কার্জনের কাব্য – ১

কার্জন হল জায়গাটা অদ্ভূদ। এবং মায়াময়। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত্রি – যখনই হোক, চারপাশে স্নিগ্ধ নির্জনতা ঘিরে থাকে সবসময়। ভালোবাসা ব্যাপারটা নাকি আবার নির্জন জায়গায় ভালোভাবে প্রকাশিত হয় – কবি বলে গেছেন। এটা অবশ্য কবি না বলে গেলেও সমস্যা ছিলোনা। কার্জনে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক চোখ বুলালেই বোঝা যায় ব্যাপারটা। প্রথম বুঝেছিলাম যখন আইইউটি থেকে কোন এক পহেলা বৈশাখে প্রথমবারের মত ঘুরতে এসেছিলাম এখানে। আর এখন তো নিয়মিতই যাওয়া হয়। বোঝাবুঝি বহুআগেই শেষ, এখন উপভোগ করি ব্যাপারটা। তবে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে দাঁড়ালে সাধারণত দুই শ্রেণীর পোলাপান দেখা যায়। প্রথম শ্রেণীতে আছে ডিপার্টমেন্টের পাশের পরীক্ষা হল থেকে মাত্র পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়া ছেলেপিলে। পরীক্ষার উত্তরপত্রে কী দিলো, আর কী দিলোনা এইসব জাগতিক বিষয় নিয়ে তারা একটু অস্থির চোখমুখ করে কিচির মিচির করে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীতে যারা আছে তারা প্রথম শ্রেণীর ধার ধারেনা। তারা জোড়ায় জোড়ায় নিজেদের নিয়ে মগ্ন থাকে। এত বেশি মগ্ন থাকে যে দুনিয়াতে তারা ছাড়া আদৌ অন্য কোন শ্রেণীর মানুষ আছে কীনা সেটা নিয়েই নিজেদের মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে বোধহয়। কার্জনে অবশ্য জোড় সংখ্যারই জয় জয়কার। তারাই সংখ্যাগুরু, এক শব্দটির কোন পাত্তা এখানে নেই। করিডোরগুলোর নির্জনতাটুকু বেশিরভাগ সময়েই দখলে থাকে এইসব জোড়া জোড়া কাপলদের। এমনকি যাদের এখনো কোন গতি হয়নাই তাদের দুই প্রতিনিধি সানি ভাই এবং জামানকেও দেখা যায় একসাথে ঘোরাঘুরি করছে। তারা ল্যাবে বসেও পাশাপাশি। সানি ভাই এমনিতে খুব ভালোমানুষ, তবে দুষ্টু লোকজন তাকে নিয়ে ছেলে সংক্রান্ত বিষয়ে দুষ্টু কথা বলে থাকে মাঝে মাঝে। কিংবা আমিন ভাই আর জামানের কথাই বা বলি না কেন। জামান হচ্ছে আমাদের ল্যাবের ওয়ার্কিং ক্লাস স্টুডেন্টের জ্বলজ্ব্যান্ত প্রতিচ্ছবি। সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত বেচারা খেটেই যায় তো খেটেই যায়, আর ওদিকে ভূমিজমিদারদের প্রতিভূ প্রবল পরাক্রমশালী আমিন ভাই। এত খেটেও বেচারা জামান আমিন ভাইয়ের মন ভরাতে পারেনা। জামানের কর্মব্যস্ত এবং অবসর সময় কাটে আমিন ভাইয়ের ঝাড়ি শুনে শুনে। কাজেই বলতেই পারি যে – শুধু ভালোবাসা না, ঝাড়ি দেয়া কিংবা খাওয়ার ব্যাপারও এখানে ঘটে জোড়ায় জোড়ায়।

পশুপাখিরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন। ঘাড় ঘুরিয়ে, চোখ দুটো কুঁচকে আশেপাশের ইলেক্ট্রিক খাম্বার তারে তাকালেও বেশির ভাগ সময় জোড়া কাক, কিংবা জোড়া শালিকই বেশি পড়ে চোখে। এর মধ্যে আবার আমাদের ডিপার্টমেন্টে সম্প্রতি দুই বেড়াল ছানার উদ্ভব হয়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। তারা একসাথে মিউ মিউ করে, একসাথে আমাদের পায়ের কাছে এসে ঘুরঘুর করে, হুট করে যখন তখন ল্যাবের ভিতরে ঢুকে যায়, আবার কারো ধমক খেয়ে একসাথে ছোট্ট তুলতুলে লেজ উঁচিয়ে পালায়। অলস দুপুরে, কিংবা পড়ন্ত বিকেলে এদের প্রিয় কাজ হচ্ছে চোখ দুটো ৯৫% বন্ধ করে একসাথে পাশাপাশি কোথাও আয়েশ করে বসে ঝিমানো। এদের আদুরে হাবভাব দেখে কার্জনের অনেক যুগল প্রেম ভালোবাসা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রেখে এদের দিকে মনোযোগ দেয়। সেদিন দেখি এক কপোতী দূর থেকে এদের দেখতে পেয়ে “আল্লাহ কী কিউট” বলে দৌড়ে ছুটে এসে সাদা বিড়ালটাকে (রেস্ট ইন পীস, মাদীবা) বুকের কাছে তুলে নিলো। আমি একটু দূরে দাড়িয়ে থেকে সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। কখন যেন একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস হুট করে আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। দুই সেকেন্ডের জন্য মনে হলো মানবজন্মের থেকে বিড়াল জন্মই বেশি সৌভাগ্যময়।

বিএমপিটি বিড়াল যুগল - ১

বিএমপিটি বিড়াল যুগল – ১


বিএমপিটি বিড়ালযুগল - ২

বিএমপিটি বিড়ালযুগল – ২

বিড়াল কাহিনি আজকের মত আপাতত এটুকুই। কিন্তু ইদানিং ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে একটা কুকুরও ঘোরোঘুরি করে, একা। কী মুশকিল। কার্জন হলের কুকুর, একা কেন থাকবে? শুকনো, মোটা, লম্বা, খাটো যাই হোক, একটা সঙ্গী তো অবশ্যি লাগবে। ভেবে রাতে আমার ঘুম হয়না। স্বপ্নে দেখি কুকুরটা মদের পেয়ালা দুই ঠ্যাংয়ে ধরে ডিপার্টমেন্টের সিঁড়িতে চিত হয়ে শুয়ে খাচ্ছে আর হাপুশ হুপুশ করে কাঁদছে। এই দু:স্বপ্ন দেখে আমার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। আর কিছুতেই ঘুম আসেনা। শেষমেষ ল্যাপটপ খুলে মন ভালো করার গান দিলাম, যদি তাতে কোন কাজ হয়। গত কয়েকদিন আগে একটা গান পেয়েছি, যেটা শুনলে দশসেকেন্ডের মাথায় মন খারাপ ব্যাধির বিরুদ্ধে একদম টনিকের মত কাজ করে। আমি সেই গান ছেড়ে দিয়ে ফেসবুকের হোমফীডে মনযোগ দিলাম।

স্ক্রুল করে নিচের দিকে যেতে যেতেই হঠাৎ একটা ছবি দেখে আমার দুচোখ ছানাবড়া। এও কি সম্ভব! সেই একটা ছবি দেখেই আমার নি:সঙ্গ কুকুরটি নিয়ে সকল চিন্তা দূর হয়ে গেলো। কারণ ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে তার সঙ্গীকে পেয়ে গেছে। কার্জন হলের জোড়া ক্লাবে কুকুরটিও এখন মোস্ট ওয়েলকাম। কখন যে আবেগে দুই ফোঁটা জল দুই চোখের কোণায় এসে জমেছে টেরও পাইনি। শহীদ রুমী স্কোয়াডের সমন্বয়ক, সাদাত হাসান নিলয়, আমাদের ডিপার্টমেন্ট ছাড়া বাকি সকল জায়গাতেই যার প্রচন্ড দাপট, সেই মহান বাম নেতা আমার দু:স্বপ্নের স্থায়ী সমাধাণ ঘটিয়ে দিয়েছেন। আমি বিড় বিড় করে আওড়াতে লাগলাম – গড ইজ কাইন্ড, ভেরি ভেরি কাইন্ড।

তারপর সে রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হলো।

বিএমপিটির সর্বশেষ যুগল

বিএমপিটির সর্বশেষ যুগল

[সর্বশেষ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডেও দুইজোড়া পা, জাস্ট ইন কেস ইউ ডোন্ট নোটিস দ্যাট]

১০ টি মন্তব্য : “কার্জনের কাব্য – ১”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    প্রথম...

    সহজ সরল স্টাইলে বলা "কাব্য" ভাল লাগলো খুব।

    সর্বত্র সাদার জয় জয়কার-

    সেদিন দেখি এক কপোতী দূর থেকে এদের দেখতে পেয়ে “আল্লাহ কী কিউট” বলে দৌড়ে ছুটে এসে সাদা বিড়ালটাকে (রেস্ট ইন পীস, মাদীবা) বুকের কাছে তুলে নিলো।

    তারেক জিয়ার গানটা ডাউনলোড করলাম। শুনতে হবে অনেক বার...... 😛 😀


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)
      ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 🙁
      আমার কাছে আফসোস শব্দের সমার্থক। ভার্সিটি লাইফ টা কেমন একটু চেখেও দেখতে পারলাম না।

      এই আফসোস কাটাইতে জীবনের বহু সন্ধা, রাত কেটেছে শাহবাগ থেকে বকশীবাজার মোড় হয়ে, পলাশী ছাড়িয়ে, ফুলার রোড, টিএসসি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর প্রান্ত থেকে প্রান্তে! 🙁

      স্বপ্ন দেখতাম রোকেয়া হলের একটি মেয়ের সাথে প্রেম করব। জিহাদের মত বিড়বিড় করে বলতে চাই

      গড ইজ কাইন্ড, ভেরি ভেরি কাইন্ড।

      😡

      জিহাদ কোপ লেখার পরবর্তী অংশের জন্য বসলাম! :thumbup:


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    নেতা তারেক রহমান
    মহান তারেক রহমান।

    জোশ গান।
    ইনশাল্লাহ তারেক ভাইয়া দেশের কান্ডারি হিসাবে আবির্ভুত হবেন অনতি বিলম্বে।

    নেতা আসবেই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
      জানি তুমি আসবে জাতির ক্রান্তিলগ্নে
      চড়ে সাদা বিএমডব্লু গাড়ি।

      তোমার আগমনে হাওয়া ভবনে
      বইবে না আর রিক্ততার হাওয়া।
      তোমার আগমনে দিশেহারা জাতি
      খুঁজে পাবে ভালোবাসার ছোঁয়া।

      (চরণ মিলাইতে গিয়া শেষের লাইনটা দুষ্টু হয়ে গেল!) :shy:


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  3. রাব্বী (৯২-৯৮)

    হাহা! মজা হইছে লেখাটা জিহাদ।
    তোদের ডিপার্টমেন্টের সামনের ক্যান্টিনটায় মাঝে মাঝে যাইতাম! পুকুড়পাড়টা একটা দারুণ জায়গা। কার্জন হলটাই অপূর্ব!


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।