মনস্তত্ব এবং মনোঃছবি – কিছু এলোমেলো স্মৃতি ও বিক্ষিপ্ত চিন্তা
[এটা সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যবিহীন বিক্ষিপ্ত একটা লেখা – অনেকটা বকবকানির লিখিত ভার্শন]
মনের চাপ খুব বাজে একটা ব্যাপার। কোন কাজে মন বসে না, আর চাপটা বাড়তেই থাকে। এরকম চাপ মন থেকে বের করে দেয়াই ভাল। কিন্তু আসলে কিভাবে তা বের করা যায়, তা আমরা আর কতটুকুই বা জানি। হয় কাউকে ধরে মনের কথাটা বলা শুরু করি – তাও তো আবার অনেক সংশয় – বলা ঠিক হচ্ছে কিনা – কিরকমের প্রতিক্রিয়া হতে পারে – আমার কথাটা ঠিকমত বুঝবে তো – আমার কথাটার গোপনীয়তা থাকবে কিনা – কথাটা কোথাও মিসকোটেড হবে কিনা – আরো কত যে চিন্তা! মুখে আমরা যতই নিঃসংকোচ হবার বুলি আওড়াই না কেন, সংশয় থেকে নিস্তার পাওয়া আসলেই অনেক কষ্টকর। যারা এর বাইরে যেতে পারেন, তাদেরকে আমার অনেক সুখী মনে হয়।
এদিক থেকে মনে হয় শিশুরা অনেক ভাল আছে। তাদের তো কোন সংশয় নেই – না থাকাটাই স্বাভাবিক। শিশুরা যা খুশি বলে ফেলতে পারে। তাদের কাজকর্মকে সাদামাটাভাবে আমরা নিষ্পাপ বলেই গণ্য করি। অথচ, মজার ব্যাপার হল, শিশুমনের এই প্রতিফলন কিন্তু আবার একেকজনের একেকরকম। বাচ্চাদের একটা কমন সাইকোলোজিক্যাল ফ্রিকোয়েন্সি থাকলেও কিছু বাচ্চার আচরণের মধ্যে আমরা যে কিছুটা ভিন্নতা দেখিনা, তা কিন্তু না – ভিন্নতা অবশ্যই আছে – পজেটিভ-নেগেটিভ দু’রকেমেরই আছে।
আমার অবজার্ভেশন হল, শিশুরা নিজেদের কাছাকাছি আসতে চায়। তাদের জগতটা আমাদের থেকে আলাদা। আমার একমাত্র মেয়েটার বয়স প্রায় দেড় বছর। পাবলিক প্লেসে তার মতন আরেকটা বাচ্চাকে দেখলেই সে একটা অন্যরকমের এক্সপ্রেশন দেয়া শুরু করে। যেন কতদিনের চেনা কারো সাথে দেখা হল। ব্যাপারটা আমার বেশ মজা লাগে। আমার মনে হয়, তারা বোধহয় তাদের পরিচিত এডাল্ট-সার্কেলের বাইরে তাদের মত কারো সাথে নিজেকে একাত্ম করতে চায়। কিন্তু কিছু বাচ্চাকে আমি বেশ আক্রমনাত্মক দেখেছি। তারা হঠাত বিনাকারনে অন্য আরেকটা বাচ্চাকে, বিশেষ করে তার থেকে দূর্বল বা ছোট কাউকে, আচমকা আক্রমন করে বসে। কারনটা কি হতে পারে, ভেবে কুলকিনারা পাইনি। তবে নিজের কিছু ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। সে বিষয়ে পরে আসছি, আগে কিছু বিক্ষিপ্ত স্মৃতি শেয়ার করে নেই –
