার জীবনের এই দূর্লভ মুহূর্তটি এনে দেবার জন্য। আর আমার সবেচেয়ে প্রিয় শিক্ষাগুরুর কথা না বললেই নয়, যিনি তাঁর বর্তমান অবসরে গাজীপুরে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের আবাসন প্রকল্পে নিজ বাসভবনে অবস্থান করছেন; আমার মেয়েকে প্রথমবার দেখে যিনি বলেছিলেন, “জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ”! এই স্যারের কাছে আমি আজীবন ঋণী, তাঁর শেখানোর ভঙ্গিমা, গল্পচ্ছলে ইন্সপিরেশন, এসব এখন শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেই অনুসরণ করার চেষ্টা করি। তিনি সহ আরো বেশ কজন শিক্ষক আছেন, আমি ফোন করতে ভুলে গেলেও তাঁরা ফোন করে মাঝে মাঝে আমার মত ফেলনা দূর্বল ছাত্রের খোঁজ-খবর নেন। এই মানুষগুলোই আসলে প্রকৃত মানুষ গড়ার কারিগর; অন্য অনেকের মত তাঁরাও যদি আমার দূর্বলতাগুলোতে বিরক্তি প্রকাশ করতেন, তাহলে জীবনে হয়তো কিছুই করতে পারতাম না; এই মানুষগুলো আছেন বলেই আমার মত দূর্বল অধমেরাও আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে।

৪। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আরেক ধরণের অভিজ্ঞতা হলো। বিভিন্ন সময়ে কিছু শিক্ষক তাঁদের বিভিন্ন একাডেমিক কাজে এ্যাসিস্ট করতে বলতেন। খুবই অবাক হলাম যখন একজন শিক্ষক তাঁর পিএইচডির কাজে আমাকে এ্যাসিস্ট্যাণ্ট হিসেবে কাজ করালেন, শুধু তাইই নয়, আরো কয়েকজন এ্যাসিস্ট্যাণ্টের প্রয়োজন হলে কাকে-কাকে নেয়া যেতে পারে সেটাও তিনি আমার কাছে পরামর্শ চাইলেন। আরেকজন শিক্ষক তো রীতিমত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের অফিস-অর্ডারে আমাকে ডিপার্টমেণ্টে তার অফিশিয়াল এ্যাসিস্ট্যাণ্ট বানিয়েছিলেন আমি থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়েই; কাজ করাতেন আর বকা দিতেন, বকা দিতেন আর কাজ করাতেন, আমি সারাজীবনে এত পরিমান একাডেমিক বকা মনে হয় আর কোথাও খাইনি; তবে নিজের প্রফেশনাল জগতে সামান্য যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সেই বকাগুলোর জন্যই হয়েছে। বকা দিয়েছেন প্রচুর, তবে ঘুণাক্ষরেও তিরস্কার করেননি কখনো, বরং বকা দিয়ে কাজটা আবার করিয়েছেন, বারবার করিয়েছেন। সেই স্যার এতটাই সিনিয়র ছিলেন যে, সরাসরি তিনি আমার বাবার শিক্ষক না হলেও আমার বাবা মাস্টার্স পড়ার সময়ই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।

৫। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় জয়েন করার পরে অন্য ডিপার্টমেণ্টের এক সিনিয়র ছাত্র নিজ আগ্রহে দেখা করে তার একটা পরিচয় জানাল, যাতে বুঝলাম সেই ছাত্রের বড় ভাবি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার কাছে ফোন নম্বর নিয়ে ম্যাডামকে ফোন দিলাম, ম্যাডাম আমাকে আমার ডাক নামে সম্বোধন করে বললেন, “পিয়াল, তোমার সুসংবাদ আমি আমার দেবরের কাছে জানলাম, এটা কি ঠিক হলো?” আরেকদিন এই শ্রদ্ধেয় ম্যাডাম তাঁর বাসার আসেপাশে আমার মতন কাউকে দেখে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এই মুহূর্তে অমুক লোকেশনে, আমার বাসার কাছাকাছি? তোমার মতন কাকে যেন দেখলাম মনে হলো!” শিক্ষকদের এই আদর-স্নেহ-ভালবাসার প্রতিদান আমি কিভাবে শোধ করি? আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ম্যাডাম একবার আমার এক জুনিয়র ফিমেল কলিগের সাথে দেখা করতে আমার ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসেছেন; আমার সেই জুনিয়র কলিগ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও আমার কয়েক ব্যাচ জুনিয়র ছিল । আমার সেই জুনিয়র কলিগের কাছে খবর পেয়ে আমি তার রুমে গেলাম ম্যাডামের সাথে দেখা করতে। ম্যাডাম আমাকে দেখেই স্নেহের হাসি দিয়ে তাঁর ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে বললেন, “হ্যাপি বার্থডে, পিয়াল!” আমি এতটা সারপ্রাইজড জীবনে খুব কমই হয়েছি। তিনি বেড়াতে আসার আগে আমার সেই জুনিয়র কলিগের (ডিপার্টমেন্টের জুনিয়রের) কাছে শুনেছিলেন যে সেদিন আমার জন্মদিন; আসার সময় তিনি আমার জন্য খুব সুন্দর একটা মগ কিনে র‌্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে এনেছিলেন। এই পুরো বিষয়টাতে শুধু আমিই নই, আমার অন্যান্য কলিগরাও বেশ অবাক হয়েছিলেন আমার শিক্ষক-ভাগ্য দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন ম্যাডামের কথা না বললেই নয়, যাঁকে আমি আমাদের ব্যাচের ইউনিভার্সিটির লাস্ট ক্লাসে চোখের পানি মুছতে দেখেছি। ম্যাডাম এখন প্রবাসী, দীর্ঘদিন তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাত নেই, তবে ফেসবুকে যোগাযোগ আছে। ম্যাডাম যখনই দেশে এসেছেন, তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে আমার স্ত্রী-কণ্যা-র খোঁজ-খবর নিয়েছেন। একবার তো এমন হয়েছে, প্রবাসে ফেরত যাবার পূর্বমুহূর্তে ফোন করে বলেছেন, “দেশে এসেছিলাম স্বল্প সময়ের জন্য, ঢাকায় ছিলাম না, তাই সেভাবে কারো সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি, আজই আবার ফিরে যাচ্ছি”। এই ম্যাডাম আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকে আমাকে ম্যাসেঞ্জারে একটা কথা লিখে পাঠিয়েছিলেন, “পিয়াল, বৌকে ভালবাসা তো সহজ কাজ, সেটা সবাই পারে, তুমি তোমার বৌকে ভালবাসার সাথে অবশ্যই সম্মানও করো, এটা কিন্তু সবাই পারে না, কথাটা মনে রেখো”। আমি সেদিন সত্যিই বেশ অবাক হয়েছিলাম, মনে কতটা স্নেহ থাকলে একজন শিক্ষক তার অনেকদিনের পুরোনো ছাত্রকে এভাবে আশির্বাদ করেন।

৬। শিক্ষকদের আমি বরাবরই অন্য চোখে দেখেছি, খুব ছোট্ট কাল থেকেই। নিজে এই পেশায়, সেজন্য কখনোই নয়। বরং বাবার পেশার কারনে। বাবা স্বাধীন বাংলাদেশের ১ম বিসিএস-এর শিক্ষা ক্যাডারে ছিলেন। বিভিন্ন সরকারি কলেজে সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপনা করেছেন। বাবা বরাবরই ছিলেন ছাত্র-অন্তঃপ্রাণ, তাঁর জীবনসঙ্গিনী আমার গৃহিণী মা-ও ছিলেন তেমনই। বাবার ডিপার্টমেন্ট থেকে যখনই পিকনিক হতো, আমার আনন্দ আর দেখে কে! পুরো জার্নিতে আমি সেই চাচা-ফুপুদের (বাবার ছাত্রছাত্রীদের) কোল বদল করতে-করতেই যেতাম। ফিরতি পথে কখন কার কোলে ঘুমিয়ে পড়তাম ঠিক নেই। বাবার সেই ছাত্রছাত্রীরাও আজ অনেকেই বিভিন্ন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, কিংবা অলরেডি রিটায়ার্ড প্রফেসর্স। তাঁদের অনেকের সাথেই আমার এখনো ফোনে যোগাযোগ হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে বরং কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনে অজ্ঞ আমার বাবা এখন মাঝে মাঝে আমার কাছেই তাঁর সেই পুরোনো ছাত্রদের খোজ খবর নেন, ছবি দেখেন। বাবার শিক্ষকতার কর্মজীবনের প্রথম দিকের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আদর-স্নেহও ভোলার নয়। তাঁদের মাঝে বিভিন্ন ধর্মাবিলম্বী ছিলেন। আসলেই “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”, হয়ত বা সেটা জেলা শহরে শৈশব কাটানোর কারনেই, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব তখন যেন ছিল সত্যিকারের সামাজিক মিলন মেলা। আমার বিয়েতে বাবার পুরোনো এক মহিলা কলিগ অন্য এক জেলা থেকে জার্নি করে এসে আমাদের বাসায় উঠেছিলেন। বাবার পুরোনো কলিগ সেই ফুপু আমাকে বলেছিলেন, “ব্যাটা তোর বিয়েতে আমি আসব না, তা কি হয়?” আরেকবার ক্যাডেট কলেজের ছুটি শেষে রাজশাহী (বাবার তখনকার কর্মস্থল) থেকে রংপুরে যাচ্ছি। তখন আমি ক্যাডেট কলেজের সিনিয়র কোন ক্লাসে। আমার ডান দিকের এক সীট পেছনে এক বয়স্ক মহিলাকে বেশ চেনা-চেনা লাগছিল। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আন্টি, আপনি কি প্রফেসর অমুক?” তিনি চেহারায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে অবাক হয়ে তাকালেন,
– “হ্যা! তুমি কে বাবা?”
– “আণ্টি, আমি পিয়াল, আপনার কলিগ প্রফেসর অমুকের ছেলে”
– “আরে ব্যাটা! এত্ত বড় হয়ে গেছিস রে বাবা!”

৭। আরেকবার বেশ মজার একটা অভিজ্ঞতায় বেশ লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম। কোন এক ব্যাঙ্কের রিক্রুটমেণ্ট টেস্টের রিটেন এক্সাম কণ্ডাক্ট করার দায়িত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ঢাকা শহরের বিরাট এক মহিলা কলেজে সেন্টার কোঅর্ডিনেশনের দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমার বাবার পোস্টিং তখন ঢাকার বাহিরে উত্তরবঙ্গের কোন এক কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে। আর আমি তখন আমার কর্মজীবনের প্রথম দিকে; ফুরফুরে হাওয়া লাগানো ব্যাচেলর জীবন। যাহোক, সেই সরকারি মহিলা কলেজের মহিলা প্রিন্সিপাল যে একসময় আমার বাবার কলিগ ছিলেন, সেটা আমি জানতাম, তবে তাঁর সাথে আমার সামনাসামনি আগে কখনো দেখা হয়নি। যাবতীয় কাজ শেষে আমি সেই কলেজ থেকে বের হবার আগে প্রিন্সিপালের রুমে গেলাম কার্টেসি ভিজিট হিসেবে, এবং এক পর্যায়ে আমি তাঁকে বললাম, “ম্যাডাম, আমার বাবাকে হয়ত আপনি চিনবেন, আপনারা কলিগ ছিলেন”। সেই মুহূর্তে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আরো বেশ কয়েকজন সিনিয়র ফিমেল কলিগের সাথে তাঁর রুমে ছিলেন। আমার কথা শুনে সবগুলো চোখ একেবারে সরাসরি পুঁচকে এই আমার দিকে নিবদ্ধ হলো। বাবার নাম বলার সাথে সাথে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুব আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে বললেন, “আগে বলনি যে!” আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, আসলে পুরো কাজটা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি প্রফেশনালি হ্যাণ্ডেল করতে চাইছিলাম, আর সেজন্যই এই বিদায় বেলায় আমার পরিচয় দেয়া। তিনি বাচ্চা সাইজের এই আমার কথায় হেসে ফেললেনঃ
– “বিয়ে করেছো”?
– “জ্বি না, ম্যাডাম”।
– “কোন পছন্দ আছে?”
– “জ্বি না, ম্যাডাম” (আমি লজ্জায় শেষ)
– “ঠিক আছে। আমার কলেজ থেকে যদি কাউকে পছন্দ হয়, তো বলতে পার। ঘটকালির সব দায়িত্ব আমার”।
সেই মুহূর্তে সেখানে বসা অতজন সিনয়র প্রফেসর্স, এণ্ড অল ফিমেইলস; আমি একজন নব্য নাদান প্রভাষক মাত্র, আমার যে কি অবস্থা, একেবারে নববধুর মত ভাল লাগা মিশ্রিত লজ্জা!!

