হজ্জ করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি পরিসংখ্যান নিলে এমন হাজীদের সংখ্যা নেহাত কম হবে না। আমার পরিচিত যারা হজ্জ করতে গিয়েছেন, ফিরে এসে তাদের প্রায় সবাইকেই কিভাবে তারা হারিয়ে গেলেন এবং কেমন করে তারা সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেলেন তার বর্ণনাই করতে শুনেছি বেশ আগ্রহভরে। আমি যখন গত বছর হজ্জে যাই তখন কিন্তু ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি যে আমারও সেই একই দশা হবে এবং ফিরে এসে সেই হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী লিখতে বসব সবিস্তারে।
আমার দাদা হজ্জ করেছিলেন আমার জন্মেরও আগে অর্থাৎ আজ থেকে নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন বৎসর আগে। আম্মার মুখে শোনা গল্প থেকে জানি যে তিনি চিটাগং থেকে জাহাজে করে হজ্জে গিয়েছিলেন। আব্বার পোস্টিংও ছিল তখন চিটাগং-এ। দাদা হজ্জ করে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরে এসেছিলেন। সেই সময় এখনকার মতন এত লোক লোক হজ্জ করতে যেতেন না – ফলে হারিয়ে যাওয়ার আশংকাও হয়ত তেমন প্রকট ছিলো না। তবে হজ্জ পালন কখনই সহজসাধ্য ছিলো না। অতীতেও যেমন ছিলো না, বর্তমানেও না। যাতায়াত ব্যবস্থা ছিলো আগেকার দিনের হজ্জের জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা। আমাদের উপমহাদেশ থেকে অনেকেই পদব্রজে হজ্জ পালন করতেন যখন সমুদ্র কিংবা আকাশপথে মক্কায় যাওয়াটা সহজলভ্য ছিলো না। পদব্রজে সেই দীর্ঘ হজ্জ-যাত্রা বিপদ সংকুলও ছিলো বটে। মোঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি বৈরাম খাঁ-কে বিদ্রোহের শাস্তি স্বরূপ হজ্জে পাঠানো হয়, কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তার শত্রুর হাতে প্রাণ হারান। বিপদ সংকুল এই দীর্ঘ পথের কারণেই হয়ত মোঘল সম্রাটদের কারোরই পক্ষে হজ্জ পালন করা সম্ভব হয়নি। সমুদ্রপথে যোগাযোগ যখন শুরু হয় তখন আমাদের পূর্ব বাংলা থেকে অনেকেই জাহাজে করে হজ্জ পালন করা শুরু করলেন। তবে সেই যাত্রাও ছিলো ধকলপূর্ণ, অনেকেই সী-সিকনেসের শিকার হয়ে বোম্বতেই নেমে পড়তেন এবং একসময় ‘বোম্বাই হাজী’ হিসেবে দেশে ফিরে আসতেন।
কিন্তু এখন দৃশ্যপট ভিন্ন। আকাশপথেই মূলত হাজীদের সমাগম হয় মক্কা-মদীনায়। হজ্জ যাত্রা এখন অনেক সহজসাধ্য হয়েছে বটে কিন্তু যোগ হয়েছে অন্যান্য চ্যালেঞ্জ। হজ্জের উদ্দেশ্যে আগত মুসল্লিদের সংখ্যা হয়ত বর্তমান যুগের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এত লোকের থাকা-খাওয়া অর্থাৎ লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়, সে এক এলাহী কারবার। বিশ্ব জুড়ে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মক্কা-মদীনায় উঁচু উঁচু দালান-কোঠা ছাড়াও অত্যাধুনিক পাঁচ তারা খচিত হোটেলের আধিক্যের কারণে তিন থেকে চার মিলিয়ন লোকের সমাবেশ ঘটে হজ্জের সময়। এত মানুষের ভীড়ে মানুষজন এখন সামান্য ভুলের কারণে মুহূর্তের মধ্যেই হারিয়ে কিংবা দলছূট হয়ে যেতে পারে। আর সেই কথা মাথায় রেখেই হজ্জ কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক হাজীর জন্য একটা বারকোড লাগানো ট্যাগ সরবরাহ করে থাকে যার ভেতর সেই হাজীর সমস্ত তথ্য-উপাত্ত জমা থাকে। হারিয়ে গেলে যাতে এই ট্যাগ ধরেই নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিটিকে সনাক্ত করা যায় এবং তাকে তার নির্দিষ্ট অবস্থানে ফিরিয়ে দেয়া যায়।
হজ্জের সময় হারিয়ে যাওয়ার বহুবিধ প্রকারভেদ আছে। কোন কোন হারিয়ে যাওয়াটা হয় ক্ষণকালীন। আবার কোনটা হতে পারে দীর্ঘকালীন। আবার অনেকে হজ্জের মাঝেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান। তবে যে কোন হারিয়ে যাওয়াই বয়ে আনে যিনি হারিয়ে যান তার জন্য ভোগান্তি কিংবা তার নিকটজনের জন্য দুঃখ বেদনা। অনেক সময় কোন একজনের স্বল্পকালীন হারিয়ে যাওয়াটা তার দলের জন্য বয়ে আনতে পারে চরম ভোগান্তি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা অবশ্য দেখেছি। হজ্জের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে ‘যুল হুলাইফা’ নামক স্থানে আধা ঘণ্টার যাত্রা বিরতি দেয়া হয় ইহরাম বেঁধে উমরার নিয়ত করার জন্য। এখানে আমাদের দলের বয়স্ক একজন মহিলা হারিয়ে যান অল্প কিছু সময়ের জন্য। ফলে সেখান থেকে আমাদের বাস ছাড়তে দেরী হয়। এই দেরীর ডোমিনো অ্যাফেক্ট অবশ্য বহুদূর পর্যন্ত গড়ায়। কারণ দেরী করে মক্কাতে পৌঁছানোর জন্য বেশ কিছু বিড়ম্বনা পোহাতে হয় আমাদের। তাড়াহুড়ো করে মালপত্র কালেক্ট করে হোটেলের রুমে চেক-ইন করেই পড়িমরি করে ছুটতে হয় হোটেলের রেস্টুরেন্টে ডিনার সারতে। তখন রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয় হয় অবস্থা। ডিনারের পরপরই আমরা আমাদের গ্রুপ লিডারের সাথে তাওয়াফ করার জন্য তৈরি হয়ে নেই। কাবা শরীফের সাথে লাগোয়া ক্লক টাওয়ারে আমাদের হোটেল। ফলে কাবা শরীফ আমাদের জন্য মিনিট দু’য়েকের হাঁটা পথ। ক্লক টাওয়ার থেকে বেরিয়ে এসে খোলা চত্বরে নামার সাথে সাথে দৃষ্টির সামনে চলে আসে পবিত্র কাবা শরীফ। চর্মচক্ষুতে কাবা শরীফকে প্রথম দেখার অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সমগ্র দেহ এবং মন আচ্ছন্ন করা সেই অনুভূতি থেকে সম্বিত ফিরে পেতে কিছুটা সময় পেরিয়ে যায়। আর সেই সময়ের মাঝেই আমাদের দলের নেতাসহ দলের অধিকাংশ সদস্যকে আমি হারিয়ে ফেলি। অবশ্য আমার সঙ্গী জাকির ভাই এবং তার স্ত্রী উর্মি ভাবী সাথেই ছিলেন। আমরা তিনজন একত্রে তাওয়াফ এবং সা’য়ী শেষ করে ক্লক টাওয়ারে ফিরে যাই। তারপর লাইন ধরে চুল কেটে যখন উমরা সম্পন্ন করি তখন রাত গভীর।
জাকির ভাই আর উর্মী ভাবীর সাথে আমার পরিচয় মদীনাতে। হোটেলে আমাকে যে রুমের বরাদ্দ দেয়া হয় সেই রুমে মরিসিয়াসের সামাদ ভাই, পাকিস্থানের দানিশ ভাই আর বাংলাদেশের জাকির ভাইও বরাদ্দ পান। আমরা কেউই কারো পূর্ব পরিচিত নই, হোটেল কক্ষেই আমাদের প্রথম পরিচয়। আমরা সবাই অবশ্য ‘আল মাদীনা ট্রাভেলস’ নামক হজ্জ এজেন্সীর মাধ্যমে টরন্টো থেকে একই ফ্লাইটে এসেছি। আসার পথে ইস্তাম্বুলে আমাদের এক রাত যাত্রা বিরতি ছিল, তখন শুধু মুখচেনাই হয়েছে, তেমন কথাবার্তা হয়নি। মদীনাতে হোটেলের রুমমেট হওয়ার পর আমাদের ভিতর গভীর সখ্যতা গড়ে উঠে। আমি ছাড়া উনারা প্রত্যেকেই স্ত্রীদের সাথে নিয়ে এসেছেন। আমি ছাড়া উনারা সবাই আগে হজ্জ কিংবা উমরা করেছেন। আমার অসহায়ত্ব টের পেয়ে সেই প্রথম দিন থেকেই জাকির ভাই আর উর্মী ভাবী আমাকে উনাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী করে নিয়েছিলেন। উনাদের সেই বদান্যতা কখনোই ভুলার নয়। মীনাতে হারিয়ে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতার কথা আজ লিখতে বসেছি, জাকির ভাই আর উর্মী ভাবীও আমার সেই অভিজ্ঞতার পথসাথী।
হজ্জের নিয়ম অনুযায়ী আরাফাতের রাত মুসদালিফাতে কাটানোর পর মীনাতে ফিরে এসে যখন আমরা দলবদ্ধভাবে শয়তানকে পাথর মারতে জামারাতে যাই তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। বলে রাখা ভালো যে এই পাথর মারার পর্বটি বেশ কষ্টকর এবং বিপদজনকও বটে। কষ্টকর এইজন্য যে আপনাকে বেশ দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে হাজার হাজার হাজীদের সাথে। রোদের প্রকোপ থেকে বাঁচতে সবাই তখন মাথার উপর ছাতা মেলে ধরেন। কিন্তু তাতেও উষ্ণতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। তবে এই চলার পথের অনেকটাই এখন টানেল দ্বারা আবৃত, যেখানে বিশাল বিশাল ফ্যান ঘুরছে মাথার উপর। আর যেটুকু রাস্তা আপনাকে সরাসরি সূর্যের নীচ দিয়ে আসতে হবে, সেখানে আবার কিছুদূর পরে পরে সৌদী পুলিশেরা ঠাণ্ডা পানির স্প্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে। তারা বিরামহীন ভাবে হজ্জযাত্রীদের মাথায় আর মুখে সেই পানির স্প্রে ছিটিয়ে দিচ্ছে। তারপরও মীনা থেকে জামারা যাওয়ার পথ বেশ কষ্টসাধ্য। বিপদজনকের কারণ হচ্ছে ষ্টাম্পপিড। হাজার হাজার মানুষের এই পথচলায় যদি কোথাও একটু ছন্দপতন ঘটে, কেউ যদি কোথাও থেমে যায় কিংবা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়, তবে পিছনের মানুষেরা একে অপরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাতে ঘটে যেতে পারে অগনিত প্রাণহানী। সেইজন্য পানিওয়ালা সেই সৌদী পুলিশেরা পানি স্প্রে করার সাথে তাল মিলিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে ‘তারিক, তারিক’ -যার অর্থ হচ্ছে ‘মুভ অন’। আপনাকে অবশ্য এর অর্থ বুঝার জন্য আরবী শিখতে হবে না – তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ আর সার্বিক পরিস্থিতিই আপনাকে বলে দিবে যে এর মানে হচ্ছে ‘সামনে আগাও’।