১। আমার একমাত্র ছোট বোনের (নোশিন) সাথে আমার বয়সের বিস্তর ফারাক। বাইশ/তেইশ বছরের ব্যবধান। আসলে সে আমার হাফ-সিস্টার। বয়সের ব্যবধান আমাদের দু’ভাই-বোনের নির্মল বন্ধুত্বের মাঝে কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। নোশিনের ছোটবেলাকে হিসেবে নিলে বলা যায় অনেকটা সন্তানের মতন আমার কোলে-পিঠে তার বেড়ে ওঠা। ধীরে-ধীরে বোনটা আমার বড় হল। এখন ক্লাস টেন-এ পড়ে। খুব সাধাসিধা টাইপের। সবকিছু বাসায় এসে তার শেয়ার করা চাই-ই-চাই। স্কুলে কি হল, বান্ধবীদের কে কি করল বা বলল, স্যার-ম্যাডামদের কে কিরমের এক্সপ্রেশন দেন – কোন কিছুই বাদ যায় না। সব টিন-এজার সম্ভবতঃ এমনটা হয় না। অন্ততঃপক্ষে আমরা অনেকেই পুরোপুরিভাবে এমনটা ছিলাম না। টিন-এজারদের অনেক গোপনীয়তা থাকে, কিছু চালাকি থাকে। কিন্তু আমার এই বোনটার মাঝে অত বেশি গোপনীয়তা নেই, শুধু কয়েকজন বান্ধবী মিলে একসাথে আড্ডা দেবার সময়টা ছাড়া। কিন্তু তাও আবার পরে অধিকাংশ সময় গড়গড় করে প্রায় সব বলে দেয়। আমার কাছে বা আব্বার কাছে না বললেও বাসায় কারো না কারো কাছে বলে – হয় আম্মার কাছে, নয়তো আমার স্ত্রীর কাছে। যাই হোক, কেন যেন বিষয়টা আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে – ভেবে দেখলাম নোশিনের ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা একভাবে – আবার তার সমবয়সী আরেকজন টিন-এজারের বেড়ে ওঠা হয়তো আরেকভাবে। যে যেভাবে বেড়ে উঠছে তার মনস্তাত্বিক বিকাশ সেভাবেই হয়ে যায়। সেভাবেই প্রতিফলিত হয় তার মনোঃছবি। আব্বু-আম্মু-ভাইয়া এই তিনের গন্ডির বাইরে যাবার সুযোগ তার খুব একটা হয়নি। এই ছিল তার শৈশব-জগত। আর আমরাও তার সাথে সর্বোত্তম বিশ্বস্ততা, মমতা এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরিতে স্বচেষ্ট ছিলাম। কোন থিওরি মেনে এমনটা করা হয়নি – এমনি-এমনিতেই পারিবারিকভাবে এটা হয়েছে। যার ফলে, কোন কিছু লুকোতে হবে, এমনটা তার হয়তো কখনো দরকার পড়েনি। বোনটা আমার অনেক উদার হয়েছে – অনেক মানে আসলেই অনেক – কিছুটা গাধার মত – বান্ধবীদের দ্বারা প্রায়ই বিভিন্ন আবদারের শিকার হয়। আমরাও এটা মেনে নেই – হোকনা সে একটু অন্যরকম! আমাদের মত এত স্বার্থের জালে সে নাই বা আটকালো – তাতে আর কি-ই-বা এমন ক্ষতি হবে! – কিছুদিন আগের কথা – স্কুলের পিকনিকে যাবে – “ভাইয়া তোমার কাছে একশটা টাকা হবে … আচ্ছা থাক আব্বুর কাছে নিব” – “কেন, কি করবি?” – “স্কুলের পিকনিকে যেখানে যাচ্ছি, সেখানে অনেক রাইড আছে। আমার কাছে একশ টাকা আছে, আর একশ টাকা হলে ভাল হয়। আচ্ছা থাক আমি নাহয় আব্বুর কাছে নিব” – এই হল তার নমুনা। আমি এখন হাসব, নাকি কাঁদব। যাই হোক আমি তার হাতে তিনশ টাকা দিয়ে বললাম, “এটাতে হবে?” – “হ্যাঁ! হ্যাঁ! অনেক!” – আমি তার হাতে আরো এক হাজার টাকার একটা নোট আর আমার একটা মোবাইল ফোন দিয়ে বললাম, “এই দুইটা তোর ব্যাগের ভিতরে কোথাও লুকিয়ে রাখিস। দরকার পড়লে মোবাইলটা অন করবি, আর বিপদে পড়লে এই টাকাটা ব্যবহার করবি” – “আরে এইগুলা লাগবে না” – “ঠিক আছে সাথে রাখ, ফিরে এসে এই এক হাজার টাকা আর মোবাইলটা ফেরত দিস”। পিকনিক থেকে ফিরে এসে নোশিন আমার হাতে মোবাইল তো ফেরত দিলই, সাথে ফেরত দিল তের’শ টাকা। আমি তো তাজ্জব! – “কি রে, টাকা লাগেনি?” – “আমার কাছে যে একশ টাকা ছিল, ওইটা দিয়েই হয়ে গেছে” – পেট ফেটে হাসি আসছিল। তারপরেও সামলে নিলাম। বয়সে ছোট হলেও তার সরলতা এবং সততাকে সম্মান না করে পারলাম না।
২। গত শুক্রবারে রকা’র (রংপুর ওল্ড ক্যাডেটস এসোসিয়েশনের) পিকনিক ছিল। এর মধ্যে গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকজন নিকট আত্মিয়ের মৃত্যুর কারনে মনটা অত ভাল ছিল না বলে ভেবেছিলাম এবারের রকা’র পিকনিকে যাব না। তবে শেষ মুহূর্তের মাত্র দুই ঘন্টার সিদ্ধান্তে পিকনিকে গেলাম। ব্যাচমেটদের যাদেরকে বলেছিলাম যাচ্ছিনা, বা যারা বাসার কাছাকাছি আছে, তাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলাম, যদি পার্টিসিপেন্টস বাড়ানো যায় এই আশায়। কেউ তেমন সাড়া দিল না – আসলে শেষ মুহূর্তে এভাবে হঠাত করে সাড়া দেয়াও যায় না। যাই হোক পিকনিক স্পট ছিল শফিপুর আনসার একাডেমিতে। অনেক সিনিওর-জুনিওরের মাঝে পুরোনো বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সান্যিধ্য পেলাম সেদিন। খুব ভাল কেটেছে সময়টা, যদিও ব্যাচমেটদের মিস করছিলাম। অনেক ছোট-ছোট বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। সেটা দেখে আমার দেড় বছরের মেয়ে আরিশা’র সে কি আনন্দ। মিউজিকের তালে-তালে সেও দেখি দুলছে – ইদানিং সে প্রায়ই এটা করে। অন্য বাচ্চাদের পাশে সে দিব্যি নিজেকে মিলিয়ে-মিশিয়ে নিল। আরিশা’র সমবয়সী অন্য বাচ্চারাও দেখি তারই মত একে অন্যের সাথে এনজয় করছে। এই লেখাটা শুরু করার কিছুক্ষন আগে দেখলাম ফেসবুকে এক সিনিওর ভাইয়ার স্ত্রী সেই পিকনিকের বেশ কিছু ছবি আপলোড করেছেন। তার মধ্যে বেশ করেকটা সেদিনের পিকনিক স্পটে বাচ্চাদের বিভিন্ন কার্যকলাপের দৃশ্য। একটাতে একজন আরেকজনের হাত ধরে টানছে – দেখে মনে হচ্ছে, না জানি কতজনমের হরিহর আত্মা। আরেকটাতে দেখি একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে আছে – কি যে ভাল লাগল ছবিগুলো দেখে। সত্যিকারের হেভেনলি দৃশ্য বোধহয় একেই বলে।
৩। দু’দিন আগে ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার সাথে-সাথে মনি, মানে, আমার বউয়ের প্রস্তাব, “আড়ং যাবা? সেল চলছে!” – মনে মনে হেসে ফেললেও মুখে হাসি আনিনি – বউকে চটানোর কোন মানে হয় না। আর আমি এটাও ভাল করে জানি, মনি ঘুরে-ফিরে সব দেখবে, যেটা দরকার নাই সেটাও খুঁটে খুঁটে দেখবে, পছন্দও করবে, আর শেষ মুহূর্তে বলবে, “না থাক আজকে কিনব না, চল বাড়ি যাই”। কয়েকদিন আগে আমাদের ম্যারেজ ডে ছিল। সেসময়ে বেশ কয়েকজন নিকট আত্মিয়ের মৃত্যুর কারনে এবারের ম্যারেজ ডে’তে মনি’কে কিছু দেয়া হয়নি। ভাবলাম এটাই সুযোগ, সেল-এর মধ্যে কিছু পছন্দ করলে গছিয়ে দেয়া যাবে – রথ দেখা আর কলা বেচা, দুইই হবে। গেলাম আড়ং-এর আসাদ গেট শাখায়, যেখানে শেষ পর্যন্ত মনি’র পছন্দ হয়েছে মেয়ের জন্য খুব ছোট্ট একটা কাপড়ের তৈরী হাঁস, আর একটা চট এবং কাপড় দিয়ে তৈরী পাপেট। মন্দ না। সস্তায় পার পেয়ে গেলাম। তো যাই হোক, মনি যখন ঘুরে-ফিরে এটা-সেটা দেখে তার চোখের এবং প্রানের সখ মিটানোতে ব্যস্ত, আমাদের দেড় বছরের মেয়ে আরিশা আমার আঙ্গুল ধরে গুটিগুটি পায়ে আড়ং-এর ফ্লোরে ঘুরে বেড়ানোতে মত্ত। কোন ছোট বাচ্চা দেখলেই তার সেই একাত্ম হবার মনোভাব। এরই মাঝে একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে, আরিশা’র চেয়ে হয়তো বছর খানেকের বড় হবে, দৌড়ে এসে আমার মেয়েকে লাথি মারতে উদ্যত হল। আমি হতবাক! আমার মেয়েকে মারতে আসছে, আমার তো রীতিমত কলিজায় গিয়ে লাগছে। এদিকে রাগও করতে পারছি না, সেটাও তো আরেকটা বাচ্চা, রাগ করি কিভাবে। সম্ভবতঃ বাচ্চাটার আরেকটা বড় ভাই, আট/নয় বছরের হবে হয়তোবা, ধুম-ধাম ছুটোছূটি করে বেড়াচ্ছে। আর বাচ্চাদুটোর মা ভীড়ের মধ্যে সেল ফুরিয়ে যাবার আগেই কার্যসিদ্ধিতে ব্যস্ত। এদিকে আমার আরিশা এই লাথি জিনিষটার সাথে পরিচিত নয়। তাই সে মনে করছে ওই বাচ্চাটা বোধহয় তার সাথে খেলতে চাইছে, আর এটা বোধহয় এক ধরনের খেলা। আমি সাবধানে আমার মেয়েকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে ওই বাচ্চাটাকে “অমন করে না বাবা” টাইপের কিছু একটা বলে বিরত করার চেষ্টা করলাম। মনি’কে সেই মুহূর্তে কিছুই বুঝতে দেইনি। সে’তো মা, হয়তো রি-এক্ট করে ফেলতে পারে। বাসায় ফেরার পথে তাকে ঘটনাটা বলেছি। পরদিন আমার বাবাকে ঘটনাটা বললাম। বাবা শুধু এটাই বললেন, “ওটাও তো একটা বাচ্চাই ছিল। সো, যাস্ট ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ”। গত দু’দিন ধরে মাথায় শুধু এটাই ঘুরছে ওই বাচ্চাটা অমন করল কেন? কিছু বাচ্চা এমনটা করেই বা কেন?
৪। অনেকদিন আগের কথা। প্রায় ২০ বছরের পুরোনো স্মৃতি। তখন যমুনা নদীর উপরে ব্রীজ হয়নি। নর্থবেংগলের সাথে ঢাকার যোগাযগের মাঝপথে ছিল ৩/৪ ঘন্টার ফেরী-জার্নি। বিশাল আকৃতির একেকটা ফেরীতে ৮টা থেকে ১২টা বড়-বড় বাস-ট্রাক নদী পার হত। আমি খুব সম্ভবতঃ রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসছিলাম। আমি একাই ছিলাম। বাসে বাম দিকে বসেছিলাম। উইন্ডো-সীট আমার পছন্দ না, করিডোরে বসেছিলাম। আমার ডান পাশের সামনে-পিছনে মিলে দুটো ডাবল-সীটে একটা ফ্যামিলি ছিল। যতদূর মনে পড়ে, মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক, তার স্ত্রী এবং তিন কন্যা। ছোট মেয়েটার বয়স চার/পাঁচ হবে হয়তোবা। যাত্রাপথে কোথাও (ফেরীতেও হতে পারে, ঠিক মনে পড়ছে না) গাড়ি থেমে আছে, সেই ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামছিলেন, আর তার ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা মায়েটা “এই আব্বু, এই আব্বু” বলে তার বাবার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভদ্রলোক খেয়াল করেননি যে মেয়ে তাকে ডাকছে। এদিকে মেয়েও অধৈর্য্য হয়ে গেছে। হঠাত মেয়ে তার বাবাকে জোরে ডেকে উঠল, “ওই কুত্তার বাচ্চা”। আমি শুধু হতবাক না, রীতিমত স্তম্ভিত। পুরো পরিবারটি বাসের সবার সামনে বেশ লজ্জায় পড়ে গেছে। বড় মেয়েদুটো তো প্রায় ছোটটার মুখ চেপে ধরে, এমন অবস্থা। সেদিনের সেই ঘটনা আজও আমার মনে প্রায়ই খোঁচা দেয়। কেন এমন হয়? বাচ্চারা এটা কেন করে? এই বাচ্চাটা এরকেমের এক্সপ্রেশন দেবে কেন? এখনও ভাবছি, সত্যিই ভাবছি, এই লেখাটা লিখছি আর ভাবছি।
আপাততঃ স্মৃতির পাতা বন্ধ, এবারে বিষয়টাকে কিছুটা টুইস্ট করি। দুটো কথা মনে পড়ছে, কার মুখে প্রথম শুনেছি, কিংবা এগুলো কার বা কাদের বাণী, তা মনে পড়ছে নাঃ ১) “নো-বডি ইজ আ বর্ন ক্রিমিনাল” এবং ২) “হিস্ট্রি রিপিটস”। – এই লেখার প্রথম দিকে এধরনের বিষয়গুলোতে আমি আমার নিজের দাঁড় করানো কিছু ব্যাখ্যার কথা বলেছিলাম, এবারে সেদিকে পাল তুলছি –
শিশুরা আবুঝ, আমরা সবাই তা জানি। তারা পারিপার্শিকতা থেকে শেখে, তাও আমরা জানি। আমরা জেনেও হয়তো মাঝে-মাঝে ভুলে যাই যে শিশুরা অনুকরনপ্রিয়। এই শেখা এবং অনুকরনের মোহ এক পর্যায়ে শিশুর মনোস্তাত্বিক গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। – এগুলো সবই হল খুবই কমন কিছু কথা। এগুলো আমাদের অজানা কিছু নয়। কিন্তু এর পরও আমরা ভুল করি। বাবা-মা ভুল করেন, শিক্ষক ভুল করেন, বড়রা ভুল করেন, সমাজের একটা বড় অংশ প্রতিনিয়ত ভুল করেন। আর, এর মধ্য দিয়েই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। অর্থাৎ, বাচ্চারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়, কখনো বা আক্রমনাত্মক হয়, এই মিথ্যা এবং আক্রমনের স্বভাব তারা ছাড়তে পারে না, এগুলোর ধরন বদলায়, কিন্তু আচরন বদলায় না। একটা বাচ্চা যদি পরিবারে কোন নেগেটিভ এক্সপ্রেশনের সম্মুখীন না হয়, তাহলে তার দ্বারা শৈশবে নেগেটিভ আচরনের প্রকাশ ঘটার কথা না। তাহলে, হয় সে এটা দেখে শিখছে বা অনুকরন করছে, নয়তো তার সাথেই কখনও বা এটা ঘটছে যা তার কোমল মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। আমি নিজেও একজন বাবা, ছোট্ট মেয়েটাকে ছেড়ে সারাদিন কর্মক্ষেত্রে থাকতে আমার অনেক কষ্ট হয়। হয়তো প্রকাশ করি না, কিন্তু কষ্ট হয়। খুব টেনশনে থাকি আর সবসময় এটাই দোয়া করি যেন আমার সোনামনিটার এমন কোন অভিজ্ঞতা না হয় বা এমন কিছু না শেখে বা অনুকরন না করে।
এবারে, খুব সম্মান প্রদর্শন করেই একটা অতি অপ্রিয় বিষয় সামনে টেনে আনছি। ক্যাডেটদের অনেককেই আমি জুনিওরদের আতিমাত্রায় পানিশ করতে দেখেছি। বিশেষ কিছু সিনিয়র যেন রীতিমত ত্রাস। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তারই ত্রাস সৃষ্টি করার পারদর্শিতা বেশি, যার নিজের জীবনটাও ছিল একসময় কোন না কোন সিনিয়রের ত্রাসের শিকার। ক্যাডেট কলেজে পানিশমেন্ট ছিল এবং থাকবে, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এর ধরনই বুঝিয়ে দেয় পানিশমেন্টদাতা সিনিওরের এ্যাটিচিউডে কোন সমস্যা আছে কি না। আবার, শিক্ষকদের সারাজীবন আমি অনেক শ্রদ্ধা করে এসেছি, কিন্তু কিছু শিক্ষককে তাদের শাস্তি দেবার নমুনা কিংবা দোষ খুঁজে বের করার প্রবনতার কারনেই মনে রেখেছি। এটা কি আমার জীবনে কোন পজেটিভ ভূমিকা রাখলো?
এবারে নিজের পেশায় চলে আসি – আমরা যারা শিক্ষকতায় আছি, আমাদের প্রায় প্রেত্যেকেরই ছাত্রদের সাথে কিছু সুখের এবং একই সাথে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার স্মৃতি আছে বলেই আমার ধারনা। সুখেরগুলো যেমন অনেক আনন্দদায়ক, অপ্রীতিকরগুলো আমাকে ঠিক ততটাই ভাবিয়ে তোলে। একজন উগ্র মেজাজের ছাত্র নিশ্চয়ই জন্মসূত্রে উগ্রতা পায়নি। আমরা সবাই মিলে শৈশব থেকে তিল তিল করে তার এই উগ্র আচরন অর্জনে অবদান রাখছি। বাবা-মা, শিক্ষক, সমাজ, কেউই আমরা এর দায় এড়াতে পারিনা। ছাত্র কি? – দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠি যা কিনা আমাদের আগামীদিনের ইতিহাস। কিন্তু ছোটবেলা থেকে একের পর এক নেগেটিভ ঘটনার স্বাক্ষী কিংবা আঘাতের শিকার কোন শিশু-কিশোর-ছাত্রের কাছে আমরা আসলে প্রকৃত অর্থে কি পজিটিভ মনভাব আশা করতে পারি?
বাবা-মা যদি শিশুর সামনে নিজেদের সম্পর্কটাকে পজিটিভ ভাবে তুলে ধরেন, শিক্ষক যদি ছাত্রকে তার নিজের সততা দিয়ে সততা শেখান, সমাজ যদি ভালবাসা দিয়ে ভাল মানুষ তৈরিতে স্বচেষ্ট হয়, তাহলে কি আমার স্বুস্থ মানষিকতার একটি জাতির স্বপ্ন দেখাটা খুবই দোষের! আমি অনেকের মুখে প্রায়ই শুনি, “সিস্টেমটাই খারাপ” – আমার কাছে বিষয়টা বোধগম্য হয় না, কিসের সিস্টেম? কার সিস্টেম? কাদের জন্য এই সিস্টেম? যিনি এই সিস্টেমের দোহাই দিচ্ছেন, তিনি কি সিস্টেমের অংশ না? তাহলে?
আমি আগেই বলেছি, আমার এই লেখাটা কিছু এলোমেলো স্মৃতির তাড়নাপ্রসূত বিক্ষিপ্ত চিন্তা ছাড়া আর কিছুই না। মনে প্রতিনিয়ত অনেক চাপ পড়ছে। তাই ভেন্টিলেট করার চেষ্টা চালালাম। আমার বাচ্চাকে কেউ আজ লাথি মারছে। কালকে যে আপনার বাচ্চাটার পালা নয়, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমি আমার ছাত্রদের কাছে প্রায়ই একটা কথা কোট করি, “চ্যারিটি বিগিনস এট হোম” – এই কথাটা আমি আসলেই মনে-প্রানে বিশ্বাস করি। আপনারা কি এটা বিশ্বাস করেন?
:brick:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
:clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আপনার একজন হাফ সিস্টার আছে আর এইটা এতো সহজ করে প্রকাশ করলেন দেখে খুব ভালো লাগলো।
আমরা ইদানিং বেশি মাত্রায় আধুনিক হয়ে গেছি। ২য় বিয়ে তা সেটা যে প্রেক্ষাপটে ই হোক না কেনো আমরা তা সহজ করে দেখি না।
আমার দাদা-নানা উভয়ের একাধিক বিবাহ। এবং দুই দিক থেকেই আমি ছোট ঘরের। মা-বাবার দিকেই খুব কম মানুষকেই এইটা সহজ করে নিতে দেখছি। অধিকাংশ সময়ই তারা বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন। বলতেই চাইতেন না যে তাদের সৎ ভাই বোন আছেন। আপনাকে ::salute::
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
:thumbup:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬),
লেখাটা মনে হয় বেশ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়েছো। বেশ ভাল লাগল এই লেখায় তোমার আগ্রহ দেখে।
আমার মা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৯৯৬ সালে, আমি ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার মাত্র দু'বছর পরেই। আমি ছিলাম আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। পরের বছর, মানে ১৯৯৭ সালে, বাবাকে আমিই আবার বিয়ে করিয়েছি। এবং তার এক বছর পরে আমার এই ছোট বোনটির জন্ম। এ'পর্যন্ত আমার বর্তমান মা আমাকে একদিনের জন্যও বুঝতে দেননি যে তিনি আমার বায়োলোজিকাল মাদার নন। আমিও তাকে নিজের মায়ের চেয়ে আলাদা করে ভাবতে চাই না। প্রেত্যকের অবস্থান আমার কাছে আলাদা। কিন্তু, কি দরকার শুধু শুধু দূরত্ব বাড়িয়ে। সবাই মিলে একে অন্যের প্রতি ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকার নামই তো জীবন। অন্ততঃ আমার কাছে জীবনের মানে এটাই।
আমার এ্যাসোসিয়েশনের প্রায় সবাই, মানে বন্ধুমহলে, শিক্ষক্হলে, আমার ছাত্রমহলে, আমার কলিগ সার্কেলে, এমনকি রকা'র অনেক সিনিওর-জুনিওরও আমাদের পরিবারের এই ব্যাপারটা জানেন। আমি কখনো এটা লুকোনোর প্রয়োজন মনে করিনি।
আসলে আমার কাছে মনে হয়, জীবনটাকে আমরা কিভাবে সাজাতে চাই, স্রষ্টার ইচ্ছার বাইরে এর বাকি সবটুকুই নির্ভর করছে আমাদের এ্যাটিচিউডের উপরে। তাই নয় কি? (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
লেখাটা বেশ ভাল লেগেছে আহমদ ভাই। যদিও নিজে এখনো বাবা হইনি তারপরো আশেপাশে দেখে মনে হয় আমাদের সন্তান লালন পালন ব্যবস্থায় বিশাল একটা ফাক রয়ে যাচ্ছে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানদের মানষিক আর চারিত্রিক গুনাবলি তৈরী তেমন কোন প্রাধান্যই পায় না। সবাই কেমন জানি টার্গেট অরিয়েন্টেড, মূল টার্গেট পরীক্ষায় ভাল মার্কস আর তার সাথে বেশি হলে কিছু এক্সট্রা কারিকুলাম যার বেশিরভাগটাই আবার স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য। আশেপাশের বাচ্চাদের দেখলে মাঝে মাঝে বেশ হতাশ লাগে। দুঃখবোধ ও হয় ওদের জন্য।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আহসান আকাশ (৯৬-০২),
তোমার পুরো মন্তব্যটাই কোট করে ফেললাম। খুবই সত্যি কথা লিখেছো। টার্গেট ওরিয়েন্টেড লেখাপড়া আর স্ট্যাটাস বজায় রাখার কোকারিকুলার কাজের চাপের ঠ্যালায় জর্জরিত বাচ্চা আমি নিজেই অনেকগুলো দেখেছি, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আবার আমার অতি ঘনিষ্ঠ আত্মিয়। ওই বাচ্চাদের জন্য আমার মায়াই হয়। আর তাদের বাবা-মায়েদের জন্য আমার অনেক করুনা হয়। (সম্পাদিত)
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
তোমার আগের লেখা আর মন্তব্য থেকে বুঝতে পেরেছিলাম তুমি মানুষটা একটু অন্যরকম - বেশ গভীরভাবে চিন্তা কর।
আমাদের সন্তানরা আমাদের দর্পণ। তারপরও কিছু বিষয়ে জেনেটিকস কী এড়িয়ে যাওয়া যায়? শিশু বিষয়ক পর্যবেক্ষণগুলো মূল্যবান।
এবার ঢাকা আমার খুব ভালো লাগলো। যতকিছুই থাক তারপরও চারদিকে প্রাণের বন্যা। আর সিস্টেমের কথা বললে এক্ষেত্রে আমার একটা পর্যবেক্ষণের কথা বলি। আমরা ক'জন গাড়ি করে যাচ্ছি খোসা খুলে বাদাম খেতে খেতে। যারা দেশে থাকে তাদের দেখলাম খুব সহজে বাদামের খোসা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। আর যারা বাইরে থাকে তারা খোসাগুলো জমিয়ে রাখছে। বিষয়টি উল্লেখ করার পর সবাই জানালা দিয়ে খোসা ফেলা বন্ধ করলো। সিস্টেম আমাদের স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করে। তবে তা বদলাতে সময় লাগে না।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
শান্তাপু,
এই প্রথম আমার লেখায় কেউ এইভাবে মন্তব্য করলেন। খুব ভাল লাগছে, আবার বেশ লজ্জাও পাচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রেই আমার চিন্তা-ভাবনা ভুল থাকতে পারে। আমি শুধু সেটাই লিখেছি, যেটা আমাকে ভাবিয়েছে।
তবে, রাস্তায় বাদামের খোসা ফেলার দলে আমি যে নেই, তা কিন্তু বলতে পারছি না। আমাকে দেখে আমার সন্তান শিখবে। প্রতিফলন তার মধ্যেও দেখা যাবে। আমি জেনেটিকস-কে কখনোই অস্বীকার করি না। এটাও একটা অনেক বড় ভূমিকা রাখে। আর, সিস্টেমের দ্বারা যে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়, তার নমুনা কিন্তু আমরা ক্যাডেটরাই। আমার দেখা অধিকাংশ প্রাক্তন ক্যাডেট এখনো নিয়ম মানতে, লাইনে দাঁড়াতে পছন্দ করে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, ব্যাতিক্রম আছে। যেমন সুযোগ পেলে আমরাও নিয়ম ভাঙ্গি। এখানে শক্ত হাতে নিয়ম মানার জন্য বড়দেরকেই বাধ্য করা প্রয়োজন, তাহলে আমার মনে হয় শিশুরা আপনা-আপনিই নিয়ম মানার দলে চলে আসবে।
তবে, আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, সেদিন আপনার সহযাত্রীরা, যারা বিষয়টা ধরিয়ে দেবার সাথে-সাথে বাইরে বাদামের খোসা ফেলা বন্ধ করেছিলেন, আর এই কাজটি করবেন না। আমার মনে হয় বিষয়টা তাদের মনে দাগ কেটেছে বলেই তারাও আপনার দলে যোগ দিয়েছেন।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
::salute:: ::salute:: আহমদ
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
থাঙ্ক্যু ভাইয়া। 🙂
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
চমৎকার লেখা!
তোমার ভাবনার সাথে শতভাগ সহমত।
যখন কেউ বলে "কি জমানা এসেছে !!" আমার তখনই বলে উঠতে ইচ্ছে করে,
"এই জমানাকে আমরাই এনেছি !"
তোমাকে ধন্যবাদ !
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
আপু,
জামানাকে আমি দোষ দেই না। পরিবর্তনের সাথে-সাথে সংখ্যা বা পরিমানের বিচারে না গিয়ে আমরা যদি এর মাত্রা বা হারের দিকে তাকাই, হয়তো দেখা যাবে আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। ... ... ... লেখাটা পড়েছেন, অনেক ভাল লাগল।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম