৩০শে মে, ১৯৮১ সাল।
স্টুডেন্টস্ হোস্টেল।পিটার হিলি ওয়েগ ১৩। প্যাডারবর্ণ উনিভার্সিটাট।শনিবারের আলসে সকাল। সবাই ঘুমে বিভোর। আমার রুমের দেয়ালে কানের কাছে ধুম ধুম শব্দ পেতেই পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করি।এই এক মহা জ্বালাতন। পাশের রুমে ইরানী একটা মেয়ে থাকে।রুশি! কিছু লাগলে কলিং বেল না দিয়ে, মাথার কাছের দেয়ালে ধুম ধুম পেটাতে থাকে। আর চিল্লায়! আর পার্টিশন দেয়াল গুলিও যে কি! আমাদের দেশের মত ইট সিমেন্টের না। মনে হয় মোটা কোন সিন্থেটিক বোর্ড টাইপের। প্রচণ্ড আওয়াজে ঘুম শেষ!
চিল্লানি আসছে পাশের রুম থেকে। হাকিম শিগগীর টিভি খোল, তোদের দেশের প্রেসিডেন্ট কে মেরে ফেলেছে!
বিশ্বাস হলনা পাগল মেয়ের কথা।কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানোর রাগে উল্টা চিল্লালাম, তোদের ‘খোমেনি’ মরুক। আলাই বালাই।
শুয়ে শুয়েই পা দিয়ে সুইচটা অন করলাম।টিভিটা চালানোই থাকে,শুধু সুইচ দিলেই হয়।
ব্রেকিং নিউজ চলছেঃ আজ ভোর রাতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছে। বিস্তারিত কোন সংবাদ জানা সম্বভ হচ্ছে না , কারন চট্টগ্রাম, রাজধানী ও দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। অসমর্থিত খবরে প্রকাশ, দেশের বাকি সেনা বাহিনী রাজধানী কেন্দ্রিক প্রশাসনের অনুগত আছে, প্রয়োজনে বিদ্রোহীদের কবল থেকে বিচ্ছিন্ন চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে সেনা অভিযানে প্রস্তুত।সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ছবি, ভিডিও ক্লিপিং দেখাচ্ছে। মাত্র সপ্তাহ কয়েক আগে জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সফর করে গেছেন সদল বলে!
হত বিহল্বের মত বসেই রইলাম বিছানার উপর।
মাত্র দুই-তিন সপ্তাহ আগের কথা। রাজধানি বন থেকে বাংলাদেশ এমব্যাসির মুক্তা ভাই ফোনে অবশ্যই যেতে অনুরোধ করেছেন। কাছের সব বাঙালি ছাত্ররা যাবেন প্রেসিডেন্ট আসা উপলক্ষে।
আমদেরও তখন তেমন কাজ নেই। পরীক্ষার শেষে অলস সময়ে কাজ এবং বেড়ানোর ধান্দা করছি।তাই সানন্দে রাজি হলাম।
এবার দিয়ে মোট তিন বার জেনারেল সাহেবের সামনা সামনি হলাম। লাঞ্চ শেষে ‘ইনফরমালি’ সবার সাথে গল্প গুজব করছেন। কথা বলেন কম,শুনেন বেশি আর সবার সাথেই স্মিত হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়েন।
তৃতীয় বারের মত নিজের পরিচয় দিয়ে, অনুচ্চ স্বরে বললামঃ Sir, I’m one of your “Faujian Monkey,without tail” !
শুধু হেসে মাথা নেড়ে বললেনঃ You are here, again? What do you do? study?? উত্তর শুনে, অন্যদের সাথে আলাপে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে তিন বার জেনারেল জিয়ার সাথে পরিচয় হয়ে ছিল আমার।শেষেরটাতো উল্লেক্ষ করা গেল। প্রথম ও দ্বিতীয় বার পরিচয়টা আরো বিচিত্রতর।
প্রথমবার সম্ভবত ১৯৭৪ সাল হবে। সবে মাত্র মেজর জেনারেল হয়েছেন, ক্যাডেট কলেজ সমূহের চেয়ারম্যন তখন তিনি। আমাদের ব্যাচে কি একটা ঝামেলায় চার পাঁচ জন নিরীহ ব্যাচেমেট কে তৎকালীন প্রিঞ্চিপাল এক্সপেল করেন।যাদেরকে বের করেন তারা প্রকৃতই নিরীহ প্রকৃতির ছেলে ছিল। তাই আমাদের সম্পূর্ণ ক্লাশ ফুঁসে উঠে। আমরা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করি। স্বাধীনতার অল্প কয়েকদিন পরের জন্যই হয়ত এইসব আন্দোলন-টান্দোলন রক্তে বেশি নাড়া দিতো!
যাহোক সেই অসহযোগিতার উপলহ্মেই জিয়াউর রহমানের ক্যাডেট কলেজে আগমন। আমাদের কতিপয়কে ডেকে ঘণ্টা খানিক ঝেড়ে লেকচার কাম বকাবকি।তার মধ্যে কয়েকশ বার ” You all are Monkeys, without tail” ডায়লগটি ছিল।
দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ১৯৭৭ সালের দিকে, উনি তখন দেশের চীফ মার্শাল ল এডমিনিস্টেটর অথবা প্রেসিডেন্ট। “জনদল” বলে একটা দল সংগঠনের জন্যে সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাদের পাঞ্ছলাইশের এক হাজি সাহেবের বাসায় দুপুরে খাবার দাওয়াতে আমরা মেহমানদারি শেষে নিজের ফৌজিয়ান পরিচয় দিয়ে ঐ ঘটনার কথা এবং ঐ ডায়লগটির কথাও বললাম। সম্ভবত মুড ভাল ছিলনা। কিছু বললেন না।
এবং শেষ বার, এই সেদিন। শতাধিক ডেলিগেশন, কালচারাল টীম নিয়ে রাষ্ট্রীয় সফরে এলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। জার্মান সংবাদপত্রে সুনাম-দুর্নাম দুই ই বেরোল।ভাল ভাল সংবাদ পত্র, রেডিও টিভিতে বেশ ভাল কভারেজ পেলেন।
“বিল্ড সাইটুং” এর মত গসিপ পেপারে শুধু অনেক গোলমেলে সংবাদ ছাপা হল। যার মধ্যে একটা নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করি, সেটার হেড লাইন ছিলঃ “দরিদ্র দেশের একজন প্রেসিডেন্টের ওভার কোট ছাড়া কিন্তু সাথে সুন্দরীদের সহযোগে আগমন”!
একটা সাধারন ঘটনা হলুদ সাংবাদিকতার কারনে কিভাবে দুষ্ট হয়, উপরুক্ত খবর তার প্রকৃষ্ট উধাহরন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া বুন্দেস রিপাবলিক অফ জার্মানির প্রেসিডেন্ট সহযোগে গার্ড অফ অনার নিচ্ছিলেন। তখন গ্রীষ্মের শুরু। কিন্তু জার্মানিতে হঠাৎ এক-দুই ঘণ্টার নোটিশে তাপমাত্রা কমে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পরে যায়।সেদিন ছিল ঠিক তেমন একটি দিন। রোদ ঝল-মলে শুরু, কিন্তু হঠাৎই হাড় কাপানো শীত। স্যুট পরহিত জেনারেল “স্লো মার্চের” সময় ঠক ঠকিয়ে কাপছিলেন দেখে,প্রেসিডেন্ট কেরস্টীন তার পি এস কে একটা ওভার কোট দেবার জন্যে ইশারা করেন।
বিশাল লম্বা পি এস তার নিজের ওভার কোটটা খুলে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে দিলে, যার ঝুল মাটি পর্যন্ত পরে। ওদিকে সাংস্ক্রিতিক দলে রোজী সামাদ সহ গায়িকা-নায়িকারা ছিলেন বিধায় কিছু হলুদ সাংবাদিক দুটি ঘটনা এক করে এই তির্যক টিপ্পনী কাটে।
সম্বিত ফিরে পেলাম রুশির ডাকে।Hakim, don’t be sad.It happens in politics. One fine morning our Shah was also thrown out,..that’s why we are here now…
আমার মাথায় তখন এসব কিছুই কাজ করছিল না। শুধু ভাবছিলাম, চট্টগ্রাম না জানি কি হচ্ছে।আমার মা- বাবা, বোন আমার সব স্বপ্ন, আমার চাটগায় নিশ্চয়ই যুদ্ধ ছড়িয়ে পরেছে।
আজ একত্রিশ বছর পরে আমার নিজেস্ব পরিচয়ের সামান্য স্মৃতি টুকু রোন্থন করতে যেয়ে ভাবছিলাম একজন সম্পূর্ণ ‘অরাজনৈতিক’ মানুস হিসাবেঃ
আজ আমার এই লিখাটা যখন প্রকাশিত হবে, বিভক্ত দেশের কিছু পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই ঠোঁট উল্টে ” সোনার ছেলেদের কীর্তি… ” বলে টিপ্পনী কাটবে, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। প্রবাহমান জিবনে ছোট বড় যে সমস্ত ব্যক্তিত্বদের কাছা কাছি এসেছি, তাঁদের ভাল-খারাপ বাছ-বিচার, তাঁদের কীর্তির সমালোচনা করার কোন যোগ্যতাই আমার নেই ।
মৃত্যু দিবস গুলিতে শুধু মানুষগুলির সাথে কাটানো সময় মনে পরে যায়, তাদের অকালে ঝড়ে যাওয়া মনকে বিষণ্ণ করে তোলে!
আজিজ ভাই, লেখা ভালো লাগলো। :clap:
আমার সাথে সাথে স্মৃতি গুলি হারিয়ে যাবে, তাই পরবর্তীদের জন্যে লিখে রাখলাম।
ধন্যবাদ শিশির।
Smile n live, help let others do!
::salute::
ভালো লাগলো আজিজ ভাই। চমৎকার স্মৃতি।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
গুরু, তুমি কোথায়? কালকে যাবা এফ সি সি তে??
তোমাদের এখানে এই ফোল্ডারে জীবনের সব খুঁটিনাটি মজার স্মৃতি গুলি লিখে যাবো মনস্থ করেছি। ভাল না লাগলেও বাধ্য হয়ে পড়ো। মরে যাবার পর বকা ঝকা দেবারোতো একটা চান্স পাবা! 😀
এই সাদা মাটা লিখা তোমাদের মত দেশ বরন্য লিখক-সম্পাদকদের কাছে ভাল লাগছে যেনে অনেক ভাল লাগছে। ধন্যবাদ ভাইজান।
ভাল থেকো। চট্টগ্রামে দাওয়াত রইল।
Smile n live, help let others do!
দুঃখিত আজিজ ভাই, মন্তব্যের জবাবটা আগে চোখে পড়েনি। হ্যা, হঠাৎ করেই ফৌজদারহাট গিয়েছিলাম। মামুন, ফায়সাল আর আমি। শুক্রবার ভোরে রওয়ানা হয়ে সাড়ে ৩টায় কলেজ গেষ্টহাউজে লাঞ্চ করেছি। তারপর চিটাগাং ক্লাবে গিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার দিকে কলেজে ঢুকেছিলাম। অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। ইয়াকুব ভাইয়ের সঙ্গেও।
কব্জি ঢুবিয়ে মেজবান খেয়েছি। সুগার-টুগার ভুলে কলেজের বিখ্যাত জর্দা-আইসক্রিমও খেয়েছি। রাত ১১টায় শহরে ফিরে এসে সোহেল, হালিমদের সঙ্গে দেড়টা পর্যন্ত আড্ডা হলো। শেষে আবার ঢাকার ৩জনের আড্ডা চললো সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। পরদিন ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে ১১টার দিকে রওয়ানা হলাম। পৌঁচেছি সন্ধ্যা ০৬টায়।
এই হলো সংক্ষেপে ফৌজদারহাট সফর। 😀
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
চমৎকার লাগলো ভাই :clap: :clap: :clap:
তোমাকেও ধন্যবাদ নাছিম। ভাল থেকো।
Smile n live, help let others do!
ককটেল রেসিপি একটা নামান এবার বস।
গল্পের ঝাঁপি উপুড় করে দিন।
তুমিতো কিছুই ভুলনা দেখি, নুপুর! সব গল্পতো আর লিখা যায় না।
(এটাতেও সেন্সারড হয়েছে প্রচুর)
বাই দা ওয়ে, " হান্টার " নামে আমাদের দেশের প্রস্তুত একটা ক্যনড বিয়ার বেরিয়েছে, যমুনা গ্রুপের। আমিতো পান করিনা, কিন্ত একদম নাকি আন্তর্জাতিক স্বাদ। গন্ধ শুঁখে দেখলাম,আসলেই একদম এক।
দেশে আস, চিনাবাদাম- ডাল মুট সহ খাওয়াব। তখন প্রশ্ন করে সব গল্প যেনে নিও।
ভাল থেকো। (সম্পাদিত)
Smile n live, help let others do!
আজিজ ভাই, বুঝতে পারছি আপনার 'ভালবাসার মানুষ' ব্লগে আমার করা মন্তব্য আপনি এখনও ভোলেননি।
সেই ব্লগে আপনি এমন একজনকে খাটি সোনা বলেছিলেন, যে কিনা আরেকটা মানুষের জীবন ভেঙ্গে দিয়েছিল। সেই মানুষ পরে 'অনুশোচনায়' খাঁটি সোনা হতে পারে, কিন্তু অনুশোচনা তার জন্য কোন শাস্তি হতে পারে না। আপনার সাথে পরে আর তর্কে যাইনি, কারণ আপনি সিনিয়র মানুষ, হয়ত সেটা বেয়াদবী হিসেবে নিয়ে কষ্ট পাবেন। ভুল করেছি, কারন আপনি এখনও সেটা মনে পুষে রেখেছেন। আচ্ছা, আমার অবস্থানটা একটু পরিষ্কার করি।
এই ঘটনা মাতাল দিনে করে ফেলা একটা সামান্য ভুল, কিন্তু আপনি সেই বাবার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করুন। আপনি কোনদিন ক্ষমা করে দিতে পারতেন? অন্তত আমি পারতাম না। আসলে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে না গিয়ে থাকলে থিওরিটিকাল অনেক কিছুই বলা যায়। পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়, কথাটা তখন খুব ফ্যালাসি মনে হবে।
আমার বাবাকে বিডিআর হত্যাকান্ডে মেরে ফেলা হয়। সে যদি বহু বছর পরেও অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে মাদার তেরেসা হয়ে ফিরে আসে, আমি তাতে কি করব? আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না, পরজন্মেও না। আই উড বেটার কিল হিম এন্ড দেন ডাই। আমি এত মহান না, যে তাকে ক্ষমা করে দেব।
আমার বাবাকে যে মেরেছে, সে কারুর না কারুর বাবা, স্বামী, ছেলে। সে বাবাও তার সন্তানকে ভালবাসে। সেই সন্তানেরর কাছে তো তার বাবার জন্য ভালবাসা কোনদিন কমে যাবে না। কিন্তু সে যদি কোনদিন তার বাবার এই কাজের জন্য সাফাই গেয়ে কিছু লেখে, আমি একইভাবে তার বিরোধিতা করে যাবো।
এবার আশা করি বুঝতে পারছেন, পয়েন্টটা কোথায়। পুরো ব্লগে আপনার ভালবাসার মানুষের প্রতি ভালবাসায় আমার কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু যদি বলেন অনুশোচনা করেই তার শাস্তি হয়ে গেছে, আমি ঘোরতর বিরোধিতা করব।
যাই হোক, আশা করি, আমার ওপর আপনি আর রাগ পুষে রাগবেন না।
ভাইআ, লেখটা পরে ভাল লাগ্ল। আপ্নারা কালের শাখখি যারা তারা প্লিয আমাদের জন্ন গল্পের ঝাপ্পিটা খুলে দিন। ভাল থাকবেন