আমরা যখন জামারা শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়াই তখন মধ্য দুপুর। ইতিমধ্যেই আমাদের কুরবানী যে হয়ে গেছে সেই খবর আমাদেরকে টেক্সট করে জানিয়ে দিয়েছে আমাদের এজেন্সী। এখন আমাদের যেতে হবে মক্কার কাবা শরীফে। সেখানে গিয়ে ইহরাম ছাড়ার জন্য আমাদেরকে হয় চুল কাটাতে হবে কিংবা তাওয়াফ এবং সা’য়ী করতে হবে। তবে চুল কাটা এবং তাওয়াফ-সা’য়ী দু’টোই করতে পারাটাই উত্তম। এই উত্তম কাজটি করতে না পারার খেসারতই আমাদেরকে দিতে হয়েছে পরের দিন মক্কা থেকে মদীনাতে ফিরে যাওয়ার সময় হারিয়ে গিয়ে। জামারা থেকে একটা লোকাল বাসে মক্কা অভিমুখে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু বাস আমাদেরকে হোটেল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নামিয়ে দিল। হজ্জের মওসুমে কাবা শরীফের আশেপাশের রাস্তাঘাট বন্ধ রাখা হয় সঙ্গত কারণেই। এই এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া ছিলো আমার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করার কারণে এবং নিয়মিত খেলাধূলার সাথে জড়িত থাকার কারণে আমার নিজের প্রতি একটা আস্থা ছিলো যে হজ্জের যে কোন শারীরিক কষ্টকে সামলে নিতে পারব। কিন্তু এই অবর্ণনীয় রোদ আর গরমের ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই ছিলো না। পথের মাঝে পরিচিত একজনের স্ত্রীকে হিট স্ট্রোকের কারণে নেতিয়ে পড়ে যেতে দেখলাম। যখন আমরা হোটেলে পৌঁছলাম তখন আমাদের অবস্থা রণক্লান্ত সৈনিকের মতন। তাই তাওয়াফের চিন্তা বাদ দিয়ে চুল কাটার জন্য সারি সারি নাপিতের দোকানের সামনে লাইন দিয়েই বুঝতে পারলাম এই লাইন আর শেষ হবার নয়। আর সুযোগ বুঝে দশ রিয়ালের চুল কাটার রেট এখন ঠেকেছে এক’শ রিয়ালে। তাই হোটেলের রুমে চলে আসলাম আমরা একে অপরের চুল কেটে দিব এই চিন্তা করে। পাকিস্থানী দানিশ ভাই আমার আর জাকির ভাইয়ের চুল কেটে দিয়েছিলেন। চুল কাটার পর লম্বা এক গোছল দিয়ে ইহরামের পোশাক ছেড়ে টি শার্ট আর জিন্স পরে নিলাম। আমার, জাকির ভাই আর উর্মি ভাবীর আর তাওয়াফ করা হলো না – কিছুটা শারীরিকভাবে নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার কারণে, আর কিছুটা মানুষের ভীড়ের কারণে। সন্ধ্যায় ডিনার সেরে আমাদের হজ্জ এজেন্সীর অ্যারেঞ্জ করা বাসে করে আমরা মীনায় ফিরে গেলাম।
পরদিন সকাল সকাল আমরা মীনা থেকে জামারাতে গেলাম। সেখান থেকে সবাই যখন মীনাতে ফিরে যাচ্ছে, আমরা তিনজন হাঁটা ধরলাম মক্কার পথে – তাওয়াফ করা বাকী আছে যে আমাদের। টানেল ধরে প্রায় সাত-আট কিলোমিটার হেঁটে আমরা কবুতর চত্বর দিয়ে কাবা শরীফে পৌঁছলাম। ভীড় অনেক কম থাকার কারণে বেশ আরামেই আমরা আমাদের তাওয়াফ সেরে ফেললাম। তারপর হোটেলের রুমে কিছু সময় কাটিয়ে সন্ধ্যায় ডিনার সেরে মীনাতে কিভাবে ফেরত যাওয়া যায় তার খোঁজ করা শুরু করলাম। আজ আমাদের নিজ ব্যবস্থাতেই যেতে হবে, হজ্জ এজেন্সীর কেউ নেই এখানে। প্রথমেই হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। আমাদের ভাগ্য ভালো যে সেখানে এক বাংলাদেশী ভাই ডিউটিতে ছিলেন। তিনি আমাদের জানালেন যে, ট্যাক্সি কল দিয়ে লাভ হবে না বরং হোটেল থেকে সামান্য দূরেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে, সেখান থেকে দরদাম করে ট্যাক্সি নেয়াটাই একমাত্র উপায়। তিনি আমাদের শুধু একটা ব্যাপারেই সতর্ক করে দিলেন যে আমরা যেন ভুলেও সৌদি কোন লোকের ট্যাক্সিতে না উঠি। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কোলাহল আর হুড়াহুড়ি দেখে আমার কাছে মনে হলো আমি যেন ঢাকার ফার্মগেটের ওভারব্রীজের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা তাড়াহুড়া করে তিনটা সীট খালি আছে এমন একটা মাইক্রোবাসে উঠলাম। উঠার সময় এক নজর দেখে নিলাম ড্রাইভারকে, বাবরি কালো চুল দেখে মনে হলো আমাদের উপমহাদেশের লোক হবে। উঠার পরে আমাদের ভুল ভাঙলো। তার আরবী ভাষা আর কর্কশ ব্যবহারে বুঝতে পারলাম সে আসলে সৌদি। জনপ্রতি ভাড়া ঠিক হলো পঞ্চাশ রিয়াল – যেখানে সাধারণ সময়ে ভাড়া ‘খামছা’ অর্থাৎ পাঁচ রিয়াল সেখানে সে নিচ্ছে ‘খামছিন’ অর্থাৎ পঞ্চাশ রিয়াল। আরবী ছাড়া আর কোন ভাষাজ্ঞান মক্কার সৌদি লোকদের আছে বলে আমার সন্দেহ আর এই বদমেজাজী ড্রাইভারের তো আরও নেই। তাই এই ‘খামছা’ আর ‘খামছিন’ নিয়ে তার সাথে কোন ‘খামচা-খামচি’ না করে আমরা রাজী হয়ে গেলাম। আমরা ছাড়াও গাড়ীতে আরও তিনজন ভারতীয় হাজী। মক্কা থেকে মীনার দূরত্ব সাত-আট কিলোমিটার। গাড়ী দুই কিলোমিটার না যেতেই রাস্তা বন্ধ। ড্রাইভার আমাদেরকে নামিয়ে হাতের ইশারায় বলল – ঐ যে মুনা। সৌদিদের কাছে মীনার উচ্চারণ মুনা। যাই হোক আমাদেরকে মাঝ রাস্তায় গাড়ী থেকে নেমে যেতে হলো। এখন আমরা মোটামুটি দিশেহারা, কীভাবে মীনাতে আমাদের তাঁবুতে পৌঁছাব। আমাদের কাছে ঠিকানা যদিও লেখা আছে, কিন্তু কাকে সেই ঠিকানা দেখাব। সৌদি পুলিশ যারা রাস্তায় আছে তাদের কাছে যাওয়াটা এক মহা বিড়ম্বনা। এক, তারা আমাদের কথা শুনতে আগ্রহী না। দুই, যখন দেখে আমরা আরবীতে কথা বলছি না তখন তারা আমাদেরকে পুরোপুরি অবজ্ঞাভরে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আমরা রাস্তা ধরে এগুতে শুরু করলাম। এরই মাঝে জাকির ভাই আমাদের গ্রুপের একজন বাংলাদেশী শেখ বা গ্রুপ লিডার আসলাম হুজুরকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন কীভাবে তাঁবুতে ফিরব। উনি আমাদেরকে বাদশাহ ফাহাদ ব্রীজ পার হতে বললেন। কিন্তু ব্রীজের দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ চারিদিক থেকে সাইরেন বাঁজিয়ে অসংখ্য পুলিশের গাড়ীতে রাস্তা ভরে গেলো। গরু ছাগল খেদানোর মতন পুলিশেরা রাস্তা থেকে সমস্ত মানুষদের সরিয়ে দিলো। হয়ত কোন প্রিন্স আসবে জামারাতে পাথর মারতে। ফলে আমাদের সেই বাদশাহ ফাহাদ ব্রীজের দিকে যাওয়া সম্ভব হলো না। এবার আমরা বুঝতে পারলাম যে আমরা পথ হারিয়েছি। আমার কাছে আরেকটা ল্যান্ডমার্কের খোঁজ ছিলো, সেটা হলো আমাদের তাঁবু হচ্ছে কুয়েতি মসজিদের কাছে। অতএব আমরা পুলিশদের কিংবা স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে জানতে চাচ্ছিলাম কিভাবে কুয়েতি মসজিদে যাওয়া যাবে। শুধু অল্প কিছু লোকের কাছ থেকে আমরা সাড়া পাচ্ছিলাম ভাষাগত সমস্যার কারণে। আমাদের প্রায় চার ঘণ্টা কেটে গেলো এই গোলকধাঁধায়। বিস্তর হাঁটাহাঁটির পর অবশেষে আমরা আমাদের কাংখিত কুয়েতি মসজিদের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। কিন্তু তারপরেও কিছুতেই আমরা আমাদের তাঁবুর লোকেশন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যক্রমে আমাদের চোখে পড়ল স্কাঊটদের একটি স্টেশন। বেশ কিছু হাইস্কুলের ছাত্র সেখানে ডিউটিতে ছিলো যাদের মধ্যে একজন মোটামুটি ইংরেজী বুঝতে এবং বলতে পারে। তাদেরকে আমাদের তাঁবুর নাম্বার দিতে, তারা তাদের জিপিএস-এ আমাদের তাঁবুটিকে সনাক্ত করে ফেললো। তাদের মধ্য থেকে তিনজন এগিয়ে এলো আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে। যখন আমরা আমাদের তাঁবুতে এসে পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে বাজে রাত দুইটা। আমাদের তাঁবুর মুখে যে রিসেপশন বুথ ছিলো সেখান থেকে সেই তিনজনকে আমরা বরফ শীতল ‘বেবসি’ (পড়ুন পেপসি) দিয়ে ধন্যবাদ জানালাম। ক্লান্তিতে আমরা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। কোন রকমে সারা গায়ে পানি ঢেলে গোছল সেরে সোজা আমাদের বরাদ্দকৃত সোফাবেডে শরীর এলিয়ে দিলাম। পরদিন জাকির ভাই তার আইফোনের একটা আপস ঘেঁটে জানালেন আমরা মোট চল্লিশ কিলোমিটার হেঁটেছি কাল সারা দিনে যার সিংহভাগই ছিলো মীনাতে হারিয়ে যাওয়ার কারণে।
চমৎকার বর্ণনা!
আমি হজ্জ্ব করেছিলাম ২০০৫-০৬ (ডিসেম্বর-জানুয়ারী) সালে। আমি হারিয়ে যাইনি, তবে মীনায় ভীষণ জ্বর এবং কাশিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। সে সময় আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিল ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ, সম্ভবতঃ এক্স ফৌজিয়ান। সে যদি আমাকে উদারভাবে কায়িক শ্রম দ্বারা সাহায্য না করতো, আমার সেবারে হজ্জ্ব সম্পূর্ণ করা সম্ভব হতো না। এজন্য আমি তার কাছে আজীবন ঋণী হয়ে থাকবো।
সেবারে মক্কায় একটি দুর্ঘটনাও ঘটেছিল, যার ফলে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটে।