আমি কি? শিক্ষক? – ১ম পর্ব
আমি কি? শিক্ষক? – ২য় পর্ব
যারা ১ম পর্বটা মিস করেছেন, তারা এখানে ক্লিক করে পড়ে আসতে পারেন। ১ম পর্বটা না পড়ে থাকলে ২য় পর্বটা খুব বেশি সাব্জেক্টিভ মনে হতে পারে।
[শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা আমার পুরোনো একটা ব্লগে আমারই একটা প্রাসঙ্গিক মন্তব্যকে বেশ খানিকটা এডিট করে এই ব্লগটা লিখেছি।]
প্রায় ১০/১২ বছর আগের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। সেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার আমার প্রথম দিকের ঘটনা। মাস্টার্সের একটা থিওরিটিক্যাল কোর্স পড়াচ্ছিলাম। কোর্সটা বেশ রসকসহীন এবং যথেষ্ট কাঠখোট্টা টাইপের। আর আমিও কখনোই মনে করি না যে, শিক্ষক হিসেবে আমার নিজের কোন দূর্বলতা নেই। যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম যেন সবাই কোর্সের টপিকগুলোর মূল বিষয়টা ধরতে পারে। আর যেখান থেকে পারি ইণ্টারেষ্টিং এক্সাম্পল যোগাড় করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, যেন ছাত্রদের এটেনশন টপিকের মধ্যে কনসেণ্ট্রেট করাতে পারি। তার ওপরে আবার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার প্রথম ২/৩ বছরের মধ্যেই ছিল সেই সময়টা। কাজেই আপ্রাণ চেষ্টায় ছিলাম যাতে করে শিক্ষক হিসেবে নিজের রেপুটেশন টিকে থাকে, অর্থাৎ কোর্সের টপিকগুলো বুঝতে যেন ছাত্রদের অসুবিধা না হয়।
যে সময়টার কথা বলছি, তখন ডিপার্টমেণ্টের কোন ছাত্র আন্ডারগ্র্যাজুয়েট থেকে মাস্টার্সে প্রমোশন পায়নি। কোর্সে যারা ছিলেন প্রায় সবাই ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পাস-কোর্স বা অনার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের। সম্ভবত সেসময়ে অন্য কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে আসা কোন ছাত্র আমার আণ্ডারে মাষ্টার্সের কোন কোর্সে ছিল না। আমি তখন নিজেই মাত্র তিন-চার বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে এসেছি। আর সেজন্য মাষ্টার্সের সেসময়ের ছাত্রদের আমি “আপনি” বলে সম্বোধন করতাম। সেসময়ের সেই বয়সী ছাত্রদের “তুমি” সম্বোধন করতে বেশ অস্বস্তি হতো। তাদের অনেকে আবার আমার থেকেও বয়সে সিনিয়র ছিলেন।
যাহোক, এদের মধ্যে একজন ছাত্রী এই কোর্সে “সি” কিংবা “সি-মাইনাস” বা “সি-প্লাস” গ্রেড পায়। তার হাসব্যন্ড দেশের প্রথম শ্রেনির স্বনামধন্য সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একজন সরকারি কর্মকর্তা (ইঞ্জিনিয়ার), আমাদের দু-তিন বছরের জুনিয়র (নন-ক্যাডেট), এবং আমার চেয়ে বয়সে দুয়েক বছরের ছোট অন্য ডিপার্টমেণ্টের আমার দুয়েকজন কলিগেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের জুনিয়র, আর সেই হিসেবে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের আমার ক্যাডেট কলেজের ব্যাচমেটদের জুনিয়র তো বটেই। গ্রেড নিয়ে দেখা গেল তাদের বেশ অসন্তোষ। ছাত্রীর হাসব্যান্ড আমার কাছে আসলেন, এবং আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, তার স্ত্রী অর্থাৎ আমার ছাত্রী এসে যেন খাতাটা দেখে যায়, যদিও ফাইনাল পরীক্ষার খাতা দেখানোর প্র্যাক্টিস নেই। আর তাতেও সন্তুষ্ট না হলে তারা চাইলে খাতা রি-এক্সামিন করার জন্য এপ্লাই করতে পারেন।
প্রসংগতঃ বলে রাখি, আমি আমার ছাত্রদের অভিভাবকদের যথেষ্ট সম্মান দেই; আগেও দিয়েছি, এখনো দেই। ছাত্রদের গার্জেনদের কেউ আমার অফিসে আসলে চেষ্টা করি অন্ততঃ এককাপ চা খাওয়াতে। এই বিষয়টা আত্মিক। কারন আমার মা-বাবা-কে আমার শিক্ষকদের কাছে অনেক সম্মান পেতে দেখেছি। আমার মা-বাবা-কেও দেখেছি বরাবরই আমার শিক্ষকদের সাথে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করে কথা বলতে। শুধু তাই নয়, আমার শিক্ষক বাবা-কেও দেখি এখনো তাঁর শিক্ষকদের অনেক সম্মান করেন, আর এখনো নিজের পুরোনো ছাত্রদের সাথে তাঁর কত মধুর সম্পর্ক। আমার স্ত্রী জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তার শিক্ষকদের সাথেও, এমনকি তাঁদের মধ্যে যাঁরা আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিলেন, তাঁদের সাথেও আমি বিভিন্ন সময়ে দেখাসাক্ষাতে যথাসাধ্য সম্মান প্রদর্শন করেই কথা বলেছি।
যে ঘটনার কথা বলছি, সেবারেও স্বজ্ঞানে আমার তরফ থেকে আন্তরিকার কোন ঘাটতি ছিল বলে মনে পড়ছে না। তবে আমার এত পজেটিভ আগ্রহ বোধহয় সেই গার্জেনের পছন্দ হয়নি। তিনি সরাসরি খাতা রি-এক্সামিন করাতে চাইলেন। আমি এব্যাপারেও তাকে সাহায্য করব বলে ঠিক করলাম। হাজার হোক, একজন ছাত্রের গার্জেন। এরই মাঝে টুকটাক গল্প হচ্ছিল। কিন্তু ভুল করেও আমি তাকে একবারের জন্যও বলিনি, বা আমার কোন ইঙ্গিতে বুঝতেও দেইনি যে, তার স্ত্রী আসলেই বেশ খারাপ পরীক্ষা দিয়েছে এবং তার ইংরেজির আবস্থা সেই পরীক্ষার খাতায় খুবই নিম্নমানের ছিল। বরং, কথাপ্রসংগে আমি আমার ছাত্রীর হাসব্যান্ডকে এটাও বোঝাতে চাইলাম যে, কিছু কোর্স তো এমন থাকেই, একটু কাঠখোট্টা টাইপের। আর এই কথাটা বলাই যেন আমার কাল হলো। সাথে সাথে আমার মুখের উপরেই তার ঝাঁঝালো প্রত্যুত্তর, “কোর্স না, শিক্ষকের উপরেই ডিপেন্ড করে একজন ছাত্র কেমন করবে” (অনেকটা এই রকমেরই ছিল মন্তব্যটা – বেশ পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে লিখছি)। আমি হতবাক হয়ে গেলাম, বেশ কয়েকটা কারনে। প্রথমতঃ আমি শুধু তার স্ত্রীর শিক্ষকই নই, বরং বয়সে তারও সিনিয়র। দ্বিতীয়তঃ তার স্ত্রীর ইংরেজির অবস্থা আসলেই খুব খারাপ ছিল। অন্য কোন ফ্যাকাল্টি যদি তাকে কখনো বেশি গ্রেড দিয়ে থাকেন, কিংবা আমারটার জায়গায় অন্য কোন কোর্সের পরীক্ষার খাতায় যদি ঘটনাচক্রে সে শুদ্ধ এবং ভাল ইংরেজি লিখে থাকে, সেটার জন্য তো আমি দায়ি না। কিন্তু এই কথাগুলো আমি সেই গার্জেনকে বলতে পারছিলাম না; কারন একজন হাসব্যান্ডকে কিভাবে বলি যে, আসলে তার স্ত্রী ছাত্রী হিসাবে আমার কোর্সে বেশ নিম্নমানের ছিল। তার হাসব্যান্ডের কথাগুলো এবং কথা বলার ধরন সম্পর্কে অবশ্য আমি আমার সেই ছাত্রীকে কখনোই কিছু বলিনি বা বুঝতে দেইনি; আর বলিই বা কিভাবে যে, তার হাসব্যান্ড (একজন গার্জেন) আমার সাথে ইনসাল্টিং সুরে কথা বলেছেন।
এরপরে সেই মুহূর্তে সেই গার্জেনকে আমার দায়িত্বের বাইরে আর কোন অতিরিক্ত সহযোগিতা দেবার ইচ্ছা নিভে গেল। আমি ইচ্ছা করলেই তাকে রি-এক্সামিন করার ফরমালিটিগুলো বুঝিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আর ভাল লাগছিল না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এরপরেও যদ্দূর মনে পড়ে, খুব নরম সুরে আমি শুধু এইটুকু বলেছিলাম, “আপনি এক্সাম অফিসে যোগাযোগ করুন। আমার হাতে আর কিছুই করার নেই।”
তারপরের ঘটনা (পুরোনো স্মৃতি থেকে লিখছি) – পরে জেনেছি, সেই ছাত্রের রি-এক্সামিনেশনের এপ্লিকেশনটাতে আমার ডিপার্টমেণ্টের হেড অনেকগুলো লাল কালির দাগ দিয়েছিলেন – ভুল ইংরেজিতে ভরপুর। রি-এক্সামিনেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমার আরেক কলিগ-কে। পরে যদ্দূর জেনেছি, রিক্সামিনেশনে তার মন্তব্যটা ছিল অনেকটা এমন, “এই আনসার-স্ক্রিপ্ট যে মার্ক্স ডিসার্ভ করে, তার চেয়ে যথেষ্টই দেয়া হয়েছে”।
পরবর্তীতে সেই ছাত্রীর কাছেই আমার সাথে অন্য কোন কোর্স চলাকালিন সময়ে কথপোকথনে বুঝতে পেরেছিলাম যে, এতকিছু করার পিছনে তাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো এমন একটা সিজিপিএ পাওয়া যাতে করে ঢাকা শহরের নামি-দামি কলেজগুলোতে ফেকাল্টি পোজিশনের জন্য এপ্লাই করা যায়। এটা জেনে আমার দূঃখ যেন আরো বেড়ে গেল। কেন, তা ঠিক বোঝাতে পারব না।
এই ঘটনাটা একটা বিক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা মাত্র। এখানেই জীবনের শেষ নয়, বা জীবন এত ছোটও নয়। শিক্ষকতায় আমার তৃপ্তি বা প্রাপ্তির দিকটা অনেক ভারি। আমার অনেক প্রাক্তন ছাত্রই কেবলমাত্র তাদের নিজের যোগ্যতায় আজ সুপ্রতিষ্ঠিত, একাডেমিক এবং প্রফেশনাল, দুদিক থেকেই। এটাই বোধহয় একজন শিক্ষকের স্বার্থকতা এবং স্বার্থহীন আনন্দ। তবে জীবনের চলার পথে কিছু ঘটনা মনে ক্ষত রেখে যায়। অনেক কিছুই তো আমরা ক্ষমা করে দেই, কিন্তু ভোলা কি যায়?