ক্যাডেট কলেজ, মিলিটারী একাডেমি আর নেভাল একাডেমি র কারনে কখনো থিতু হয়ে কোথাও কোন মুভি দেখতে পারিনাই। এসব জায়গায় ব্যক্তিগত পছন্দে কোন মুভি দেখার সুযোগ নেই.. সেন্ট্রালি চয়েজ করে সবাইকে মুভি দেখানো হয়.. কলেজে থাকার সময় আর ১০ টা মানুষের মতন হলিউডি একশন মুভি আর হিন্দি সিনেমা দেখেই বিস্তর মজা পেতাম। আর কোন অপশন ছিল না। আর সামরিক একাডেমি গুলো তে ঘুম বঞ্চিত আমাদের ঘুমের সুবর্ণ সুযোগ ছিল মুভি দেখানোর সময় টুকু। এ নিয়ে তেমন কোনো স্মৃতি নেই। বলতে গেলে সব মুভি শো তেই ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। খালি মনে আছে বিএমএ তে একবার অডিটরিয়ামে সেন্ট্রালি “ধুম ২”দেখাচ্ছিল। মুখ দিয়ে খালি একটা কথাই বের হয়েছিল,”সিরিয়ালসি?’ এরপর ই ঘুম দিয়েছিলাম।
মূলত নিজের মতন করে মুভি দেখার সুযোগ পেয়েছি ২০১২ তে এখানে আসার পর থেকে। যেকোন মুভি দেখার ক্ষেত্রে আমি প্রথমে যে জিনিসটা আগে খেয়াল করি সেটা হলো মুভির ডিরেক্টর কে। গত কয়েক বছরে এমন কিছু ডিরেক্টর এর কাজের সাথে পরিচয় হয়েছে যাদের কোন কাজ আগে কখনো দেখা হয় নাই। হুট করে দেখা আর ধুপ করে ভক্ত হয়ে যাওয়ার মতন। এমন ই একজন হলেন ওয়েস এন্ডারসন। বেশ কয়েকদিন ধরেই ওয়েস কে নিয়ে লেখার চিন্তা ভাবনা করছিলাম। গতকাল কে ওয়েস এন্ডারসন এর লেটেস্ট মুভি “দি গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল” দেখার পর সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম যে কিছু একটা লিখতে হবে। ওয়েস এন্ডারসন এর নাম প্রথম শুনি সিনেমাখোর নামক একটা ফেসবুক গ্রুপে। আমি হালকা জাতীয় কিছু মুভি দেখতে চাচ্ছিলাম। তখন একজন “মুনরাইজ কিংডম” নামের একটা মুভি দেখার জন্য পরামর্শ দেন। ডাউনলোড করেই দেখা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মাঝে বুঝতে পারলাম এটা আর ১০ টা মুভির মতন না। মুভির গল্প বলার স্টাইল, ডায়লগ , ন্যারেশন সবকিছুই অন্যরকম। অন্য কোন কিছুর সাথেই মেলাতে পারছিলাম না। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা নিয়ে মুভিটা শেষ করি। এরপর ই গুগল করা শুরু করি এই মুভি নিয়ে। কে এই ডিরেক্টর , আর কি কি মুভি বানিয়েছেন উনি। ওয়েস এন্ডারসন এর জন্ম হীউস্টন , টেক্সাসে। ১৯৬৯ সালে। বয়সে বেশ তরুণ। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস(অস্টিন ) এ পড়ার সময় ই ওয়েন উইলসন এর সাথে তার পরিচয় হয়। তখন থেকেই তাদের মুভি নিয়ে যত প্ল্যান। ১৯৯৬ সালে ওয়েস এর ডিরেকশন প্রথম মুভি রিলিজ হয়। মুভির নাম “বটল রকেট”। চিত্রনাট্য ওয়েন ও ওয়েস দুইজনে মিলে লেখা। তিন বন্ধুর এক চুরি নিয়ে করা প্ল্যান নিয়ে মুভির কাহিনী। এ মুভিকে মার্টিন স্করসিসি ৯০ দশকের অন্যতম সেরা মুভি হিসেবে আলাদা ভাবে প্রশংসা করেছেন। এরপর ১৯৯৮ সালে আসে “Rushmore” .. ওয়েস এর অন্যতম সেরা একটা কাজ। মাস্টারপিস কমেডি। এই মুভি দিয়েই মূলত ওয়েস তার নিজস্ব স্টাইল টা কে হলিউডে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। ২০০১ সালের “The Royal Tenebaumas” এর মাধ্যমে যা আরো জোড়দার হয়। এরপরে একে একে বের হয় ” The Life Aquatic” , “The Darjeeling limited” , “Fantastic Mr. Fox” , “Moonrise Kingdom” এবং এই বছরের ” The Grand Budapest Hotel” . প্রতেকটা মুভিই আমার পার্সোনাল ফেভারিট। কয়েকবার করে দেখেছি। কি জানি একটা লুকিয়ে আছে মুভি গুলোতে। হালকা চালে খুব সিম্পল কাহিনী গুলো বলা, চমত্কার ভিজুয়াল ল্যান্ডস্কেপ, উইটি ডায়লগ মুভি গুলোকে দিয়েছে আলাদা একটা মাত্রা। অন্য কোন মুভি বা কোন স্টাইলের সাথে কোন মিল নেই। বানিজ্যিক একঘেয়েমি মুভিতে ভরা হলিউডে ওয়েস এন্ডারসন এর এই স্টাইল অনেকটা ফ্রেশ এয়ার এর মতন।ওয়েস , সত্যজিত রায় কে তার নানা কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে মানেন। দার্জিলিং লিমিটেড মুভিটা পুরোটা শুট করা হয়েছে ইন্ডিয়াতে। এই মুভিটাকে অনেকটা সত্যজিত রায় এর প্রতি শ্রধাঞ্জলি হিসেবেই বিবেচনা করেন ওয়েস এন্ডারসন।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে ওয়েস এর ফিল্ম মেকিং এ কি স্টাইল আছে যা দৃশ্য গুলো কে এত আকর্ষনীয় করে তোলে? চলচ্চিত্রের পর্দায় সিমেট্রি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস। ওয়েস এন্ডারসন তার মুভি গুলো এই সিমেট্রি র ব্যবহার করেছেন মনে হয় সবচেয়ে সুচারু ভাবে। অন্য ডিরেক্টর রা যেখানে দৃশ্যের সেন্টারপিস বা কেন্দ্রীয় চরিত্র কে ফ্রেম এর এক কোনায়, বামে বা ডানে রেখেছে সেখানে ওয়েস তার মুভির অধিকাংশ দৃশ্যে ফোকাস ঠিক রেখে মূল চরিত্র বা বস্তুকে রেখেছেন একদম পর্দার মাঝখানে। আয়তকার টিভি পর্দার একদম মাঝের বিন্দু টা কে যদি খুঁজে বের করা যায় তাহলে সেটা পর্দার সেই চরিত্র বা বস্তু র মাঝ বিন্দুর সাথে মিলে যাবে একদম। আমাদের অবচেতন মনে এই সিমেট্রি এক ধরনের অদ্ভুত ভালো লাগা সৃষ্টি করে। নিচের তিনটা ছবি দেখলে এই সিমেট্রির ব্যাপারটা মনে হয় আরো ভালো করে বুঝতে পারবেন। আর একটা কথা বলতে হয় , এই সিমেট্রির ব্যাপারটা স্ট্যানলি কুবরিক এর মুভিতেও স্পষ্ট ছিল.. ওয়েস মনে হয় কুবরিক থেকেই এই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
ওয়েস এন্ডারসন এর মুভির আরেকটা সিগনেচার হলো ট্র্যাকিং ক্যামেরা। চলমান বা স্থির পাত্র-পাত্রীর উপর আসলে নির্ভর করে যে ক্যামেরা স্থির থাকবে নাকি একটা চলমান প্লাটফর্ম এর উপর ক্যামেরা ও মুভ করতে থাকবে। এই টেকনিক টা মুভিতে বেশ ভালো একটা মোমেন্টাম এনে দেয়। পর্দায় প্যাটার্ন আর রং এর মিশ্রণ তিনি করে থাকেন খুব টেকনিক্যালি। এ কারনেই তার মুভির ক্যারেকটার দের আমরা রং বেরং এর পোশাক পরে সাধারণত অভিনয় করতে দেখি। মিউজিক, লাইটিং আর সিনেমাটোগ্রাফি ও একদম অন্যরকম। মন ভালো করা একটা অনুভূতির ছাপ সব জায়গাতে।
এন্ডারসন এর আরেকটা টেকনিক হলো ফার্স্ট পারসন ওভারহেড শট। তার প্রায় সব মুভিতেই প্রচুর ব্যবহার করা হয়েছে এই টেকনিক টা। এক্ষেত্রে ক্যামেরা টা মূলত স্থাপন করা উপর থেকে। কোন দৃশ্য দেখার সময় দর্শক মনে করবে যে সে আসলে ফার্স্ট পারসন পয়েন্ট অফ ভিউ থেকেই সেই দৃশ্য টা দেখছে। খুব সহজেই এতে চরিত্র গুলো সাথে মিশে যাওয়া যায়। এই ছবিটা খেয়াল করে দেখুন। ক্যামেরা টা এমন ভাবে প্লেস করা হয়েছে যাতে দর্শকরা সব কিছুতে একটা ফার্স্ট পার্সন দৃষ্টিভঙ্গি পান। ব্যক্তিগত দৃশ্য গুলো এই পদ্ধতির মাধ্যমে আরো ব্যক্তিগত হয়ে উঠে।
টাইম পিরিয়ড আর নস্টালজিয়া তার মুভিতে প্রাধান্য পেয়েছে নানা ভাবে। প্রায় প্রত্যেকটা মুভিতেই তিনি পরিবার কে গুরুত্ব দিয়েছেন। আপনি যদি ওয়েস এর পরিচালিত মুভি গুলো দেখা শুরু করেন তাহলে একটা তাহলে একটা কমন থ্রেড খুঁজে পাবেন ধীরে ধীরে। এইটাই হলো এই মুভি গুলো দেখার সবচেয়ে আসল মজা। এই সিগনেচার মুভি বানানোর স্টাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে ওয়েস এই স্টাইল কে হাতের লেখার সাথে তুলনা করেন। কয়েকজন মানুষকে একটা লাইন ১০ বার লিখতে বলা হলে সবাই একই জিনিস লিখবে। তবুও খালি চোখে দেখতে সেগুলো আলাদা আলাদা লাগবে , কারন সবার হাতের লেখাই ভিন্ন। ওয়েস এর মতে তার ফিল্ম মেকিং স্টাইল একান্তই তার। এটিকে আর কারো সাথে মেলানো যাবেনা।
হুট করে এই মুভি গুলো দেখলে অনেকের কাছেই কিছুটা স্লো বা অদ্ভুত লাগতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন , মনোযোগ দিয়ে পুরো মুভিটা দেখেই আপনি স্টাইল টা ধরে ফেলতে পারবেন। এরপর বাকি গুলো দেখে আরো মজা পাবেন। ওয়েস এন্ডারসন ২ টা শর্ট ফিল্ম ও বানিয়েছেন। প্রথমটার নাম “Hotel Chevalier” ১৩ মিনিটের এই মুভিতে অভিনয় করেছেন জ্যাসন শোয়ার্টজম্যান ও নাটালি পোর্টম্যান। ইউটিউবে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন এখানে। আরেকটা হলো ৭ মিনিটের “Castello Cavalcanti” এইটার ও ইউটিউব লিংক এখানে। এই দুটো শর্ট ফিল্ম দেখে ওয়েস এন্ডারসন এর স্টাইল সম্পর্কে একটা আইডিয়া পেতে পারেন। এরপর না হয় ধীরে ধীরে শুরু করলেন।
হ্যাপি মুভি ওয়াচিং এভরিওয়ান 🙂
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া
ভাল ছিলো :thumbup:
ধন্যবাদ খালেক। :hatsoff: এই লোক এর সিনেমা দেখছিস ? কেমন লাগছে?
শেষ দেখসিলাম মুনরাইজ কিংডম। কিছু একটা আছে এর কাজে। তুই যে ভিমিও ক্লিপ থেকে রেফারেন্স নিসিস ঐটা বেশ কিছুদিন আগে গিজমোডো'র মাধ্যমে দেখসিলাম তখন পুরা মাইন্ড ব্লোন খাইসিলাম!
প্ল্যান আছে এইটাও দেখবো - রেকমেন্ডেড বাই আওয়ার প্রফেসর, ঠু! 😀
বসের মুনরাইজ কিংডম দেখছি। দেখা মাত্রই প্রিয় ছবির তালিকায় চলে গেছে।
অন্য কোনটা দেখা হয় নাই। তবে তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে দেখতে হবে।
আরেকটা কথা, আমরা তো খালি মুভি দেখিই; এত কিছু বুঝি না। তুই ক্যামনে পারিস??
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
😛 লজ্জা দিবেন না বাপু ! এখনো তেমন কিছু বুঝিনা। আরো মেলা দূরের পথ বাকি।
মুভি দেখে জানাইস কেমন লাগলো।
চমৎকার লেখা, নাফিস। তোমার লেখা পড়ে মুহাম্মদের সিনেমা নিয়ে লেখাগুলার কথা মনে পড়লো। এই ডিরেক্টরের কোন মুভি দেখা হয়নাই। এমনিতেই এখন তেমন একটা দেখা হয়না। সময় করে একটা দুইটা ট্রাই করবো দেখি।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
সময় করে ১টা / ২টা মুভি দেইখেন।
আর মুহম্মদ ভাই এর লেখা গুলো পড়েই সিরিয়াস অনেক মুভি দেখার অনুপ্রেরনা পাইছিলাম। উনারে আবার কিছু লিখতে বলেন একটু সময় নিয়ে।
দার্জিলিং লিমিটেড খুব ভাল লেগেছিলো। তবে সত্যজিতের প্রসংগটা জানা ছিলোনা। এই পরিচালকের আর কোন ছবি দেখা হয়নি।
ইদানিং ছবি দেখা একটু কমিয়ে উপন্যাস-পাঠে ফিরে যাবার ব্রত নিয়েছি।
তবু সময় করে একবার দেখে নিবো এঁর একটা কি দু'টা কাজ।
Rushmore, The Royal Tenebaums আর লেটেস্ট The Grand Budapest Hotel এই তিনটা দেইখেন সময় পেলে।
আবার দেখা হলো কয়েকটা মুভি !
আমি মুভিবিমুখ, তবুও লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ খায়রুল ভাই। অনুপ্রাণিত হলাম। 🙂