তখন আমি ক্লাস ইলেভেন এ। একাডেমিক ব্লকে ক্লাস টেন বি ফর্মের কোনায় শেডের পাশে একটা ছোট আম গাছ ছিল। গাছে লিচুর চেয়ে সাইজে সামান্য বড় আম গুলো অনেকদিন ধরে চোখে চোখে রাখি, কবে পাকবে। তো আমগুলো কেবল মাত্র পাকা শুরু হয়েছে। এক বৃহস্পতিবার মিল্কব্রেকের পর কোনো এক স্টেজ কম্পিটিশনের সময় অডিটোরিয়াম থেকে পালিয়ে গিয়ে শেডে উঠলাম, সাথে বন্ধু শাহাদুজ্জামান। দুজন মিলে গাছ ছাফা করে দিলাম। ছোট গাছ, সব মিলিয়ে ৫/৬ কেজি আম, কিছু পাকা, বেশিরভাগই পাকার অপেক্ষায়। নিয়ে গেলাম ইলেভেন হিউম্যানিটিস ফর্মে (আমাদের ব্যাচে কোনো আর্টস ছিল না, ফর্মটা ফাকাই থাকতো)। দুই বন্ধু কিছু আম খেয়ে, কিছু পকেটে ভরে বাকিগুলো কোনার দিকে একটা ডেস্কে তালা মেরে রাখলাম, পাকলে সবাই মিলে খাওয়া যাবে। তারপর কম্পিটিশন শেষে সবার সাথে লাঞ্চে গেলাম। দুদিন পর আমগুলো পাকছে কিনা দেখার জন্য বন্ধুকে নিয়ে হিউম্যানিটিস ফর্মে গেলাম, পুরা ফর্ম পাকা আমের গন্ধে মৌ মৌ করছে, ডেস্কের কাছে গিয়ে দেখলাম, তালা ভাঙা, আম গায়েব।
এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন টাইমে, তখন সবে মাত্র আমগুলো একটা শেপ পেয়েছে, ভিতরে আটি এখনো শক্ত হয়নি। একদিন মনে হল কাচা আম ভর্তা খাবো। রেস্ট টাইমে দুই-তিনটা নেটের ব্যাগ আর পাজামার ফিতা পকেটে নিয়ে চলে গেলাম আমচুরি করতে। একাডেমিক ব্লকের ছাদের উপর থেকে একটা কাচামিঠা গাছের আম নাগাল পাওয়া যেত। আগে গেলাম অডিটোরিয়ামের পাশে, সুইপার কানুদা এখানেই এক চিপায় তার ঝুলঝাড়ু রাখতো। একটা হালকা-পাতলা ঝুলঝাড়ু আর ২ টা চিকন কাঠালের ডাল নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। কাঠালের ডাল গোল করে বেধে তার সাথে একটা নেটের ব্যাগ সেট করলাম, তারপর সেটাকে পাজামার ফিতা দিয়ে শক্ত করে ঝুলঝাড়ুর এক কোনা সেট করে বানিয়ে ফেল্লাম আম পাড়ার যন্ত্র। টপাটপ এক ব্যাগ আম পেড়ে নানান প্রতিকূলতা পার হয়ে হাউসে আসলাম। সবাই মিলে কিছু আম খেলাম, বাকিগুলো পচিয়ে ফেলে দিলাম। আম খাওয়ার চেয়ে চুরির আনন্দ অনেক বেশী ছিল কিনা।
ক্লাস ইলেভেন, বৈশাখ মাস। আমাদের ফর্মের সামনেই একটা মোটা আমগাছ। কাচা আম। তখন হঠাৎ করে ট্রেন্ড চালু হল, মিল্কব্রেকের পর টিচাররা যখন স্টাফ লাউঞ্জে ক্যাডেটদের সমালোচনায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় আমরা আমাদের অক্সফোর্ড সু খুলে সেগুলো দিয়ে ঢিল মেরে আম পারতাম, আম পড়লে দৌড়ে নিচে গিয়ে আম এবং জুতা নিয়ে আসতাম। আমাদের ফর্মের নিচেই ছিল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট। একদিন আমি জুতা দিয়ে গাছে ঢিল মারলাম, লক্ষভেদ। একবারে ৩/৪টা আম পড়ল। হঠাৎ নিচে আমেনা ম্যাডামের কন্ঠ, “ইবাদত, যাওতো আমগুলো নিয়ে আসো। ইবাদত ভাই ফিজিক্সের ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট ছিল। সে গিয়ে আম কুড়িয়ে এনে ম্যাডামের কাছে জমা দিল। পরে আমি চুপি চুপি গিয়ে আমার জুতা নিয়ে আসলাম। পরদিন ফিজিক্স ক্লসে আমেনা ম্যাডাম ফর্মে এসেই বলল, আমগুলো তো তোরা পাকতে দিবি। এতো টক কাচা আম কিভাবে খাবি। এই বলে ব্যাগ থেকে একটা বাটি বের করে আমাদের দিলেন, বাটিতে গতকালকের আমগুলো ভর্তা করা। হেব্বি টেস্ট। ক্যাডেট কলেজের টিচারদের এই ছোট্ট ছোট্ট মমতা মাখানো ঘটনাগুলো কি চাইলেই কখনো ভোলা সম্ভব?
ক্লাস নাইনে আমের মৌসুমে কোনো একটা অসুখ বাধিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সন্ধ্যাবেলা প্রচন্ড ঝড় শুরু হল। হাসপাতাল এটেন্ডেন্ট মাসুদ ভাই হাসপাতালের চার্জার লাইট আর ছাতা নিয়ে আম কুড়াতে বের হল। তার পিছে আমরা ৩/৪ জন রোগী বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়াতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ড এর ফ্লোর নানান কিছিমের আম দিয়ে ভর্তি। পরের দুইদিন অসুস্থ ক্যাডেটরা আম খেলাম, সুস্থ ক্যাডেটদের দাওয়াত দিয়ে এনে আম খাওয়ালাম।
হাউসের টিটি রুমের পিছনে একটা হিমসাগর আমগাছ আছে, ক্লাস টেনে তিন রুমমেট মিলে প্লান করলাম ঐ গাছের আম পাড়বো। প্লান অনুযায়ী আমি আর মেহরান হাউসের পিছন দিয়ে গেলাম আম গাছের নিচে। শফিক থাকলো হাউসের করিডোরে। আমি গাছে উঠে আম পেড়ে পেড়ে মেহরানকে দিলাম, মেহরান সেগুলো কুড়িয়ে হাউসে ঢিল মারলো, শফিক ক্যাচ ধরে ধরে রুমে নিয়ে রাখলো। এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ব্যাপার টা হাউস প্রিফেক্ট আবেদীন ভাইয়ের চোখে পড়লো। তিনজনকেই ডেকে স্টেটমেন্ট লিখতে বলল। তিনজনই স্টেটমেন্ট লিখে ভাইয়ের কাছে জমা দিয়ে বললাম, ভাই যাবো?? ভাই বলল, কোথায় যাবি। আমি বললাম, “আম পাড়তে।”
এতো গেল আম চুরির ঘটনা, এবার আসি কলেজের আম কিনে খাওয়ার ঘটনায়। শেডের পাশে সেই ছোট্ট আমগাছটার পাশেই একটা বড় আমগাছ ছিল, আমের জাত ছিল আম্রপলি। গাছটা ছিল অনেক লম্বা এবয় আমগুলো ছিল নাগালের বাইরে। আমপাকার মৌসুমে ধীরে ধীরে গাছের লম্বা লম্বা আমগুলো হলুদ হতে শুরু করলো, প্রতিদিন ফর্ম থেকে বের হয়ে আমগুলো নজরদারি করতাম, কিন্তু এইটুকুই, পারার মত সাহস বা সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু নজরে যখন পড়েছে, আমতো খেতেই হবে। তো, দেখতে দেখতে এদি দেখি আমগাছ যারা লিজ নিয়েছে সেই পার্টি ঐ গাছের আম পাড়ছে। এটা দেখে একাডেমিক টাইমেই লুকায়া লুকায়া হাউসে গেলাম, লকারের ড্রয়ারে কিছু টাকা রাখা ছিল, ১০০ টাকা নিয়ে আবার শেডের পাশে গিয়ে তাদের কাছ থেকে আম কিনতে চাইলাম, তারা তো ক্যাডেটদের কাছে আম বেচবেই না। অনেক রিকোয়েস্ট করার পর ব্যাপারটা কেউ জানবে না, এই শর্তে তারা আমাকে ১০০ টাকার বিনিময়ে দুই কেজি আম দিল। এরপর গত কয়েক বছরে অনেক আম কিনে খেয়েছি, কিন্তু ১০০ টাকায় কেনা সেই আমের মত মজা আর কোনো আমে পাইনি।
২০০৮ সালে এক্সক্যাডেট হওয়ার পর একবার আমি আর শাহাদুজ্জামান আমের দিনে কলেজে গিয়েছি এইচএসসির মার্কশীট তুলতে। কলেজে গিয়ে স্যার ম্যাডামদের সাথে দেখা করার এক পর্যায়ে গেলাম বায়োলজি ল্যাবে, ডেমোন্সট্রেটর রফিক স্যারের সাথে দেখা করতে। স্যারের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর স্যার আমাকে বলল, হাসান, আমের দিনে কলেজে আসছ, কলেজের আম না খেয়ে গেলে খারাপ লাগবে না?? এই বলে সে ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট সালাম ভাইকে দিয়ে গাছ থেকে দুইটা আম পাড়ালেন, এন্টি কাটার দিয়ে নিজেই আম দুটি কেটে দিলেন, আমরা খাইলাম। আহারে আম, কলেজের গাছের আম। নয় বছর হয়ে গেল, কলেজের গাছের আম আর কপালে জুটল না।
মজা পাইলাম... ভাল লাগল পড়ে