৮। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন শিক্ষকদের এ্যাসিস্ট করার সময় শিক্ষকদের নিজেদের মাঝে কিংবা টেলিফোনে তাঁরা কারো সাথে কথা বলার সময় বুঝতে পারতাম যে তাঁদের কাছে কেউ হয়তো কোন ছাত্রীর সম্ভাব্য বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। বর্তমানে এমন কোন প্রয়োজনে পরিচিতজনদের কেউ যখন আমার কাছে আমারই কোন বর্তমান বা প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীর বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন, আমি অবাক হয়ে ভাবি, সময় কত দ্রুত পেরিয়ে যায়, কত দ্রুত মানুষের দায়িত্বের অবস্থান পালটায়। এমনও ঘটনা আছে যে, আমি চিনি না এমন বিয়ের পাত্র সহ আমার আমার কোন বন্ধু সরাসরি আমার অফিসে এসে হাজির আমারই কোন ছাত্রীর বৈবাহিক বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবার জন্য। বিষয়টা স্বাভাবিক। আগে ঠিক বুঝে উঠতাম না। এখন এমন বিষয়গুলো কিভাবে যেন কুলমান রক্ষা করে যথেষ্ট ট্যাক্টফুললি হ্যাণ্ডেল করা শিখে গেছি। সময় এবং সময়ের সাথে নিজের অবস্থানের পরিবির্তনই এটা শিখিয়েছে।

৯। কোন শিক্ষকের বিয়ে এ্যাটেণ্ড করা হয়নি। কিন্তু আমার নিজের বিয়েবাড়ি ছিল আমার প্রথম জীবনের ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় সত্যিকার অর্থেই মুখরিত। পঞ্চগড় থেকে দিনাজপুরে বরযাত্রী পৌঁছানোর আগেই ঢাকা থেকে এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ে গিয়ে হাজির। আমি তো বেশ অবাক। সত্যিই সারপ্রাইজড হয়েছিলাম। পরদিন বৌভাতের অনুষ্ঠানে এই পুরো বাহিনী দেখি দুপুরের আগেই পঞ্চগড়ে আমার বাসায় গিয়ে হাজির। শুধু কি তাই, আমার বিয়ের খবর শুনে সেসময়ে দিনাজপুরে অবস্থানরত (বর্তমানে প্রবাসী) এক ছাত্রী তার হাসব্যাণ্ড এবং বাচ্চা সহ গিয়ে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত। এই পুরো টিমটা বিয়ের আসরে বরকে ঘিরে রেখেছিল, জুতো পাহারাও দিয়েছিল। পরবর্তীকালে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি আমার বেশ কিছু প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীর কাণ্ড দেখে যারা আমার মেয়ের জন্মের সময়ে তাদের পরিবার-পরিজন এবং বাচ্চা-কাচ্চা সহ একগাদা গিফট নিয়ে হাসপাতালে এবং পরে আমার বাসায় এসে হাজির। ভালবাসায় সিক্ত হওয়া কজনের ভাগ্যে জোটে? এদেরই একজন আবার নিজের দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় হাসপাতাল থেকে রিলিজ হবার আগেই তার হাসব্যাণ্ডকে দিয়ে আমাকে ফোন করিয়েছে, বাচ্চার নামকরণ নিয়ে তাদের প্রশ্ন, তাদের ধারণা, সাব্জেক্টের কারনে তাদের পছন্দ করা নামের লিঙ্গুইস্টিক (ভাষাগত/ভাষাতাত্বিক) ভুল-ত্রুটি আমি ধরিয়ে দিতে পারব।

১০। একবার অনার্স পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তির সময় ডিপার্টমেণ্টের এক ছাত্রীর বাবার ফোন, তিনি ঢাকায় নেই, অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে, মেয়ের মাস্টার্সে ভর্তির ফরমে গার্জেনের জায়গায় তার পক্ষে যেন আমি দস্তখত করে দেই। সানন্দে কাজটা করেছিলাম। মেয়েটাও বেশ খুশি। মেয়েটার মা বেঁচে নেই। তার যোগ্যতা এবং ভদ্রতা জ্ঞানের কারনে এমনিতেই তার প্রতি আমার যথেষ্ট স্নেহ ছিল। তারপরে আবার, এই ঘটনার কিছুদিন আগে (এই ছাত্রী যখন অনার্সে পড়ত) আমি তার কোন একটা কাজে বেশ বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, “তুমি কি তোমার বাবার সাথে এমন করতে পারতে”? মেয়েটা নাকি আমার এই কথায় বেশ কষ্ট পেয়েছিল, যার ঝাল (!!) মিটানোর আশা পূরণ হয়েছিল মাস্টার্সের ভর্তি ফরমে আমাকে দিয়ে তার বাবার পক্ষে দস্তখত করাতে পেরে। এই মেয়েটাও এখন শিক্ষক, নিজেও এক মেয়ের মা, বিয়ে করেছে আমারই এক ছাত্রকে। তাদের গায়ে হলুদের দিনে আমি সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলাম। তখন আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। রিসিপশন প্রোগ্রামে অবশ্য শুধুমাত্র ডিপার্টমেণ্টের চেয়ারম্যান সহ গিয়েছিলাম। যে সম্মান সেই বিয়ের এবং গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে পেয়েছি, তা কখনোই ভোলার নয়।

১১। খুব ভাল লাগে যখন হঠাত কোন পুরোনো ছাত্র-ছাত্রী তাদের পরিবারে নতুন অতিথি আগমনের সংবাদ দেয়। কিছুদিন আগের কথা, এক ছাত্রীর ম্যাসেজ পেলাম, দোয়া চেয়েছে, ইমারজেন্সিতে সিজারিয়ান অপারেশন হবে। তার হাসব্যাণ্ডও আমার ছাত্র, যে আবার অপারেশনের পরেই আমাকে ফোনে জানাল, সে (বাচ্চার বাবা) ঢাকার বাইরে, এখনো সে তার নবজাতক মেয়েকে দেখেনি। সে তার যাত্রাপথেই ফোনে আমাকে এই সুখবর জানাল। এই ধরণের অনুভুতিগুলো আনন্দ-সম্মান-ভালবাসা মিশ্রিত। এরা আমার অনেক পুরোনো ছাত্র-ছাত্রী, আমার সাথে রেজাল্ট-গ্রেড কোন কিছুর আশা এখন আর এরা করে না, অথচ জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে ঠিকই ফোনে জানায়। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

১২। তখনই সবচেয়ে মজা লাগে, যখন পাত্র-পাত্রী দুজনেই আমার ছাত্র, এবং তাদের গার্জেনরা ফোনে বা সামনা-সামনি দেখা করে হবু বৌমা-জামাই সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন। তবে আমার অফিস রুমে এমন গার্জেনদের আগমনে, খোঁজ-খবর যেমন-তেমন, চা-নাস্তা-গপ্পো-সপ্পোই বেশি হয়।

১৩। প্রথম ব্যাচের এক ছাত্রী (তারও বিয়ে হয়েছে আমারই এক ছাত্রের সাথে এবং তারা এখন দুই কণ্যা সহ প্রবাসী) প্রায়ই ক্লাসে দেরীতে আসত। লেখাপড়ায় এবং অন্যান্য যোগ্যতায় সে কোন অংশেই কম ছিল না (কনভোকেশনে সে ছিল আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে গোল্ড মেডেলিস্ট), শুধু সময়মত কোনদিনই ক্লাসে আসতে পারত না। আর তার চেয়ে বড় কথা হলো, ক্লাসে দরজায় দাঁড়িয়ে সব কটা দাঁত বের করে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে এমন ভাবে “মে আই কাম ইন স্যার” বলত যে, পুরো ক্লাসের সবাই খিলখিল করে হেসে ফেলত। আমি নিজেও হাসি আটকাতে পারতাম না। শি ওয়াজ রিয়েলি ইন্টেলিজেন্ট টু ম্যানেজ হার লেইট কামিং সিচুয়েশন্স। আমারও আর রাগ দেখানো বা ধমকে দেয়া হতো না। তবে একদিন আমি তাকে বলেছিলাম, “আফটার টুয়েন্টি, অর মে বি টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স, হোয়েন আই শ্যাল গ্রো ওল্ড, ইফ আই এ্যাম স্টিল ইন টিচিং, এ্যাণ্ড ইফ সাম গার্ল কামস রেগুলারলি লেইট ইন মাই ক্লাস, এ্যাণ্ড ট্রাইজ টু বি কিউট উইথ অল হার টিথ, সিকিং পারমিশন টু কাম ইন, শিওরলি আই এ্যাম গোইং টু আস্ক হার মাদার্স নেইম”।

১৪। আণ্ডারগ্র্যাডের ফাইনাল সেমিস্টারে ভাইভা রেজিস্ট্রেশন না করে কেউ ইচ্ছা করলে আরেকটা সেমিস্টার পড়তে পারে, যাতে করে একাধিক বিষয়ে কন্সেণ্ট্রেশন (মেজর) করা যায়, এবং সেক্ষেত্রে লাস্ট সেমিস্টারে ভাইভার জন্য রেজিস্ট্রেশন করার নিয়ম। কনভোকেশনের আগে ফাইনাল সেমিস্টারের এক ছাত্রীকে দায়িত্বের খাতিরে ডেকে জানালাম যে, সে যদি কনভোকেশনের আগেই ভাইভা রেজিস্ট্রেশন করে তাহলে এখন পর্যন্ত ক্যালকুলেশনে সেই আর্টস ফ্যাকাল্টির সর্বোচ্চ সিজিপিএ-ধারী হিসেবে ডীনস গোল্ড মেডেল এওয়ার্ড পাবে। আর যদি সে আরেকটা কন্সেন্ট্রেশন করতে চায়, তাহলে সেটা কনভোকেশনের পরে চলে যাবে, এবং পরবর্তী কনভোকেশন পর্যন্ত তাকে অপাক্ষা করতে হবে, এবং ততদিনে অন্য কেউ বেশি সিজিপিএ অর্জন করে ফেললে তার আর এই এওয়ার্ডের সুযোগ থাকবে না। মেয়েটা আমাকে নির্দ্বিধায় সাথে সাথে জানিয়ে দিল, সে পরের সেমিস্টারে আরেকটা কন্সেন্ট্রেশন করতে চায় যেন তার প্রফেশনল লাইফে গিয়ে বেশি এভিনিউ ওপেন থাকে। এই মেয়েটা এখন দেশের প্রথম সারির একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি।

১৫। একবার প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সেমিস্টারেই এক ছাত্রী এসে বলে, ডিপার্টমেণ্ট চেইঞ্জ করবে। কারন সবাই নাকি বলছে, ইংরেজি পড়ে কি হবে! আমি মেয়েটাকে আটকানোর মত কোন কথা বলিনি। তবে সেদিন মেয়েটা আমার রুমে বসে বেশ কিছুক্ষণ মন খুলে কথা বলার (ভেণ্টিলেট করার) সুযোগ পেয়েছিল। এর পরে মেয়েটা আর ডিপার্টমেন্ট চেইঞ্জ করেনি। মেয়েটা পরবর্তিতে ইংরেজিতেই অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছিল, এবং আমার আণ্ডারেই তার মাস্টার্সের থিসিসও করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট ক্লাবের প্রেসিডেণ্ট হিসেবে নিজের যোগ্যতাই শুধু প্রমান করেনি, বরং বাহিরের বিভিন্ন ডিবেট প্রোগ্রামে জাজ হিসেবেও সে স্বাক্ষর রেখেছে। সে এখন মিডিয়া জগতে কাজ করছে। মাঝে কিছুদিন একটা বেশ ভাল মানের কলেজে শিক্ষকতা করেছিল, যেখানে সে জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যেই তাকে ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। এই মেয়েটা ডিপার্টমেণ্টের বিভিন্ন অকেশনে সবার সামনে আমার সম্পর্কে যেভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে, তাতে আমাকে অন্য সব কলিগদের মাঝে বেশ অস্বস্তিতেই পড়তে হয়েছিল। তার বিয়ের দাওয়াত এভয়েড করার কোন উপায়ই সে রাখেনি, বলা চলে বৌ-বাচ্চা সহ আমাকে তার বিয়েতে যেতে সে বাধ্য করেছিল। নিজে তো দাওয়াত দিয়েছিলই, তার বাবাকে দিয়েও এমন ভাবে ফোনে রিকোয়েস্ট করিয়েছিল যে আমি সপরিবারে না গেলে নিজের মনের মধ্যেই একটা অপরাধ বোধের মধ্যে পড়ে যেতাম।

১৬। এই সেমিস্টারে আমার জীবনের একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো। একটু পিছনের গল্প থেকে আসি … ব্যাক্তিজীবনে আমি আড্ডাবাজ টাইপের মানুষ। এমনকি আমার বাবার বন্ধু, ছাত্র, সবার সাথেই আমি আড্ডায় অভ্যস্ত। নিজের বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র, শিক্ষক, ছাত্র, সবাই আমার আড্ডার সার্কেলে আছেন। এতে আমি মোটেও দোষের কিছু দেখি না। বরং এই বিষয়টা আমি খুব এঞ্জয় করি। আমার কর্ম-জীবনে নিজের শিক্ষকের সাথে কলিগ হিসেবে কাজের সুযোগ হয়েছে। দীর্ঘদিনের স্বাধ ছিল নিজের ছাত্রকে কলিগের আসনে দেখার। এবারে সেটারও প্রাপ্তি হলো। কর্ম-জীবনের প্রাপ্তির অংশটা যেন আরেকটু পরিপূর্ণতা পেল।

১৭। আমার মেয়েকে নিয়ে আমার কোন এক লেখায় আমার এক ছাত্রী একবার এমন একটা মন্তব্য করেছিলঃ “মানুষ খারাপ হতে পারে, কিন্তু বাবারা কখনোই খারাপ হতে পারে না; নেভার-এভার।” আমার মতন এত তুচ্ছ-ক্ষুদ্র মানুষের এই প্রাপ্তিগুলোতে আজ মনে হচ্ছেঃ “মানুষের মৃত্যু আছে, কিন্তু শিক্ষকের মৃত্যু নেই”।।

৬,১২৯ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।