পার্সেপশন্স টুয়ার্ডস টিচিং কমিউনিটি
প্রাইভেট টিউটর হিসেবে অভিজ্ঞতা নিয়ে এক্স ক্যাডেটস ফোরামের ফেসবুক পেইজে কদিন আগে অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন। সেখানে একটা স্ক্রীণ-স্ন্যাপশটের পোস্টে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে দেখি বেশ লম্বা হয়ে গেল। লম্বা মন্তব্য অন্যদের বিরক্তির কারণ হতে পারে ভেবে তখন লেখাটা আলাদা করে লিখেছিলাম, যেখানে আমি আগেই পরিস্কার করে নিয়েছিলাম যে, আমার লেখাটাতে কেবলমাত্র প্রাইভেট টিউশন নয়, বরং সার্বিকভাবে টিচিং কমিউনিটির প্রতি প্রায়শই অন্যদের যে দৃষ্টিভঙ্গিটা কাজ করে, সেটাই চলে এসেছে। লেখাটা মোবাইলে টাইপ করেছিলাম বলে হয়ত অনেকটাই অগোছালো ছিল। পরে গুছিয়ে নিয়ে কোথাও ছাপতে পারলে সবার সাথে আবার শেয়ার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। সেই উদ্দেশ্যেই রিভাইজ করে এবং একটু সময় নিয়ে কিছুটা ভাষাগত পরিমার্জণ করে আবার সেই থিমটাকেই এই লেখায় রিপ্রেজেন্ট করার চেষ্টা করছি।
প্রাইভেট টিউশন নিয়ে অন্যদের মত আমারো কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তবে আমার ক্ষেত্রে প্রায় সবই পজেটিভ। নেগেটিভ যে একেবারেই নেই, তা নয়। তবে সবগুলাই নন-ক্যাডেটদের পড়ানোর অভিজ্ঞতা। নিজে ক্যাডেট হিসেবে সেসব জায়গায় আলাদা সম্মানও পেয়েছি, তবে সেটা এখানে মূখ্য নয়। আসল ব্যাপার হলো “এ ডিল ইজ এ ডিল”। শিশু থেকে শুরু করে প্রায় সমবয়সী, এমনকি বয়সে আমার চেয়ে সিনিয়রকেও প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। শুধু প্রাইভেট টিউটর নয়, কর্মজীবনে শিক্ষকতায় থেকে গত ১৪ বছরে এপেশায় অনেক কিছুই খেয়াল করার সুযোগ হলো। কেউ হয়ত বলবেন, এমন তো সব পেশাতেই আছে, ওদিকে ফোকাস না করে কেবল নিজের পেশা নিয়েই কেন লিখছি। সেক্ষেত্রে আমি কখনোই এধরণের সমালোচনাকে অস্বীকার করব না। বরং আমার বক্তব্য এক্ষেত্রে এটাই, আমি আমার পেশা নিয়ে লিখছি, অন্যরা তাদেরটা নিয়ে লিখুক। আমার লেখা প্রায় সবই অটোবাইয়োগ্রাফি টাইপের। কোথাও হয়ত ইমোশনাল এক্সপ্রেশন্স এসে যায়; তবে তাতো যে কারোরই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গিয়ে আসতে পারে।
দুদিন আগে এক্স ক্যাডেটস ফোরামের ফেসবুক পেইজে কেউ একজন সিকুয়েনশিয়াল কিছু স্ক্রীণ-স্ন্যাপশট দিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন, যা ছিল বুয়েটের কোন ছাত্রের গার্লস ক্যাডেট কলেজের কোন এক ক্যাডেটকে ছুটিতে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে। বুয়েট-ছাত্র সেই প্রাইভেট টিউটরের কথাগুলোতে যা কিছু ছিল তাতে এটুকু বোধগম্য যে, বিষয়টা মোটেও সেই ক্যাডেটকে নিয়ে নয়, বরং তা সেই ক্যাডেটের গার্জেনকে নিয়ে, যিনি পড়ানো শেষ হবার পরে চুক্তি অনুযায়ি পেমেন্ট করেননি বা করছেন না। আমার মনে হয়, এখানে মূল বিষয়টা ক্যাডেটের বা নন-ক্যাডেটের প্যারেন্ট নিয়ে নয়; বরং এটা একটা “সার্ভিস সেল এন্ড পার্চেজ” বলে কথা। এই অভিভাবক কোন ক্যাডেটের প্যারেন্ট না হয়ে নন-ক্যাডেট কোন ছাত্রের গার্জেন হলেও এমনটাই হয়ত করতেন। আরেকটু যোগ করতে হচ্ছে, এই ধরণের গার্জেনদের (বিশেষ করে ক্যাডেটদের ছুটিতে ক্র্যাশ-প্রগ্রামে পড়নোর ক্ষেত্রে) পার্সেপশনটা বোধহয় এটাই যে, “মাত্র তো কটা দিন; তার জন্য আবার এত টাকা কেন!” এখানে এটা মনে হয় ধর্তব্যে নেয়াই হয় না যে, এটা এক ধরণের কাউন্সেলিং বা কন্সালটেন্সি সার্ভিস। সেই গার্জেন নিজে বা তার পরিবারের সদস্যরা এটা পারেন বা পারছেন না বলেই টিউটর হায়ার করা হয়েছে। তার পরেও সবার উপরে যে বিষয়টা মূখ্য তা হলো, এক্ষেত্রে একটা ফাইন্যানশিয়াল ডিল লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে; আর প্রাইভেট টিউশনের ক্ষেত্রে এধরণের চুক্তি মৌখিকভাবেই হয়ে থাকে। এসবের বিবেচনায় আমার পরামর্শ, এধরণের মৌখিক চুক্তিতে উভয়পক্ষের পরিচিত কোন একজন মধ্যস্থতাকারির উপস্থিতি একটা পজেটিভ ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা নেবার ক্ষেত্রে, বা শিক্ষকদের দ্বারা কোন কাজ করানোতে, কিংবা শিক্ষকতার পেশায় আছেন এমন কারো সাথে কোন ফাইন্যানশিয়াল ডিলের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকমের মানসিক প্রবনতা কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এসেও আমি দেখেছি। এটা হলো, টিচিং কমিউনিটিকে অবহেলা করার প্রবনতা। বন্ধুরাও যখন বলে, “তোরা আর কি করিস; ক্লাসে গিয়ে তো শুধু লেকচার দিস!” মুখে প্রায় চলে আসলেও কখনোই বলিনি, “আমরাই তোদের তৈরি করি, আর তা দিয়েই তোরা পেট চালাস।” আসলে কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই মা-বাবা-র পরে এই শিক্ষকদের অবদানেই জীবন-জীবিকা চালিয়ে নিচ্ছি। আবার এও দেখেছি, আমার সেই কর্পোরেট বা সরকারি চাকুরে বন্ধুরাই কোন মোটিভাশনাল সেমিনারে লেকচার দেবার সময় বা আন-অফিশিয়ালি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণে কোর্স-কন্ডাক্ট করার সময় বেশ বার্গেইন করেই কাজ করেন, কিংবা তাদের ভাষাতেই “জাস্ট কিছুক্ষণ লেকচার” দেবার জন্য কম্পারেটিভলি মোটা অংকের পারিশ্রমিক আশা করেন।
শিক্ষকতায় এই পরোক্ষ হতাশা আদর্শ মানের এবং মনের ছেলেমেয়েদের অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকতায় নিরুৎসাহিত করছে। এমন নজির আমার জানা আছে বলেই এটা লিখছি। কেবলমাত্র “মহৎ পেশা” আখ্যা দিয়ে শিক্ষকদের আর্থিক বিষয়ে ঘাটতি রেখে দেবার মানসিকতা পরিহার না করলে প্রকৃত শিক্ষক পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়বে। এর প্রভাব যে আমরা ইতিমধ্যে বর্তমান সমাজে কিছুটা হলেও অনুভব করছি না, তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। আমার এই অনুধাবনকে অন্য দিকে প্রবাহিত করে অন্য কিছুর সাথে বা অন্য কোন ক্ষেত্রকে সামনে নিয়ে এসে তুলনা না করলেই মনে হয় এপ্রসঙ্গে আরেক ধাপ অস্বস্তিকে কিছুটা হলেও এড়ানো যায়। তবে অবশ্যই এটাও আমাদের মাঝে বহুল প্রচলিত এক ধরণের মানসিক দৈন্য যে, নিজে ঠিক হব না, কিন্তু দেশ-দূনিয়া-জাতি-সমাজ-প্রতিবেশি-সহপাঠি-সহকর্মি-স্টেকহোল্ডার সবার বিরাট-বিরাট সমস্যা খুঁজে বেড়াব।
আমার বাবাও পেশাজীবনে শিক্ষক ছিলেন; স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস ব্যাচের। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অর্ধেক কেটেছে বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতায়, আর বাকি অর্ধেক প্রেষণে বিভিন্ন গুরুদায়িত্বে। কর্মক্ষেত্রের সর্বোচ্চ আসনে অধীষ্ঠিত হয়ে তিনি অবসর নিয়েছেন ২০০৪/২০০৫ সালের দিকে। প্রাইভেট না পড়িয়ে এবং ব্যক্তিজীবনে শতভাগ সৎ এবং নির্লোভ থেকেও যে আনন্দের সাথে জীবনে অনেক কিছুই অর্জন করা যায়, তা খুব আমি ছোট বেলা থেকেই পারিবারিক ভাবে দেখে-ঠেকে-শিখেছি, এবং নিজেও কর্পোরেট ঘুরে এসে “নট বাই অপশন, বাট বাই চয়েজ” হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছি। আমি প্রচন্ড রকমের সেল্ফ-মোটিভেটেড একজন মানুষ। তারপরেও শিক্ষক কমিউনিটির প্রতি সার্বিক তাচ্ছিল্য, করুণা, দয়া-দাক্ষিণ্যের মনোভাব এবং তাদের সার্ভিসকে “কি এমন কাজ” ভেবে তাদের অবমাননা করার সার্বিক প্রবণতা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। ছাত্রছাত্রীদের দুষ্টুমির ছলে এই সত্যি কথাটা আমি ইদানিং প্রায়ই বলি যে, মাথার তার কিছুটা না ছিঁড়লে এবং প্রচন্ড ধৈর্য্য আর সেল্ফ-মোটিভেশন না থাকলে যেন কেউ শিক্ষকতায় না আসে।
আমার এক ঘনিষ্টজনের প্রকাশনার ব্যবসা আছে। আমার শিক্ষকতার জীবনের প্রথম দিকে তিনি একবার আমাকে বিসিএস গাইডের জন্য কিছু ট্রান্সলেশন এবং কিছু রচনা লেখার কাজ করিয়েছিলেন পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতিতে। কাজটা তার খুব দ্রুততর সময়ে লাগবে, তাই আমি আমার ভীষণ ট্যালেন্টেড দুয়েকজন কলিগ এবং সত্যিকারর্থেই প্রথম মানের কিছু ছাত্র-ছাত্রীর সহযোগিতায় কাজটা যথাসম্ভব দ্রুত করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কাজের পারিশ্রমিক আজ ১২/১৩ বছর পরেও পাইনি। লজ্জায় চাইতেও পারিনি। কাজটা আমি বিনে পয়সাতেই করে দিতাম। কারণ এমন অনেকের অনেক কাজই আমি বিনে পয়সায় করেছি এবং এখনো সময়-সুযোগ পেলে করি। এসব কাজ করতে আমার ভাল লাগে; বলা যায় এ আমার এক ধরণের নেশা। একাডেমিক কাজে এ্যাসিস্ট করার মাঝে আমি এক ধরণের আনন্দ খুঁজে পাই। কিন্তু পারিশ্রমিকের মূলা ঝুলিয়ে-ঠকিয়ে কাজ করানো হলে খুব অপমান বোধ হয়। বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। অর্থের অপ্রাপ্তি এখানে মূখ্য নয়। তবে আমাদের কাজ শেষে সেসময় আমি আমার সেই কলিগদের এবং ছাত্র-ছাত্রীদের একদিন মোটামুটি ভাল মানের একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করিয়েছিলাম; এর বেশি কিছু করা আর সম্ভব হয়নি সেবার।
আবার মাত্র বছর দুয়েক আগে, আমার চেয়ে দুবছর সিনিয়র কিছু এক্স-ক্যাডেটের অনুরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে বেশ সম্মানজক একটা প্রজেক্টের আন্তর্জাতিক মানের অনুবাদের কাজ করে, কাজ পুরোপুরি শেষ হবার আগেই তাঁরা আমাকে যখন ফোন করে বলেন, “কি ব্যাপার! তোমার কি টাকা পয়সার দরকার নাই নাকি! নিয়ে যাও না কেন!” তখন যে আমার কতটা ভাল লেগেছিল, তা বোঝাতে পারব না। এই সিনিয়র ভাইদের কাজের কন্ট্রাক্টে বেশ কয়েকজন আমার চেয়ে অল্প সিনিয়র কিন্তু পেশাদারিত্বের পরিচয় বহনকারি সরকারি চাকুরিজীবিও আছেন। হয়ত তাঁরা এই লেখাটাও পড়ছেন। সঙ্গত কারণেই তাঁদের নাম উল্লেখ করছি না। মজার ঘটনা হলো, যে সিনিয়রদের অফারে আমার এত চমৎকার একটা প্রজেক্টে “ট্রান্সলেশন-কন্সালট্যান্ট” হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আমার জানামতে তাঁদের দুজনের বাবা শিক্ষক। একজনের বাবার কাছে তো আমি নিজেই ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে এসে পড়তে যেতাম। সেই প্রজেক্টের পারিশ্রমিকের একটা বড় অংশ আমি আমার কিছু ছাত্রছাত্রীদের দিয়েছিলাম, যারা আমাকে এই সম্পূর্ণ প্রফেশনাল একটা কাজে সত্যিকারের প্রফেশনালের মত এ্যাসিস্ট করেছিল। তারা টাকা হাতে পাবার পরে যে কি খুশি হয়েছিল বলার মত না। টাকাটা তাদেরকে জোর করেই দিতে হয়েছিল; যেন তারা কাজেই আনন্দ পেয়েছে, টাকাটা মূখ্য ছিল না তাদের কাছে। অন্তত একেকজনকে যে এমাউন্ট দিতে পেরেছিলাম, তা মনে হয় তারা আশা করেনি (আবার আমার রিডিং ভুলও হতে পারে)। তাদের বলেছিলাম, তাদের মা-বাবা-কে যেন সেই টাকার কিছু অংশ দিয়ে তারা কিছু উপহার কিনে দেয়। সেখান থেকেও টাকা বাঁচিয়ে তারা আবার আমাকেই একটা দামী শার্টপিস আর একটা বেশ দামী টাই গিফট করেছিল। তাৎক্ষণিক পারিশ্রমিকের যে কি আনন্দ, আমি সেদিন যেন নতুন করে বুঝেছিলাম। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে এডিটিং প্রক্রিয়ায় থাকা অনুবাদের এই কাজ চলার সময় সেই অল্প সিনিয়র ক্যাডেটদের দুয়েকজন যে সুনিপুনভাবে ধৈর্য্যের সাথে এত বড় একটা প্রফেশনাল কাজের স্টেপগুলো ধরে-ধরে আমাকে শিখিয়েছেন, তার কোন তুলণা হয় না।
যাহোক, আমার ছাত্র-জীবন এবং কর্ম-জীবন উভয় ক্ষেত্রেই অন-রিকোয়েস্টে নিজে পয়সা খরচ করে কাছে গিয়ে অনেকের অনেক একাডেমিক এবং প্রফেশনাল বিষয়ে সাহায্য দিয়েছি। এখন ব্যস্ততা বেড়েছে। নানামুখি প্রায়োরিটিজ-ও রয়েছে। এখন হয়ত সবসময় অতটা পারি না। কিন্তু মানসিকতা তেমনটিই আছে।
কায়-মন-বাক্যে শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আমার বাবার কথা এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আবার আনতে হচ্ছে। আমার বাবার সর্বশেষ ওয়ার্ক-স্টেশন ছিল উত্তরবঙ্গে আমাদের এলাকায় একটা সরকারি কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে। তিনি ঢাকা শহরে প্রেষণের গুরুদায়িত্বে থেকেও নিজেই আবেদন পেশ করে কেবলমাত্র সেবা দানের মানষে নিজের এলাকায় কর্মজীবনের শেষের দিকে বছর খানেকের জন্য পোস্টিং নেন। অবসর নেবার পরে কোন এক সময় তিনি যখন জানতে পারেন যে, তাঁর সর্বশেষ সেই কর্মক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের একটা কম্পালসারি পেপার পড়ানোর কোন শিক্ষক সেই কলেজে সেসময় নেই, তিনি নিজে আগ্রহি হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে টানা একটি বছর ভলান্টারিলি সেই কলেজে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। সেসময় আমার নামে সেল-ডিডে কেনা একটা পুরোনো স্টেশন-ওয়াগন গাড়ি ছিল আমাদের বাসায়, যা বিক্রি করার চিন্তা-ভাবনা চলছিল। আমি তখন ঢাকায়, আমার কর্মক্ষেত্রে; আর আমার প্যারেন্টস পঞ্চগড়ে। গাড়িটি আমাদের এলাকার বেশ ভাল অবস্থাসম্পন্ন এক ব্যক্তির পছন্দ হয়, এবং দাম ফিক্স-আপ হবার পরে তিনি বায়না করেন, এবং কোন একদিন এসে প্রায় পুরো টাকা শোধ করে গাড়িটি নিয়ে যান। যেহেতু আমি ঢাকায়, এবং নতুন সেল-ডিডে নিয়ম অনুযায়ি আমার স্বাক্ষর লাগবে, কথা ছিল ক্রেতা সেল-ডিড হাতে বুঝে নেবার দিনে অবশিষ্ট কয়েক হাজার টাকা পরিশোধ করবেন। আমি স্বাক্ষর করে কুরিয়ারে পাঠানোর পরে সেই ভদ্রলোক বাবার কাছে সেল-ডিড নিতে এসে খুচরো সেই কয়েক হাজার টাকা নিয়ে আজব সুরে জানালেন যে, সেই মুহূর্তে তার কাছে তেমন খুচরো টাকা পয়সা নেই, তাই তিনি গাড়িটির দাম আরো কয়েক হাজার টাকা কম দিতে চান। এমনিতে আমার বাবা অনেক উদার মনের মানুষ হলেও সেই মুহূর্তে তিনি আর ছাড় দিতে রাজি হননি। বাবা জানিয়ে দিলেন, যেহেতু তিনি (ক্রেতা) শর্তসাপেক্ষে গাড়িটি কিনে নিয়ে গিয়ে এতদিন নিজের কাছে রেখেছেন, অতএব গাড়ি তাকেই কিনতে হবে, এবং নির্ধারিত দামেই কিনতে হবে, এবং যতক্ষণ তিনি পুরো টাকা পরিশোধ না করছেন, সেল-ডিড তিনি হাতে পাবেন না। শুধু তাই নয়, বাবা তখন আর কোন রকম বাড়তি ভদ্রতা না করে তার কাছে সেল-ডিডের স্ট্যাম্প-পেপারের টাকাও সাথে আনতে বললেন। দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ক্রেতার সব খুচরো টাকাও জোগাড় হয়ে গেল, এবং দাঁত বের করে হাসতে হাসতে তিনি সেল-ডিডটা নিয়ে গেলেন। এই কথাগুলো এতবছর ধরে আমার মনেই ছিল না। কিন্তু শিক্ষক সমাজের প্রতি সার্বিক পার্সেপশন্স নিয়ে এই লেখাটা লিখতে গিয়ে উপরের এই কথাগুলো যেন মনের মধ্যে খচখচ করে বিঁধেই চলল। শিক্ষক শুধু দিয়েই যাবেন, তাঁরা তো ভদ্র সমাজ, তাঁরা আর যাই হোক সবসময় চক্ষুলজ্জাতেই থেকে যাবেন, মুখ খুলবেন না; এই বিষয়টা যেন অনেকের মনেই ফিক্সড হয়ে গেছে। আমি বাবাকে কত জায়গায় কত আর্থিক লেনদেনে উদার হতে দেখছি। কিন্তু সেদিনের সেই মাত্র সামান্য কয়েকহাজার টাকার বিষয়ে তিনি কেন ছাড় দেননি, তা আমি একজন নিঃস্বার্থ শিক্ষকের শিক্ষক-সন্তান হয়ে যথার্থই বুঝতে পারি।
যাহোক, শিক্ষকতার কাজটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই কাজটাকে আমরা যত ছোট করে দেখব, ততই এই কাজের অযোগ্যরা এই কাজে নিয়োজিত হবে। একজন সিনিয়র অযোগ্য শিক্ষকের তত্ববধানে একজন জুনিয়র শিক্ষকও বারবার অযোগ্যতাই প্রমান করবেন। এর ধারাবাহিকতায় প্রভাবিত হবে ছাত্ররা। তারা (ছাত্ররা) তখন হয় মেধার ঘাটতিতে থাকবে, কিংবা মনের উদারতা কম শিখবে। দুটোর কোনটাই কি আমরা চাই?
………………………………………………
আহমদ মাহবুব-উল-আলম
[আহমদ, সিসিআর, ১৪ তম ইনটেক (১৯৮৮-৯৪)]
আহমদ ভাই,
বেয়াদবি নিবেন না। আপনার লেখাটি তাড়াতাড়ি পড়েছি। আপনি এখানে দুইটি উদাহরণ দিয়েছেন। একটি পজেটিভ একটি নেগেটিভ। সম্ভবত দুইটিই আপনার পেশাগত জীবনের ঘটনা।
মূল পার্থক্য হলো যেসব এক্স- ক্যাডেট ফেসবুকে লিখেছে তারা শিক্ষা জীবন এখনো শেষ করেনি। বেশীরভাগ /অনেক ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট পড়িয়ে নিজেদের খরচ চালায়। তারা উপভোগ করার জন্য টিউশন করায় না, প্রয়োজনের খাতিরে করে। অসচ্ছল বাবা-মায়ের কাছে মাস শেষে টাকা না চাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে।
এসব ছাত্র ছাত্রীরা না পারে তাদের দুর্দশার কথা সইতে, না পারে বলতে। মাস শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে তারা পয়সা চায়। তাদের অনুভূতির সাথে অভিজ্ঞতার সাথে আপনারটা ঠিক মেলানো যাচ্ছে না।
বিবেক হলো অ্যানালগ ঘড়ি, খালি টিক টিক করে। জীবন হলো পেন্ডুলাম, খালি দুলতেই থাকে, সময় হলে থেমে যায়।
রেজা,
তুমি আসলেই মনে হয় বেশ তাড়াহুড়ো করে পড়েছো। মূল সুরটা তাই ধরতে পারনি। তুমি যেটা লিখেছো, সেটার বিষয়ে আমার লেখায় কিন্তু কোনই দ্বিমত নেই। আমি আমার লেখাটাকে শুধুমাত্র প্রাইভেট টিউশন নিয়ে লিখিনি। জীবনের যে অবস্থাতেই যে শিক্ষক থেকেছে, তার প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আমার এই লেখা। ভাল থেকো! (সম্পাদিত)
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
আরেকটা কথা ভাইয়া। আমি খুব ভাল ভাবেই জানি প্রাইভেট পড়িয়ে অনেকেই কিভাবে পড়াশুনা চালায় এবং বাড়িতে টাকা পাঠায়। আমার দৃষ্টিতে তিনিও একজন শিক্ষক। বাসার বাচ্চার এই শিক্ষকের শিক্ষকতাকেও ছোট করে দেখার বা তাকে ঠকানোর কোনই জাস্টিফিকেশন নেই।... সম্ভব হলে পুরো লেখাটা সময় নিয়ে পড়ে নিও। (সম্পাদিত)
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
... ... ... এটা আসলেই অনেক কষ্টের।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
ব্লগে এই লেখাটা পড়ে আমার মাস্টার্সের একজন ছাত্রী আমাকে তার অনুভূতি জানিয়েছেঃ
"Sir .... লেখাটা প্রথমে পড়তে গিয়ে কেন জানি আমার মনে হয়েছে Title টা বাংলায় হলে ভাল হত... 🙂 এই যেমন ... "শিক্ষকসম্প্রদায় এর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি .... "
আমার শিক্ষকতা জীবন মাত্র 5 years .... 1st দিন পড়াতে গিয়ে একটু nervous ছিলাম ...পড়িয়েছিলাম গুছিয়ে ঠিক যেমন করে আমার sir দের কাছে পড়তাম তেমন করে....
45 min পড়িয়েছিলাম মনে আছে .... বাসায় আসার পর আম্মা বলল "কিরে এত কম সময় পড়ালি!!! "আমি বললাম 1st day তো তাই পড়া বুঝিয়ে দিয়ে আসছি...কাল থেকে ঠিক হবে "
2012 থেকে 2016 পর্যন্ত 14 জন students কে পড়াইছি আলাদা আলাদা বাসায় গিয়ে.... teachers দের প্রতি positive attitude খুব কম মানুষের ই আছে.... আমি আজ পর্যন্ত 2000 টাকার উপরে খুব কম tutiony ই করেছি .... একটা class 8 এর student কে সব subject পড়ানোর পরে 2000 taka দিতেও অনেক সময় তাদের খুব কষ্ট হত এমন ভাব থাকতো .... ব্যক্তিগত জীবনে তারা অনেক ব্যয় করে ....এবং খুব উচ্চবিলাসী জীবন যাপন করে সেটা আমার নিজের চোখে দেখা but teacher এর বেতন দিতে গেলে ই দেখা যায় যত অভাব ....
খুব ই তিক্ত কিছু experience আছে.....
দেখা যায় কোন এক মাসে students রা গ্রামের বাড়ি গেল বা মাসের অর্ধেক সময়ে exam শেষ হয়ে গেল তখন তারা আমার পুরা বেতন এর অর্ধেক টাকা কেটে রেখে দিল.... but যে কয়দিন exam থাকতো আমি regular পড়াতাম সেটা তাদের বিবেচনায় থাকতো না.... একটা Teacher 16 days পড়ায় month এ ... আমি এক্সাম এর time এ 12 days টানা পড়িয়ে ও half sallery নিয়ে চলে আসছি অনেক.... আম্মা বকতো ..."আমরা তো কোনদিন তোদের sir দের বেতন কাটি নাই "
আমি আম্মাকে বলি " বাদ দাও আম্মা.... আমার নিজের কাছে ছোট লাগে নিজেরে বেতন নিয়া এমন বলতে "
বেশির ভাগ মানুষ teachers দের দিনমজুর এর চোখে দেখে মনে হয়....
আমি একবার মাসের 25 দিন পড়ানোর পর student এর আম্মা আমার 200 taka কেটে রেখে 1800 Taka দিল... আমি সেটা বাসায় আসার পর দেখলাম ... আম্মা বলছে দিয়া আসো টাকা এসব ছোট লোকের টাকা লাগবে না....
আমি কিছুই বলি নাই। ওই মহিলা নিজেও একটা school এর teacher .... খারাপ লাগছিল ..200 taka তেমন কিছু না but উনি না করলেও পারতো ....
এমন আরো অনেকে করেছে.... তাদের বাচ্চাদের আমি এর পরেও পড়াইছি ....
সবাই teaching টা কে অনেকটা free service চিন্তা করে... 🙂
but অনেকে ই অনেক ভাল ... তাই profession টা আমার পছন্দ .. :)"
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
আসলে কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই মা-বাবা-র পরে এই শিক্ষকদের অবদানেই জীবন-জীবিকা চালিয়ে নিচ্ছি - কি আশ্চর্য! এই নিদারুণ সত্য কথাটা আগে কখনো মনে আসেনি।
তাৎক্ষণিক পারিশ্রমিকের যে কি আনন্দ, আমি সেদিন যেন নতুন করে বুঝেছিলাম - সুখপ্রদ এই সাফল্যের কথা জেনে আমি নিজেও আনন্দ উপভোগ করলাম।
কিন্তু সেদিনের সেই মাত্র সামান্য কয়েকহাজার টাকার বিষয়ে তিনি কেন ছাড় দেননি, তা আমি একজন নিঃস্বার্থ শিক্ষকের শিক্ষক-সন্তান হয়ে যথার্থই বুঝতে পারি - আমিও পারলাম, যদিও আমি নিজেও শিক্ষক নই, আমার বাবাও ছিলেন না। তবে দাদা ছিলেন।
এই কাজটাকে আমরা যত ছোট করে দেখব, ততই এই কাজের অযোগ্যরা এই কাজে নিয়োজিত হবে - নিঃসন্দেহে তাই হবে। তিন জনের পাওনা কখনো বকেয়া রাখতে নেইঃ ডাক্তার, শিক্ষক আর আইনজীবি (আসলে লারো পাওনাই কখনো বকেয়া রাখতে নেই!)।
এ সুন্দর আলোচনাটা কোন কারণে মিস করে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে পড়ে যাওয়াতে আনন্দিত এবং মানসিকভাবে উপকৃত হ'লাম।
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জেনো, আহমদ।
কয়েকটা টাইপোঃ তুলণা>তুলনা, মানষিক>মানসিক, প্রবনতা>প্রবণতা
ভাইয়া, আপনার মন্তব্যে সত্যিই বেশ সম্মানিত বোধ করছি। লেখাটা যে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন, বুঝতে পারছি, এবং তাতে অনেক ভাল লাগছে। আর, বানানগুলো শুধরে দেবার জন্য ধন্যবাদ।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম