একজন রহমান সাহেব ও অন্যান্য……

ভোরবেলা বাইরে থেকে হেঁটে এসেই খবরের কাগজ পড়াটা রহমান সাহেবের নিত্যদিনের অভ্যাস। কিন্তু আজ তার মেজাজটা খুবি খারাপ। হকার আজ পত্রিকা দিয়ে যায়নি। সেই সকাল থেকেই রাগে গজ গজ করছেন, যাকে সামনে পাচ্ছেন তাকেই তুলোধুনো করছেন। আর তার এই কাণ্ডকারখানায় সবচেয়ে আনন্দ পাচ্ছে যে ব্যক্তি, সে তার একমাত্র নাতি ৪ বছরের নিবিড়। WWF এর মতো এক এক জন প্রতিপক্ষকে রহমান সাহেব ঘায়েল করছেন আর একনিষ্ঠ সমর্থকের মতো হাততালির বৃষ্টি ঝরাচ্ছে ছোট্ট নিবিড়। কিন্তু এবার রিং এর প্রতিপক্ষকে দেখে রহমান সাহেবের তেজদীপ্ত ভাব হঠাৎ কোথায় যেন উবে গেলো। তার একমাত্র পুত্রবধূ যাহ্‌রা চায়ের কাপ হাতে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে স্বয়ং মঞ্চে হাজির। পরিবারের এই সদস্যটির প্রতি কেন যেন রহমান সাহেব অতিমাত্রায় দুর্বল। হয়তো যাহ্‌রার চেহারা তাকে তার ক্যান্সারে মারা যাওয়া ছোটো মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয় বলে।

” বাবা, আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছি, আর এই যে পেপার। রাজুকে দিয়ে দোকান থেকে এইমাত্র কিনিয়ে আনলাম।”
” আগে পেপারটা দাও।” – রহমান সাহেবের লজ্জিত হাসি।
” বাব, আপনার হার্ট এ সমস্যা, কথায় কথায় এ বয়সে উত্তেজিত হলে…”
” বৌমা, তুমি তো জানোই যেসব বিষয়ে আমার বাতিক তার কোনোটায় ব্যাঘাত হলে মেজাজ কেমন গরম হয়ে যায়…”

এদিকে ধুন্ধুমার রেসলিং এর এই আচমকা সমাপ্তিতে যারপরনাই বিরক্ত নিবিড় ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার নিজের খেলনা নিয়ে।

” বাবা, আজ দুপুরে কোথাও যাবেন না, বাসায় থাকবেন। আমি অফিস থেকে এসেই আপনাদের নিয়ে বের হবো। সবাই মিলে আজ বাইরে খাবো।”- বলতে বলতে তার পুত্র হাসানের প্রবেশ।
” কিন্তু বাবা, তোর মা’র শরীরটা বেশি ভালো না।”
” বাবা, মা’কে নিয়ে চিন্তা করবেন না। মা যথেষ্টই ভালো আছেন। আজ আপনাদের ৪০ তম বিবাহবার্ষিকী, সেটা আপনি ভুলে গেলেও মা কিন্তু ভোলেননি। তিনি কিন্তু ভয়ানক রেগে আছেন।”

রহমান সাহেব হতাশ হয়ে বসে পড়লেন। আসলেই শেফালী আজ তার বারোটা বাজাবে। ৪০ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে এই তারিখটার কথা খুব কমই তার স্মরণে ছিল।

প্রায় ৬ বছর হতে চলল, রহমান সাহেব রিটায়ার করেছেন। জীবনের সবচেয়ে সুখময় মুহূর্তগুলো আন্দোলিত হচ্ছে জীবনযাত্রার শেষ প্রান্তে এসে। একমাত্র পুত্র, আদরের পুত্রবধূ, প্রাণপ্রিয় একমাত্র নাতি আর তার সুখ-দুঃখের, হাসি-কান্নার গত ৪০ বছরের ভাগীদার তার প্রিয়তমা স্ত্রী শেফালী, একটি সুখী পরিবারের আদর্শ প্রতিচ্ছবি, যেখানে পরিবারের অধিকর্তা রহমান সাহেব নতুন করে জীবনকে রাঙাচ্ছেন।

# # #

গল্পটার সমাপ্তিও যদি এভাবেই হতো তাহলে বোধ করি পাঠককুল যারপরনাই তৃপ্তি পেতেন এবং সেই সাথে নিজেকে এরকম একটি সুখী পরিবারের সদস্য কল্পনা করে নিদ্রা যেতেন। কিন্তু…………

# # #

” কি চাচা, আর কতো ঘুমাইবেন? খাইবেন না?”

ব্যকুল নয়নে প্রশ্নকারী সিরাজের দিকে চেয়ে আছেন রহমান সাহেব। চারপাশে চোখ বুলালেন একবার। ওইতো জহির সাহেব চা :teacup: খাচ্ছেন বসে বসে। বারান্দায় নিরঞ্জন বাবুকে দেখা যাচ্ছে মোটা ফ্রেম এর চশমা লাগিয়ে :-B একমনে পত্রিকা পড়তে। বৃদ্ধাশ্রমের এই বদ্ধ ঘরে এতক্ষন রহমান সাহেব যে সুখ স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, তা ছিল নিছকই তার কল্পিত ভালোলাগার কুজ্ঝটিকা। আর আশ্রমের ঝাড়ুদার সিরাজ আকাঙ্ক্ষার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া এবং বিনিময়ে না পাওয়া সেই কল্পিত ভালোলাগার সুখস্বপ্নের নির্দয় হন্তারক…………।। :gulli:

৮৫২ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “একজন রহমান সাহেব ও অন্যান্য……”

  1. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

    যেসব পলাপাইন তাদের প্রতি বাবা মায়ের অবদান এর কথা ভুলে গিয়ে বাবা মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারে এদের জায়গা জাহান্নামেও হবে না....................... :gulli:


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।