আব্বা যখন তাঁর চার মাসের গৃহত্যাগের মহাপরিকল্পনা বিষয়ক প্রকল্পের খসড়া অনুমোদনের জন্য হল্যান্ডে ফোন করলেন, আমি তখন ট্রেনে। ট্রেন তার দুরন্ত গতি নিয়ে শব্দের ঝড় তোলে। সে ঝড়ে সাত হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসা পিতার গলার আওয়াজ খুব একটা জোরালো নয়। আমি শুধু বুঝতে পারলাম যে, পিতা ঘর ছাড়বেন। বাংলাদেশের কোন প্রান্তে তিনি দাওয়াতী কাজে যাবেন, সেটা যদিও’বা এখনও নিশ্চিত নয়, তবে আগামী চারমাস যে তিনি ঘরে নেই- এটা নিশ্চিত। দেশে- বিদেশে পুত্রের এলোমেলো জীবন- যাপনে যেহেতু পিতার কখনো ‘না’ আসেনি। তাই পুত্রেরও পিতার গৃহত্যাগে ‘না’ বলাটা হয়তো অধিকার বহির্ভূত। আমি শুধু বললাম, নিজের খেয়াল নিয়েন। আর অবশ্যই ব্যাগভর্তি করে আপনার যাবতীয় ওষুধ সাথে নিয়েন। সুযোগ হলে আম্মাকেও সাথে নেন। আপনার তাবলীগ জামাতে স্ত্রী সাথে নেওয়ার কি নিয়ম আছে? আপনি মসজিদে থাকলেন, আম্মা বাইরে কোথাও। আম্মা মসজিদের বাইরে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা একবার আপনার সাথে এসে দেখা করে গেলো!
আব্বা কিছু না বলেই ফোন রেখে দেন। ফোন রাখার ধরণে বোঝা গেল, চারমাস গৃহত্যাগ প্রকল্প আব্বার খুবই সিরিয়াস প্রোজেক্ট। সেখানে বালখিল্য ধরণের কোন উপদেশ গ্রহণ করার সুযোগ নাই। খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। চিন্তায় পড়ে গেলাম এই কারণে যে, আব্বা যখন কোন কিছু নিয়ে সিরিয়াস হন, আমরা বিপদে পড়ে যাই। চিন্তায় পড়ে যাই, কারণ এখন পর্যন্ত আব্বার কোন সিরিয়াস প্রোজেক্ট শেষ পর্যন্ত আশার আলো দেখেনি। প্রতিবার এ ধরণের ঘটনার পর হৃদয়ভাঙা দুঃখ নিয়ে আমাদের বাবা কয়েকটা দিন কাটান। কিছুদিন পর সবকিছু ভুলে যান। এরপর আবার নতুন করে সিরিয়াস হন। আব্বা যতদিন সিরিয়াস না হন, ততদিন পর্যন্ত বাড়িভর্তি শুধু সুখ আর সুখ। তিনি তাঁর রিটায়ার্মেন্টের পর এক জীবনে যত সমগ্র নতুন ব্যবসা বিষয়ক ব্যাপার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন, সেসবে অর্থ অপচয় যতটা না হয়েছে, পারিবারিক শান্তি উঠে গিয়েছে চুড়ান্ত আসমানে। ক্ষেত্রবিশেষে তারও উপরে। তাই তিনি যেকোন নতুন ব্যবসায় লস খাওয়া শুরু করলে আমাদের মুখে হাসি ফুটতো। একদম নিঃস্ব হবার কাছাকাছি চলে গেলে আমাদের জয়পুরহাটের বাসার দোতালার ঘরগুলোতে শান্তির চূড়ান্ত অবস্থা বিরাজমান হয়। আমরা এখন নিশ্চিন্ত হতে পারি যে, আমাদের বোকা বাবা এবার বুঝি ঘরে ফিরবেন।
এ যাবতকাল পর্যন্ত আব্বা যতগুলো মহা মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন সেসবের মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যটি ছিল যে, তিনি গ্রামে একটা মসজিদ বানাবেন। ছোট মিনি সাইজ পাঞ্জেগানা মসজিদ নয়। এ মসজিদ হবে সুবিশাল। মসজিদ বানাতে প্রভূত পরিমাণ অর্থের দরকার। এতো টাকা আসবে কই থেকে- সে ব্যাপারেও একটা সুরাহা চলে আসলো মুহূর্তেই। আব্বার কঠিন প্ল্যানিং, অভিনবত্বে ভরপুর। রাইসমিল হবে একটা, আমাদের গ্রামের প্রবেশ পথে, রেলের ব্রিজটার দোরগোড়ায়। গ্রামের লোকেরা সারাদিন সে রাইসমিলে ধান ভাঙাবে। ১০ টাকা প্রতিবস্তা রেট। টাকা আসবে পানির মত। আর মসজিদের কাজ চলবে রকেটের মত।
আব্বার দেখানো চোখে আমরা সে স্বপ্নের মসজিদ দেখলাম। মাত্র এক বছরের মধ্যে মসজিদ তৈরি হয়ে যাবে। দোতলা মসজিদ, টাইলস করা। রেললাইনের উপর দাঁড়ালে, নিভৃত পল্লীর বুকে ধবধবে সাদা রং এর আশ্চর্য সুন্দর এক স্থাপত্য দেখা যায়। অদ্ভুত মায়াকাড়া সে স্থাপত্যের পাশে দাদার কবর, আমার মেজো চাচার কবর। বহুদূর থেকে সে মসজিদ চোখে পড়ে। মসজিদের পাশ দিয়ে তুলসীগঙ্গা নামের ছোট নদীটি দিনভর তাঁর মমতার নিরন্তর পরশ বুলিয়ে হাতের বাম দিকে গিয়ে বাঁকে। ডান দিকে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। যে অনিন্দ্য সুন্দর নিরবিচ্ছিন্ন সবুজে চোখ জ্বালা করে, এমন এক সবুজের মাঝে সাদা রং এর আমার বাবার স্বপ্নের মসজিদ।
আব্বার মসজিদের প্ল্যান বাসায় তোলা মাত্র বাসায় চুলা বন্ধ হল। আম্মা মতামত দিলেন, ওপেন হার্ট সার্জারি করার পর আব্বার ওষুধ বেশী খাওয়া পড়েছে। এটা ওষুধের সাইড ইফেক্ট। আব্বা পুরোপুরি বেলাইন হওয়ার আগে ঘরে তালা বন্ধ করে, চাবি আঁচলে বেঁধে রাখা প্রয়োজন। ছোটভাই আজন্ম বেয়াদপ। মুখের উপর সে বললো, নেহাত পাগল- ছাগল না হলে এ ধরণের উদ্ভট পরিকল্পনা প্রসব সম্ভব না। কারেণ্টের যুগে আব্বা দিতে চায়, ডিজেল চলে এমন রাইস মিল। মিল চালু হয়ে খুব বড়জোর ছয় ঘণ্টা চলবে। এরপর বন্ধ হবে, আব্বার প্রেসার বাড়বে। রোগী নিয়ে ঢাকা- রাজশাহী দৌড়াদৌড়ি।
আব্বা তাঁর কঠিনতম দুর্যোগের দিনে হল্যান্ডে ফোন করলেন। আমি শুধু বললাম, আব্বা এমন অদ্ভুত সুন্দর প্ল্যান আগে কখনো শুনেছি বলে- মনে পড়ে না। বন্ধু আজহারকে দিয়ে মসজিদের ডিজাইন পাঠাচ্ছি আমি সামনের সপ্তাহে। আপনি কাজ শুরু করেন। দেরী করার কোন মানেই হয় না। আগামী শুক্রবার মসজিদের ভীত ঢালাই করে ফেলেন। বাসার কারও কথা শোনারই দরকার নাই। এদের সবার মাথায় বুদ্ধি জোড়া দিলেও আপনার পায়ের কাছে আসবে না।
মসজিদের কাজ শুরু হল। রাইসমিল চালু হল। মিলের জন্য ধানখেতের মাঝে দুর্গের মত দোচালা টিনের ঘর উঠলো। গ্রামজুড়ে দারুণ সাড়ম্বর আয়োজন। উৎসাহী গ্রামবাসী তুমুল মজা পেয়ে গেলো। জিলাপী বিলিয়ে বিরাট মিলাদ হল। পেটভরে মিলাদের জিলাপি খেয়ে গ্রামের লোকেরা যে যার বাড়ি ফিরলো। আর যাবতীয় সাড়ম্বর এবং এ সম্পর্কিত তাবৎ উত্তেজনা নিভে আসলে চালু হল- আব্বার পাইলট প্রোজেক্টের ডিজেল চালিত স্বপ্নের রাইসমিল। সে মিল কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারঘণ্টা চললো। ছোটভাই বলেছিল ছয় ঘণ্টা চলবে, ছয় ঘণ্টা শেষ হবার দেড় ঘণ্টা আগেই রাইসমিল ঘর ঘর আওয়াজ তুলে বন্ধ হল। ডিজেল শেষ। শহর থেকে এতোদূর কষ্ট করে ডিজেল কিনে এনে রাইসমিল চালানো- সে তো বড় খরচান্ত কাজ।
আব্বা তাঁর ভয়াবহতম দুর্যোগকালীন মুহূর্তে ফোন করলো হল্যান্ডে। আমি আবার বললাম, আব্বা দেশে সিলেটের দিকে তেলের খনি পাওয়া গেছে। তেলের দাম কমে যাবে বছর খানেকের মধ্যে। এটা নিয়ে চিন্তার কোন মানেই হয় না। আপাতত যা আছে, সেভাবেই রেখে দেন। একদম নো টেনশন। আব্বা ফোন করেছিল, ফাল্গুনের শুরুর দিকে। সে বছর আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের কোন এক সকালে গ্রাম থেকে খবর আসলো, গত রাতের ঘোর বর্ষার আঁধারে যখন পুরো গ্রাম ডুবে ছিল, তখন কারা যেন মিলঘর থেকে মেশিন চুরি করেছে।
মেশিন চুরির মাঝ দিয়ে, আব্বার মসজিদ প্রকল্প শেষ হয়। শুধু সেই ঘরটা আধাভাঙা অবস্থায় পড়ে রইলো- আব্বার যাবতীয় স্বপ্নের মাঝে এক টুকরো বাস্তব হয়ে। রাজশাহীর দিকে ট্রেনে যাওয়ার পথে উড়ি ব্রিজের পর হাতের ডান দিকে ধানখেতের মাঝে আধাভাঙা ঘরটা একা দাঁড়িয়ে থাকে।
আমরা পিতা- পুত্র হয়তো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একই মুদ্রা নয় এই কারণে যে, আমার পিতার সবলতম দিকগুলো আমার পাওয়া হয়নি, তাঁর দুর্বলতম দিকসমূহ আমার চরিত্রে প্রকট। সৌভাগ্যবান সে সকল ছেলে’রা- যারা পিতার সবলতম গুণে পূর্ণ হয়। আর দুর্ভাগ্য তাঁদের, যারা বাবাদের দুর্বলতম দিকগুলোর মোহে পড়ে যায়। দ্বিতীয় দলে যারা, তাঁরা জীবন কাটায় নানাবিধ জাগতিক বিভ্রান্তি পায়ে পায়ে নিয়ে। আব্বার সাথে আমার মাঝে মাঝে বিভ্রান্তির বিনিময় হয়।
বিভ্রান্তির এক রাতে। শহরের নাম ইস্তানবুল। জানুয়ারির শেষের দিকে কোন এক শীতের রাত। ওল্ড টাউনের রাস্তায় পাতারা সব দলবেঁধে ঝরে পড়ে। আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে সোনালী আলোর লাইটপোস্ট থেকে মায়াবী সব আলোর সন্তানেরা শহরময় ইতস্তত ঘুরেফিরে বেড়ায়। মায়াবী আলোর নীচে যে শহর- তার বাতাসে জলো শীতের তীব্র আভাস। শীত ভেসে আসে বসফরাসের প্রাচীন বুক ছুঁয়ে। তবে সে রাতে তীব্র শীতে নয়, ঢাকা থেকে ইস্তানবুলের পূর্বাপর দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার ক্লান্তিকর যাত্রার কাছে সম্ভবত হেরে গিয়েছিলাম। ইস্তানবুল জুড়ে রাতভর হাঁটার পর ভোরের ঠিক আগে আগে সুলতান আহমেত মসজিদের খোলা দরজা দেখে, আমার প্রথমবার খেয়াল হল- পা জোড়া বোধহয় ভীষণ অবসন্ন। সুলতান আহমেত মসজিদ ধাপে ধাপে উপরে উঠে যায়। ভেতর মসজিদের ডানদিকের সুবিশাল গম্বুজ যেন এক টুকরো আকাশ। কারা যেন একে নীল মসজিদও বলে। মসজিদের স্থপতি সেদিফকার মেহমেত আগা- যে লোকটি গান গাওয়া শিখতে গিয়ে শেষে এসে স্থপতি হয়েছিল। কি জানি, সে তাঁর গানের ছাপ সে রেখে গেছে পুরো মসজিদ জুড়ে। খুব খেয়াল করে কান পাতলে দেয়ালের প্রতিটা ঘুলঘুলি জুড়ে বাতাসের শিষ কেটে সুক্ষ চলার শব্দ- যেন মারামারা উপসাগর থেকে ভেসে আসা কোন দৈব গান। নিরন্তর বহমান সে গানে কান পাতলে, চোখজুড়ে ঘুমেরা ভর করে।
বসফরাসের তীরে নীল মসজিদের মেঝেতে ভোররাতের সে ঘুমে সম্ভবত বহুদিন পর আব্বার সেই মসজিদকে আবার দেখতে পেলাম। সাদা রং এর দোতলা মসজিদ। হাতের ডান দিকে শিমূল গাছকে রাখলে দূর- দূরান্ত পর্যন্ত সামনে আর কিছু দেখা যায় না। নিভৃত পল্লীর বুকে ধবধবে সাদা রং এর আশ্চর্য সুন্দর এক স্থাপত্য! অদ্ভুত মায়াকাড়া সে স্থাপত্যের পাশে দাদার কবর, আমার মেজো চাচার কবর। মসজিদের পাশ দিয়ে তুলসীগঙ্গা নামের ছোট নদীটি দিনভর তাঁর মমতার নিরন্তর পরশ বুলিয়ে হাতের বামে গিয়ে বাঁকে। আর ডানদিকে আমাদের সেই সু প্রসস্থ রেলসড়কটি। ট্রেন চলেছে, কোন এক আন্তঃনগর ট্রেন হবে। ট্রেনের প্রবল গতি যেন চারপাশে ঝড় তোলে। ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো কষ্টকর। তবুও হাতল ধরে কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছি। বাতাসের প্রবল তোড়ে চোখ খুলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু চোখ খুলে রাখা ভীষণ প্রয়োজন। এইতো সামনের বাঁক পেরুলেই সাদা রং এর এক অদ্ভুত সুন্দর স্থাপত্য চোখে পড়বে। দিগন্তজোড়া ধানখেতের মাঝে ধবধবে সাদা রং এর আমার বাবার স্বপ্নের মসজিদ।
ট্রেন চলছে, প্রচণ্ড গতি নিয়ে। আর অল্প কিছুক্ষণ। আমি অধীর অপেক্ষায় চোখ খুলে রাখি।
ছোটবেলায় একাধিক আয়না দিয়ে বাড়ির বাইরের সূর্যের আলো ঘরে এনে দিগ্বিজয়ের আনন্দ পেতাম। সেসব স্মৃতি মনে পড়ে গেল... :dreamy:
বাংলাদেশের সীমান্তে হত্যা ট্যাবুর মতন। এটা নিয়ে কথা হয়, কিন্তু খুব হিসেব করে বা সাবধানে। সরকারের পক্ষ থেকেও আমরা জোরালো কোন বক্তব্য কখনো পাই না। মানুষের জীবন নিয়ে রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে রাজনীতি চলে তা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম পর্যায়ের... 🙁
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
সূর্যের সাহসী কিরণকে একজন বাবা মনে হওয়া! আর সেই বাবার তিনমাস বয়েসী আলোক সন্তানেরা, যারা মানবসন্তান হলে মার্বেল খেলে ধুলোময় হয়ে থাকতে চাইতো -- যারা হয়তো তামাবিল সীমান্ত পেরিয়ে সূর্যপিতার গুলিবিদ্ধ খুলির রক্তক্ষরণ রোধ করতে চাইতো তাদের আলমারীর ওই উঁচু শেলফে কেমন অসহায় বোধ হয় বুঝতে পারি।
সূর্যের সাহসী কিরণ বুকে পিঠে ধুলোর মতন মেখে সারা ঘরময় তারা নেচে বেড়াক, তারা মুক্তিলাভ করুক। হাতেম আলীর গুলিবিদ্ধ কবরে ঘাসফুল ফুটুক, আলোর ফুলঝুরি ঝরুক।