দিনটা ছিল শুক্রবার ।
সারা দিন টানা ক্লাশ ছিল। দুপুরে খাবার ও সময় মিলেনি। পেটে ইঁদুরের দৌড়োনি।হোস্টেলে এসে ভাত রেধে খাবো ভেবেই ভাল লাগছে।পিটার হিলি ওয়েগ-১৩, স্টুডেন্টস হোস্টেল, ১০০৮ নম্বর রুম। ‘এক’ নিচের তলা নির্দেশক।ইন্টারনেশনাল উইং। পার্টিকোতে থরে থরে সাজানো লেটার বক্স থেকে নিজের টাতে হাত দিয়ে একটা কার্ড পেলাম। একটা ‘প্যেকেট’ ডেলিভারি নোটিস।বাংলাদেশ থেকে এসছে। বিকাল পাঁচটার মধ্যে ‘ হোপ্ট পোস্ট আম্ট ‘ (Head Post Office) থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
সময় বিকাল সাড়ে চারটা । তাড়াহুড়া করে গেলে হয়ত পোস্ট অফিস খোলা পাওয়াও যেতে পারে। এক লাফে গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। দশ মিনিট বাকি থাকতেই পৌঁছে গেলাম । ডেলিভারি নোটিস আর আই ডি দিতেই ভেতর থেকে সাদা মার্কিন কাপড়ে প্যাক করা, বাবার হাতের ঠিকানা লিখা প্যেকেটা টা এনে দিলো।
‘ফিলেন ডাঙ্ক, ডাঙ্কে সুন’ সহ সমস্ত ভদ্রতা শেষে গাড়ীতে উঠেই প্যেকেটা ছিঁড়তে লাগলাম।
ভেতর থেকে রঙিন কারু কাজ করা পাতলা পাঞ্জাবি, পাটের টেবিল ম্যাট, ছিকে ও আমার অর্ডারি হস্ত শিল্পের অন্যান্য সামগ্রির সাথে ছোট্ট একটা ‘ ডানোর কৌটায়’ মহামূল্যবান জিনিস বেরলো !
আমাদের ঢাকার গ্রামে ” কাটা পিঠা ” নামে পরিচিত। অর্ধ চন্দ্র (ক্রিসেন্ট) আকৃতির চালের গুঁড়ির আটায় বানানো তেলে ভাজা মচ মচে পিঠা। ভিতরে নারিকেল-গুড়ের পুলি ঠাঁসা।অনেকটা ‘মুখশালা’ পিঠার মত, কিন্তু মচ মচে ভাজা আর নারকেল পুলির জন্যে ভাল থাকে বহু দিন।
এর চেয়ে আরো মুল্যবান কিছু আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
বাদামি একটা খামে মা, বাবা, বোনদের চিঠি। সাথে মহামূল্যবান একটি ‘ ক্যেসেট ‘। এক পীঠে সকলের কথা টেপ করা।বাবা ছাড়া। অন্য পিঠে বাংলা গান।
আশির দশকের প্রেক্ষিতে, যখন মোবাইল-ই মেইল তো দুরের কথা, বছরে একবার ‘ ল্যান্ড ফোনে’ লং ডিসট্যান্স কল বাংলাদেশে কানেকশান পাওয়াই দুষ্কর ছিল, চিঠিই যখন একমাত্র ভরসা, তখন অতি দূর দেশে মা’র কণ্ঠস্বরতো দ্বৈব বানীর মত! গাড়ির রেকর্ডারে কেস্যেটটা ঢুকাতেই ভেসে আসলো মা’এর গলার আওয়াজ।
আজিজ……… আ…জি….জ…. বাবা…, মা’র কান্না ভরা রুদ্র কণ্ঠস্বর আমাকে হ্যাঁচকা টানে মর্তে নামিয়ে আনলো ।হটাৎ পৃথিবীটা ফাকা মনে হলো।সেদিনের টি ভিতে দেখা আমি যেন সেই লাইফ লাইন ছিঁড়ে যাওয়া দুর্ঘটনাকবলিত রাশিয়ান ‘ সুয়েজের এস্ঢ্রনট্ ‘ । একা মহাশুন্যের অন্ধকারের অতলান্তে হারিয়ে যাচ্ছি!
নেশা আমাকে কখনো আকর্ষণ করেনি। তাই প্রয়োজনও অনুভব করিনি তেমন। কিন্তু তখন প্রতিটি রক্ত কণা দেশের জন্যে, মা’এর কাছে ফিরার জন্যে নিজের ভেতরে বিদ্রোহ করে বসলো।
” Tackt” ডিসকোটেক্ট টা একিই পার্কিং ইয়ার্ডের অপর দিকে। ওরা সবে ধুয়ে মুছে শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্টুডেন্ট ডিসকো হিসাবে আসা যাওয়া থাকলে ও বার টেন্ডার মোটকু আমাকে কখনই হার্ড ড্রিঙ্কস গেলাতে পারেনি।
আজ গাড়িতে বসেই ওকে কিছু একটা নিয়ে এসে আমার সাথে সামিল হওয়ার জন্যে অনুরোধ করলাম।
তারপর আর কিছু মনে নেই। ঘুম যখন ভাঙল, তখন শনিবার সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পুরোপুরি চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।
এরপর কেটে গেছে কত বছর…, কত শত মাইল একাকি অটোবানের ( হাই ওয়ে’র) একমাত্র সাথি হয়েছে ” নাই টেলিফোন, নাই রে পিয়ন ” বা “পাপিয়ারে পাপিয়া, দোজনে মিলিয়া আয় না মিতালি করি…।” সেই বাংলা গানের ক্যেসেট টা!
সাথে মা’র কণ্ঠ ” আজিজ”… কেমন আছিস বাবা? ।।
দুই হাজার সালের সেই দিনটা থেকে আর “আজিজ” ডাকটি শুনতে পাইনা। ক্যাসেট টিও কোথায়ও আর খুজে পাইনি আর।
“মা দিবস” গুলি কেন যে প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসে,
ধ্যেৎ !
আজিজ ভাই অসাধারন :boss: :boss: :boss:
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
ক্যস্পার সাহেব, আপনাকেও ধন্যবাদ। (কষ্ট করে পরার জন্যে )
Smile n live, help let others do!
মাঝে মাঝে হ্যাঁচকা টানে এমন একেকটা দাগ এঁকে দেন বুকের ভেতরে!
মায়ের কাছে ছুটে যাবার ইচ্ছেটা বেয়াড়া হয়ে উঠলো যে।
কাজে আর মন বসছেনা।সিকরেট-ও তো ছেড়ে দিয়েছি, কি করি বলুন তো!
নুপুর, তোমরাতো অনেক সৌভাগ্যবান। ইচ্ছা হলেই বোতাম টিপে, যখন তখন মা'র সাথে, বাবার সাথে কথা বলতে পার। "স্কাইপ" এ রিয়াল টাইম ছবি সহ বিনে পয়সায় আলাপ করতে পার। আমাদের সেই সব দুঃখের দিনগুলি! হায়, চাটগা লাইন বুক করে ৪৮ ঘণ্টায়ও সংযোগ দিতে পারেনি, এমন দিন বহু আছে। আর লাইন পেলেও 'Top of the voice' এ কিছুক্ষন Hello, Hello চিৎকার করেই, ওপাশের আবছা মা'র গলা শুনে কি যে খুশি লাগতো ! কথা বলতে পারিনি তাই কি হয়েছে?
তোমাদের বিদেশ যাপন অনেক সুখময় হোক। হা, মা'র সাথে দেখা করতে অতি অবশ্যই সময় সুযোগ করে চলে এসো! আর এই অভাগা ছেলের তরফ থেকেও একটা প্রণাম দিও।
Smile n live, help let others do!
:boss:
tameema
তামিমা, তোমাকেও অনেক শুভেচ্ছা !
Smile n live, help let others do!
:boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss:
খেয়া (২০০৬-২০১১)
খেয়া,
তোমার এত বেশি ভাল লেগেছে? আসলে আমতো লিখক না, সত্যিকে সহজ ভাষায় কোনরকম প্রকাশ করি। বোন তোমাকেও অভিনন্দন।
Smile n live, help let others do!
অনেক সুন্দর হয়েছে। চালিয়ে যান।
Saleh
ধন্যবাদ সালেহ। আবেগতারিত হয়ে যখন মন চায়, লিখি।
Smile n live, help let others do!
এরকম সুন্দর আর আবেগের লেখায় মন্তব্য করাটা খুব কঠিন 🙁
:hatsoff: ভাইয়া
সুষমা, মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই, তুমি আমার মা'র পরকালের সুখের জন্যে দোয়া করো। সাথে এই ভাইটার জন্যও!
Smile n live, help let others do!
আজ মাঝে মাঝেই মায়ের জন্য হাউ মাউ করে কাদতে ইচ্ছে করে। এছাড়া কোন কিছু মন্তব্য হিসেবে লেখার নেই।
রিদওয়ান,
কাঁদতে অবশ্যই মন চায়, কিন্তু জীবনটা গড়ার জন্যে মনকে অনেক শক্ত করতে হয়। বিশেষ করে পুরুষ মানুষকে। অনেক সুন্দর এবং দৃঢ় একটা মন গড়ে ,মাথা উঁচু করে চল। আল্লাহ তোমার সহায় হউন!
Smile n live, help let others do!
হৃদয় ছুয়ে গেল, ভাইয়া। এখন আসলেই ইন্টারনেট, স্কাইপ, মোবাইল ছাড়া জীবন চিন্তাও করতে পারি না। কিন্তু এসব বাদেও আমাদের অগ্রজরা জীবন পার করে গেছেন, ভাবতে অবাক লাগে।
সন্ধি,
"জীবন যখন যেমন"! আজ আমাদের ছেলেরা ইউরোপ যাওয়ার পথে, দোবাই এয়ার পোর্ট থেকে মেইল করে আবার হিথরো নেমেই ফোন, বাবা পৌঁছেছি।
আর এই মাঝ খানের ৬~১০ ঘণ্টা কি কষ্টেই না কাটে!
আমরা সেই যে আল্লাহ ভরসা করে বাড়ি থেকে বেরুতাম, ৪/৫ দিন পর হয়তো ওঁরা টেলিগ্রাম পেতেন "Reached safe"!
আমাদের মা-বাবাদের কে সত্যি শত কোটি প্রনাম।
ভাল থেকো।
Smile n live, help let others do!
brilliant work! u inspire me dad 🙂 :boss:
বাবা,
তুমি আমার স্বপ্ন। দোয়া করি তুমি আরো অনেক ভাল লিখ।
ভাল থেকো- পাপা।
Smile n live, help let others do!