যেকোনো সময় বৃষ্টি ক্যাডেটদের খুব আকাঙ্ক্ষার। এর পেছনে অনেক কারণ, যেমন সকালের বৃষ্টি ফলইন ও পিটি-প্যারেড থেকে বিরত রাখে, ক্লাস টাইমের বৃষ্টি মনকে ভাবুক বা আবেগী করে তোলে এবং ক্লাসে ঘুমানোর আবহাওয়া তৈরি করে দেয়, দুপুরের বৃষ্টি ঘুমাতে হেল্প করে ইত্যাদি আরও অনেক কিছু …।
যাই হোক সেদিন বিকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। টি- ব্রেকে, প্রেপে ও ডিনার এ গেলাম করিডোর দিয়ে। ডিনার থেকে আমরা সবাই সবে মাত্র ফর্মে এসেছি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রচণ্ড হৈচৈ হচ্ছে কারন বাহিরে প্রচণ্ড বৃষ্টি । সেদিন প্রেপ ডিউটিতে ছিলেন সরকার স্যার। সরকার স্যার এর একটা বৈশিষ্ট্য হল স্যারের সাথে কেউ কিছু করে ধরা না খাওয়া পর্যন্ত তার কাছে কেউ খারাপ হত না। আর স্যার খুব সহজেই পুরান কথা ভুলে যেত এবং সবসময়ই পাপের জন্য পাপী হিসেবে দেখতেন না।
তো যাই হোক কোন দিক দিয়ে যে সরকার স্যার চলে এসেছেন আমরা কেউ বুজতেই পারিনি। এসেই সবাইকে হ্যাজ- ডাউন করে একদিক থেকে ছাতা দিয়ে পিটানো আরম্ভ করলেন। পিটাতে পিটাতে তার ছাতা বাঁকা হয়ে গেল এবং আমাদের ফর্মের পেছনের বুক-শেলফে তার ছাতাটা রেখে পরের হতভাগা ফর্মে গেলেন। নতুন সঙ্গী হল গাছের ডাল।
স্যার চলে যাওয়া মাত্র আমরা সবাই যার যার ব্যাক সাইড ডলা ডলি করতে করতে কেউ পড়তে বসলাম আর কেউ টয়লেটে গেল। আমার সেদিন কেন জানি খুব মেজাজটা খারাপ ছিল। মাথার মধ্যে চিন্তা আসলো স্যার যেহেতু ছাতাটা রেখে গেছে তো আজকে স্যারের ছাতাটা কেটে দেই। যেই চিন্তা সেই কাজ। ডেস্ক খুলে চকচকে কেচি বের করলাম আর কাকে যেন বললাম ওই দেখত স্যার আসে নাকি? আমার হাতে কেচি দেখে কেউ কেউ না করল আর কেউ কেউ উৎসাহ দিল। অতঃপর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে স্যারের ছাতাটা কেটে দিয়ে ভদ্র ছেলের মত ডেস্কে এসে বসলাম।
নানাবিধ চিন্তা করতে করতে কখন যে প্রেপ শেষের ঘন্টা দিল টের পেলাম না। সবাই দেখি বই খাতা গুছিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি সবকিছু নিয়ে রেডি হতেই স্যার চলে আসলেন ছাতা নেবার জন্য। স্যারকে লম্বা একটা সালাম দিয়ে হাউসের দিকে রওনা দিলাম। মাথায় তখন কত রকমের চিন্তা, স্যার বাসায় যেতে যেতে বৃষ্টিতে ভিজবে আর বুজবে ক্যাডেটদের মারার কতধানে কত চাল। হাউসে এসে একেকজনের একেক কল্পনা, স্যার শিউর কালকে বিশাল একটা হাঙ্গামা বাঁধাবে। আর এর সবকিছুর মুলেই যেহেতু ছাতা, সেহেতু আমাদের ফর্মকেই সেই দায় নিতে হবে।
অনেক জল্পনা কল্পনার শেষে পরের দিন এলো। কোন একটা পিরিয়ডে আমাদের ক্লাশের স্যার ক্লাশ নিতে আসেনি। সরকার স্যার অন্য একটা ক্লাশ নিতে যাবার সময় আমাদের ক্লাশে ঢুকলেন আর হাসতে হাসতে বললেন, কালকে তোমরা আমার ছাতা কেটে দিছ। আমার পিঠে থাপ্পর দিয়ে বের হয়ে গেলেন। জানিনা আমার মনটা কেন যেন একটু আনচান করে উঠল। আমার ডেস্ক ছিল সবার পেছনে, ঠিক পেছনের গেইটের সাথে। সেই হিসেবে থাপ্পর দেওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু মনের মধ্যে ভয়টা ছিল, কিরে ধরা খেয়ে গেলাম নাকি?
পরের দিন ক্লাশে ফর্ম মাষ্টার মিজান স্যারও এসে আমাদেরকে হাসতে হাসতে বললেন, কি শুনলাম বয়েজ? তোমরা নাকি সরকার স্যারের ছাতা কেটে দিছ? আমরা অনেক বিশ্বাসের সাথে বললাম। স্যার আপনার ফর্মের ছেলে হয়ে কি আমরা এই কাজ করতে পারি? এইটা আপনি কি বলেন স্যার? স্যার বললেন ওইটাইতো ভয়!
আজও যখন আমাদের গেট-টুগেদার হয় বা পুরনো দিনের কথা মনে হয়। সৃতি চারণ করতে করতে অনেক সময় সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায় আর আমার খুব অনুশোচনা হয়। যদি কখন সরকার স্যারের সাথে দেখা হয় আমি বলব, স্যার আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমিই সেই দিনের পাপী। স্যার হয়ত হেসে বলবে তখনতো তোমরা ছোট ছিলে।
🙂
স্যারের জন্য একটা নতুন সুন্দর দেখে ছাতা কিনে পাঠিয়ে দে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আমাদের সময় আমরা স্যারদের সাইকেলের চাকার হাওয়া ছেড়ে দিতাম। আর বর্ষার সময় ক্যাডেট কলেজের মজাই আলাদা। অনেক কথা মনে পড়ে যায়।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম