প্রবাসের গল্প

অনুগল্প – ১ঃ পড়াশুনা আর টিকে থাকা

ইউরোপের উদ্দশ্যে উচ্চ শিক্ষার্থে দেশ ছেড়েছি ২০১২ সালে – তাও প্রায় আড়াই বছরেরও বেশি হয়ে গেল। মোটেও সোজা ছিল না শুরুর সময়টা। নতুন দেশ, পরিবেশ, পড়ালেখার ধরণ, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট, জন্মের ঠান্ডা, স্বর্ণকেশী/নীলনয়নাদের আনাগোনা – সব মিলিয়ে অনেক কঠিন মন বসানো। তারপরেও জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে।
ইউরোপীয়ানদের তুলনায় আমাদের ম্যাথের ব্যাকগ্রাউন্ড যথেষ্ট দুর্বল। শুরুর দিকে এপ্লায়েড ক্রিপ্টোগ্রাফির ক্লাশে কী যে বুঝি না – তাও বুঝি না, সব এন্টেনার উপর দিয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে প্রফেসরকে হাবিজাবি প্রশ্ন করি। এক বিদেশী ক্লাসমেট লাঞ্চ আওয়ারে টেবিলে বসতে বসতে বলে বসল, “এইগুলা তো ব্যাচেলরেই শেখার কথা।”
ব্যাটার খাবারের ট্রেতে দেখলাম বি এমড ব্লিউ গাড়ির চাবির রিং। ভেতরে মনে হয় ক্যাডেটীয় অহংবোধে লাগল, কিছু না বলে থাকতে পারলাম না।

বললাম – বাহ, তুমি তো দেখি বি এম ডব্লিউ গাড়ির মালিক !
সহপাঠীঃ আহ, এ আর এমন কি ! আব্বা কিনে দিছে, এদিক সেদিক যাওয়া যায় – এই আর কি ! (সলজ্জ হাসি)
বললাম – তা তোমার বাবা কি করে?
সহপাঠীঃ আমার বাবা-মা দু’জনেই আর্কিওলজিস্ট।
বললাম – তা তোমার দাদা কি করত?
সহপাঠীঃ সে এক কালের ব্যারিস্টার, এখন রিটায়ার করছে।
বললাম – দেখ, আমি কৃষক পরিবার থেকে এসেছি। আমার দাদা ছিল নিরক্ষর কৃষক, মনে হয় আমার দাদার বাবাও তাই ছিল। আর আমি আসছি বাংলাদেশ থেকে – যেটা কিনা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটা। আমার গ্রামে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি ২০০৮ সালে। কিন্তু দেখ – তুমি আর আমি আজ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। এখন তুমিই আমাকে বল – কে বেশি জোরে দৌড়াচ্ছে?
সহপাঠীঃ আরে ভাই, এত রেগে যাওয়ার কি আছে? আমি এত সিরিয়াসলি কিছু বলতে চাই নাই। আমি সরি।

বিঃ দ্রঃ পরীক্ষায় আমরা দুই জনই ৩০ এ ২৭ পেয়েছিলাম।

অনুগল্প-২ঃ প্রবাস রম্য বা সাধুরীতির চর্চা

জ্বরের কবলে পড়িয়াছিলাম। পরিশেষে হাসপাতালে যাইতে হইল। টেকো ডাক্তার কিছু পরীক্ষার নির্দেশ দিয়া ইন্টার্ণ ডাক্তারের হাতে সমর্পন করিল।
আমার জ্বর আরও দুই পারদ বাড়িয়া গেল নীল নয়না অপ্সরীকে দেখিয়া। সুন্দরী আমাকে পর্দার আড়ালে লইয়া স্মিত হাসিয়া দিগম্বর হইতে আদেশ করিল। একই সাথে পুলকিত, শিহরিত এবং শঙ্কিত হইলাম।
শুধাইলাম – “কেন?”
অপ্সরী মুক্তোঝড়া হাসি দিয়া কহিল – “এর পর থেকে কোন মেয়ে পরিধেয় বস্ত্র খুলতে বললে কোন প্রশ্ন না করে কথা শুনবা।”

বিঃ দ্রঃ এই নাদানের কোনও ধারণা ছিল না যে তাপমাত্রা মাপন যন্ত্র এইরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে।

অনুগল্প-৩ঃ চাকুরী আর বেঁচে থাকা

ইউরোপীয়ানরা চাকুরী বিমুখ – এই উপলব্ধি বেশি দিনের না। তারপরেও সিংহভাগ তরুণরা হয় একাডেমিক অথবা ব্যবসামুখী। অনেকেই গবেষণার পথ বেছে নেয় শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আগ্রহের জন্য। আবার একটা অংশ আছে যারা বেঁচে থাকার জন্য অন্যের গোলামি করার ঘোরতর বিরোধী। যদিও এখানে চাকুরীর ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অনেক বাঘা বাঘা কোম্পানির চাকুরি থেকে ঢের বেশী সুযোগ-সুবিধা মেলে।

দেশের তুলনায় অনেক কম পরিশ্রমে ছোট-খাট একটা চাকুরী পেয়ে গেলাম। নিয়ম-নীতি অনেক শিথিল এখানে। সকালে তাড়াহুড়োয় কিছুই খাওয়া হয় না – তাই এদের রসুই ঘরে সেই ব্যবস্থা আছে। চা-কফি, ফলমূল – মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম – ভাই, আপনারা এত ভাল কেন? তাও কাকে? কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতাকে। প্রথম সপ্তাহান্তে দুপুরের খাওয়ার দাওয়াত – সহ-প্রতিষ্ঠাতার তরফ থেকে। হয়ত বছর তিরিশেক বয়স হবে। মোটা ফ্রেমের চশমার ওপাশে হাসিখুশি চঞ্চল চোখ। বলল – “দেখ ভাই, আপাত দৃষ্টিতে ভাল লাগলেও এটা ফ্যামিলি লাইফের জন্য ক্ষতিকর। তুমি তোমার পরিবারকে সময় দেয়ার চাইতে এই কাঠখোট্টা অফিসেই বসে থাকবে। এটা তোমার পরিবারের জন্য মোটেও কাম্য নয়।” মুগ্ধ হলাম লোকটার সততায় – নিজের পলিসিরও সমালোচনা করতে জানে। এই বয়সেই মিলিওন ডলারের কোম্পানির মালিক। ব্যবসা আছে আমাদের দেশেও – লামুডি বাংলাদেশ এবং কারমুডি বাংলাদেশ

পলের বক্তব্য অনুযায়ী, তুমি সব চাকুরীতেই এক ঘেয়েমির স্বীকার হবে। একমাত্র ব্যতিক্রম – যদি তুমি নিজে কিছু তৈরী করতে পার। সেটাই তোমার প্যাশন হয়ে দাঁড়াবে, নিজের জন্য কাজ করতে কখনো তোমার ক্লান্তি আসবে না। তুমি দুই ভাবে শুরু করতে পারঃ ১) বর্তমান ব্যবসার ধারায় তুমি তোমার জিনিস নূতনভাবে উপস্থাপন করতে পার। এর জন্য দরকার মূলধন – যা বেশিরভাগ তরুণের কাছেই দূরাশা। ২) তুমি তোমার নূতন আবিষ্কার বাজারে নিয়ে আসতে পার। এর জন্য অনেক লগ্নিকারি পাবে তুমি।

বিঃ দ্রঃ পলের কাছে সবক নেয়া শুরু হয়ে গেছে। এরা ছোটদের উৎসাহ দেয় – বড় হয়ে গেছে বলে ধরা কে সরা জ্ঞান করে না।

৩,৭৩৫ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “প্রবাসের গল্প”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ব্লগে স্বাগতম উল্লাস, তিনটে গল্পই দারুন লাগলো।

    আশা করি নিয়মিত তোমার লেখা পাব, হ্যাপি ব্লগিং


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূরুল মোমেন (২০০০ - ২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।