অনেক পুরানো দিনের একটা ফাইল খুজে পেয়ে নিজে নিজে বহু ক্ষন হাসলাম। পিয়নটা এর মাঝে দুইবার উকি দিয়ে দেখে গেছে। নিশ্চয়ই ভাবছে,স্যার কি পাগল হয়ে গেল?
আমাদের সাইকোলজি হেড অব দা ডিপার্টমেন্ট এমন একা একা রুমে ছাদের দিকে মুখ করে হাসতেন। একদিন ওর এসিসট্যান্ট কে কথাটা বলেই ফেলি সাহস করে, সে হেঁসে আমাকে আরো মজার উত্তর দেন। তাকে নাকি আত্মভোলা এই মানুষটি প্রায়ই প্রশ্ন করেনঃ আচ্ছা তুমি কি জান, আমি বাসা থেকে ব্রেকফাস্ট করে এসেছি কিনা?
যাক যা লিখতে বসেছিলাম। পুরানো ফাইলটাতে আমার আকাডেমিক সার্টিফিকেটস,কাগজ পত্রের মধ্যে কিছু চিঠি পেলাম।
চিঠি গুলির ‘শানে নযুল’ বা background এর বিষয় বস্তু মনে পরে যাওয়াই আমার হাঁসির উৎস।
প্রথম চিঠি ২৩.১২.১৯৮০ জার্মান চ্যঞ্চেলার দফতর থেকে আমাকে লিখাঃ The President of the Government, Detmold, West Germany.(DER REGIERUNGSPRASIDENT DETMOLD, Deutschland ) চিঠিটির সারমর্মঃ জনাব হাকিম, আপনার ডিসেম্বর ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্টের অনুকূলে লিখা পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে জাননো যাইতেছে যে, সারকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরাশুনা ব্যাপারে যে কোন হস্তক্ষেপের পরিপন্থী (নীতি গত ভাবে) । অতএব আপনাকে বিনীত ভাবে ‘ পাডারর্বন ইউনিভা্র্সিটির সেক্রেটারিয়েটের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা পূর্বক ব্যপারটি নিষ্পত্তি করার জন্যে অনুরোধ করা হইল। বিনীত প্রেসিডেন্টের পক্ষে …।
দ্বিতীয় চিঠি ৯.১.১৯৮১ The Provincial Culture Minister, North-Rein Westfalon Province. (Der Kultusminister, des Landes Nordrhein-Westfalen) বিষয় বস্তু একটু এদিক সেদিক করে আইনের ধারা উপধারা প্রদর্শন পূর্বক তাদের করার কিছু নেই বলে দুঃখ প্রকাশ। বিনীত প্রদেশিক সমাজ কল্যান মন্ত্রি মহোদয়ের পক্ষে…।
তৃতীয় চিঠি ২৬.১.১৯৮১ The Central Minister for Works & Social Welfare ( DER BUNDESMINISTER FUR ARBEIT UND SOZIALORDNUNG) চিঠির বিষয়বস্তু। সম্মানিত হের হাকিম, জার্মান চেন্সেলার ‘অফিস-চীফ’ মারফত আপনার পত্র প্রাপ্ত হইয়াছি।এজন্যে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনার পড়াশুনার উক্ত বিষয়টি কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও বিজ্ঞান মন্ত্রনালয়ের অধীন হওয়ায়, আমি উক্ত মন্ত্রণালয়ে ব্যপারটি নিস্পত্তির জন্যে প্রেরন করিতেছি। পরবর্তীতে উক্ত মন্ত্রনালয় হইতে আপনি সংবাদ প্রাপ্ত হইবেন।বিনীত , ডঃ হুফার- কেন্দ্রিয় কর্ম এবং সমাজ কল্যান মন্ত্রনালয়।
চতুর্থ একটি পোস্ট কার্ড ৩.২.১৯৮১ The Central Ministry of Education & Science (Der Bundesminister fur Bildung und Wissenshaft) আপনার পত্রটি আমরা প্রাপ্ত হইয়া প্রাদেশিক স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয়ে প্রেরন করিয়াছি।
পঞ্চম পত্রটি ১১.২.১৯৮১ The Home Minister, North-Rhein West Farlon Province. (DER INNENMINISTER, Nordrhein-Westfalen) আমি আপনার ডিসেম্বরে লিখা পত্র কেন্দ্রিয় শিক্ষা ও বিজ্ঞান মন্ত্রনালয় হইতে প্রাপ্ত হইয়া পরিপূর্ণ তদন্ত সম্পন্ন পূর্বক প্রেসিডেন্ট দফতরে প্রেরন করিয়াছি। মাননীয় চ্যাঞ্ছেলর মহোদয় এতদ ব্যপারে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত প্রদানকারি, আপনি অবিলম্বে তাঁর দফতর হইতে সংবাদ প্রাপ্ত হইবেন, বিনীত ফন বাউয়ার।
( উপরুক্ত সবগুলি চিঠির ‘স্কেন কপি’ নিচে দিলাম)
আমার জিবনের হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র একটা মজার ঘটনা উঠে এল এই চিঠি গুলির কল্যানে।
সবে মাত্র ল্যাংগুয়েজ শেষ করে ‘সাইকোলজির’ প্রথম সেমিস্টার শুরু করেছি।বাড়ীর সাথে একটু টান পোড়ান চলছে। বাবা সব সময় চাইতেন আমাকে ডাক্তারি পড়ানোর জন্যে। জন্মের আগে থেকেই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সামনে জায়গা খরিদ করেছেন, ইচ্ছা ছেলে-মেয়ে হলে বাড়ির খেয়ে ডাক্তারি পড়তে যাবে, সাদা এপ্রন পরে।
ডাক্তার অনেক নোবেল প্রফেশন হলেও আমাকে সব সময় বিকর্ষণ করে। কারন রুগিদের আর্তনাধ,রক্ত, মৃত্যু শোক আমার মনকে সব সময়ই বিমর্ষতায় আচ্ছন্ন করে রাখে। তা ছাড়া সমাজের প্রতি ডাক্তারদের প্রচণ্ড দ্বায়বদ্ধতা থাকে। স্ত্রী,সন্তান,বন্ধু-বান্ধব,আড্ডা,খানা-পিনার চেয়ে রুগীর সাহায্য তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর অপরাগতায় সমাজ ও সৃষ্টিকর্তা উভয়ের কাছেই দ্বায়ী থাকতে হবে। একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসাবে এর সবটাই আমার কাছে অনাকর্ষনিয় বোধ হয়েছে।
তাই মাঝা মাঝি কিছু একটা হবার লক্ষ্যে সাইকোলজি পড়তে মনস্থ করেছিলাম, ‘ পাগলের ডাক্তার ‘ তো অন্তত হতে পারবো!
কিন্তু এতেও বাধা পেলাম। হয় ফুল ডাক্তার না হয় বাবার মত ব্যবসার লাইনে পরাশুনা। তাই সাবজেক্ট পরিবর্তন করে বিজনেস এ্যড এ আসলাম। এতেই পরলাম মহা ঝামেলায়। সাবজেক্ট পরিবর্তনে “স্কলারশিপ” কেন্স্যেল! আর স্কলারশিপ কেন্স্যেলের জন্যে ভিসা এক্সটেনশান হচ্ছে না।
মহা বিপদ! নতুন করে স্কলারশিপ এর এপ্লাই করে পাবার অনেক আগেই ভিসা শেষ হয়ে দেশে চলে যেতে হবে।দুইটা রাস্তা।”স্কলারশিপ” না হয় “স্পন্সারশিপ”।
দেশ থেকে সে সময় সরকারী ভাবে পরাশুনার জন্যে বিদেশে টাকা পাঠানো যেতো না। অতএব?
প্রানের বন্ধু “মাটিয়াস” কে সমস্যাটার কথা খুলে বললাম। ওর মত সুন্দর মনের একজন মানুষ উপরওয়ালা সম্ভবত খুব অল্পই বানিয়েছেন। শুধু একটাই সমস্যা তার। অন্যান্য জার্মানদের মত ‘পানিপথে’ নয়, তিনি প্রায় দিবারাত্রির অধিকাংশ সময়ই “বায়ু পথে” পরিভ্রমণ করেন। Cannabis sativa’র একজন সাঁচ্চা সমজদার!!!
সমস্যাটার কথা মাটিয়াস কে বলায়, ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো । এই সরকারতো নাৎসিদের চেয়েও নিষ্ঠুর! এর একটা বিহিত হতেই হবে। তার ‘গাঞ্জুটে’ বন্ধুদের নিয়ে রিতিমত একটা সভার আয়োজন করে সিদ্ধান্ত নিল, বিস্তারিত জানিয়ে হাকিমকে দিয়ে (আমাকে দিয়ে) লিখিয়ে একটা দরখাস্ত পাঠাতে হবে জার্মান চ্যানসেলারের কাছে। হালমুট স্মিথ ছিলেন তখনকার চ্যানসেলার ।
যেই ভাবা, সেই কাজ। ‘গাঞ্জুটি’ দল’ কিছুতেই এই মহৎ কাজে বিলম্ব করতে নারাজ। তৃতীয় বিশ্বের এক শিক্ষার্থী কে নিয়ে সরকারের এই নিষ্ঠুর ব্যরোক্রেসি! একটা রগরগে চিঠি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে তখনই পোস্ট করার ব্যবস্থা করা হলো। যার প্রত্যুত্তরে উপরের এই চিঠির স্রোত।
কোন পাগলদের পাল্লায় পরেছিলাম আল্লাহ মালুম। এখণ এই তিন যুগ পরে চিঠি গুলি আবিষ্কৃত হওয়ায় আনাবিল আনন্দে সেই সব ঝড়ো দিনগুলি আবার মনে পরছে, মনে হচ্ছে এইতো গতকালের ঘটনা!
ঘটনাটা যতই হাসিরই হোক, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তৃতীয় বিশ্বের কোথাকার কোন এক অর্বাচীন ‘আজিজুল হাকিমের’ ডিসেম্বরে লিখা একটি পত্রের জবাব জার্মান চ্যান্সেলার অফিস হয়ে প্রদেশিক সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় কর্ম ও সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়, কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও বিজ্ঞান মন্ত্রনালয় ঘুরে প্রাদেশিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিবেদন শেষে আবার চ্যান্সেলার অফিসে ফিরে যেতে সময় লেগেছে মাত্র ৪৯ দিন। তার মধ্যে ক্রিস্টমাস-নিউয়ীয়ারের বন্ধ গেছে ১০-১৫ দিন।সাকুল্যে আনুমানিক এক মাস।তাও আবার কোন তদবির ছাড়া এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমহীন কাগজের চিঠি আদান প্রদানের যুগে, ভাবা যায়?
সেই ও দেশ, আর আমাদেরও এই দেশ!
বস, সেই দেশের মানুষও মানুষ আর এইদেশের মানুষও ব্যবসায়ী। :((
কি আর করবো আমরা??? এইদেশের মানুষ হয়তো পা...পথে বায়ু নির্গমনেও টাকা চাইবে কদিন পরে। কে জানে এখনই চায় কিনা!!!!!
বেড়ে বলেছ ভায়া, " ফেল কড়ি, মাখ তেল"...। (অট্টহাসি) :))
Smile n live, help let others do!
মজা পেয়েছি। :clap:
কিন্তু ভাইয়া, এরপর কি হল?
এর পর ? ওদের রাষ্ট্র প্রধানও অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে না চ্যন্সেলার অফিস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কে অনুরোধ পাঠালো পরিবর্তিত বিষয়ভিত্তিক স্কলারশিপ দেয়া যায় কিনা দেখার জন্যে।
বিশ্ববিদ্যালয় কখনো দিবে না বলেনি, শুধু 'সিন্ডিকেট মিটিং' পর এপ্রুভ হবে বলেছিলেন। আর 'সিন্ডিকেট মিটিং' আমার ভিসা শেষ হওয়ার এক/দের মাস পরে। মূল সমস্যাতো ছিল এটাই!!!
মিন টাইম ' দেশ থেকে তো অফিসিয়ালি টাকা আনা যাবে না, কিন্তু কাগজ তো আনা যাবে।
বাবাকে দিয়ে স্ট্যাম্প পেপারে 'নোটারি' করে স্পন্সারশিপের কাগজ বানিয়ে জমা দিলাম।কাজ হয়ে গেল।
জার্মানিতে একটা Joke প্রচলিত আছেঃ ডাক্তার বা উকিলের কাছ থেকে 'নিজের " Death Certificate" নিজ হাতে জমা দিলেও নাকি আমলারা বিশ্বাস করে গ্রহন করবে! LOL!!
Smile n live, help let others do!
ভালো লাগলো আজিজ ভাই।
পশ্চিমে বা ইউরোপে এটা সম্ভব জবাব্দিহিতা আছে বলে।
আরো একটা কথা কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলায় না।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