সুইজারল্যান্ড দেশটা একটু অদ্ভুত। জুরিখে নামলে সব জায়গায় দেখা যায় জার্মান ভাষা। মানুষ বলেও এই ভাষায়, দোকানে সাইনবোর্ডেও এই ভাষা। দক্ষিনে দাভোসের দিকে গেলে মানুষ বলে ইতালীর ভাষায়। আর যদি উল্টো দিকে জেনেভায় আসি সবাই বলে ফরাসী ভাষায়, দোকানের সাইনবোর্ড বা রাস্তার সাইনও তাই। কেউ যদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে চান তাহলে চলে যান জুরিখ কিংবা আরও দক্ষিণে। সে তুলনায় জেনেভা অনেক নিরস। অনেকটা ওয়াশিংটনের মতো। ওয়াশিংটনে অবশ্য দেখার মতো অনেক কিছু আছে, মিউজিয়াম তো বটেই, হোয়াইট হাউজ বা অনেকগুলো মনুমেন্টও আছে।
জেনেভায় আছে অসংখ্য সদর দপ্তর। জাতিসংঘের অনেকগুলো সংস্থার প্রধান কার্যালয় বা সদর দপ্তর এখানে। জেনেভা লেক ছাড়া এখানে দেখতে হলে এগুলোই দেখতে হয়। আগের বার জেনেভায় সেসবও দেখা হয়ে গেছে। আর আছে একটা ভাঙ্গা চেয়ার। জাতিসংঘের অফিস যে চত্বরে সেখানে দাঁড় করানো আছে এই ভাঙ্গা চেয়ার। মূলত এটি স্থল মাইন এবং কাস্টার বোমা বিরোধী একটি স্থাপনা। অল্প সময়ের জন্য এটি স্থাপন করা হয়েছিল, এখন সেটা স্থায়ী হয়ে আছে।
এর ঠিক পাশেই জেনেভার আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। এখানে হয়ে গেলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ৭ম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। এর একটু দূরেই ডব্লিউটিওর প্রধান কার্যালয়। বাসে উঠলে ঠিক পরের স্টপেজে। জেনেভা ছোট্ট জায়গা। পায়ে হেটেও নানা জায়গায় যাওয়া যায়। তার উপর হোটেলে থাকলে ঐ কয়দিনের জন্য বাস ও ট্রামের ফ্রি টিকেট দেয়। ফলে যাতায়তে মহা আরাম। আবার টিকেট আছে কিনা কেউ পরীক্ষা করে না। শুনতে পেলাম হঠাৎ হঠাৎ পরীক্ষা করতে নেমে যায়, ধরা পড়লে মোটা অংকের জরিমানা।
ডব্লিউটিওর প্রধান কার্যালয় এখন যে ভবনে সেটি এক সময় ছিল আইএলওর প্রধান অফিস। ২০০৮ সালে যখন এসেছিলাম আমি আর এনটিএনের মামুন তখন ডব্লিউটিওর উপ-মহাপরিচালক হর্ষবর্ধন সিং আমাদের এক ঘন্টা সময় দিয়েছিলেন। তাই এবার আর প্রধান কার্যালয়ের নীচ থেকে উপরে উঠা হয়নি। আবার সবাই ব্যস্ত ছিলেন সম্মেলন নিয়ে।
আতিথিয়তার এশীয়ানরাই ভাল। ২০০৫ সালে হয়েছিল মন্ত্রী পর্যায়ের ৬ষ্ঠ সম্মেলন। ব্যাপক আয়োজন ছিল। এয়ারপোর্টেই ছিল সম্মেলনে আগতদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। সেবার পুরো হংকং জুড়েই ছিল সম্মেলনের আবহাওয়া। এবার জেনেভায় নেমে তেমনটি টের পাওয়া গেল না। আসলে জেনেভায় এতো বেশি সম্মেলন হয় যে আলাদা করে কোনোটিই হয়তো চোখে পড়ে না। তবে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা ছিলেন এয়ারপোর্টে, আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিলেন। বিদেশ-বিভূইয়ে সেটাই বা কম কিসে।
সুইজারল্যান্ড অনেক ধনী দেশ। জীবন যাপনের মানের দিক থেকে জেনেভা ও জুরিখ বিশেষ ২য় ও ৩য় স্থানে। শহরটি ব্যয়বহুল। ১৫৮ ডলার দিয়ে যে হোটেলে উঠলাম সেটি তিন তারকা মানের। সেবার মানও তেমন ভালো না। সর্বত্রই ওয়াই ফাই কনেকশন পেলেও কোনো কিছুই ফ্রি না। অথচ হংকং-এ হোটেলে ইন্টারনেট ফ্রি পেয়েছিলাম। তবে চাইলে ১০ ফ্রায় পেট ভরে তার্কিস কাবাব খাওয়া যায়। সুস্বাদু, এমনই বড়, পেটও টুইটুম্বুর।
ডব্লিউটিও মূলত বেটন উডস সংস্থার মধ্যে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঠিক করতে মিত্র শক্তির ৪৪টি দেশ ১৯৪৪ সালে জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পসায়ারে ব্রেটন উডস-এর ওয়াশিংটন হোটেলে সম্মেলনে বসেছিল। সেখান থেকে জন্ম নেয় তিনটা সংস্থা। আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থাকে ঠিকঠাক রাখতে তৈরি হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ, ইউরোপকে পুনর্গঠনসহ অর্থায়ন ব্যবস্থা তৈরিতে ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হয় বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য তৈরি করার কথা বলা হয় ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন বা আইটিও। তবে যুক্তরাষ্ট্র মেনে না নাওয়ায় সেই আইটিও আর কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এর পরিবর্তে শুরু হয় গ্যাট (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ) আলোচনা। ১৯৪৮ থেকে এই আলোচনা শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৯৫ সালে ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
মূলত গ্যাটের ৮ম রাউন্ড আলোচনাই ডব্লিউটিওর মূল ভিত্তি। এই আলোচনাকে বলা হচ্ছে উরুগুয়ে রাউন্ড। এই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে ১৯৯৪ সালে মরোক্কোর মারাকাসে, মারাকাস চুক্তির মাধ্যমে। আর পরের বছর থেকেই শুরু হয়েছিল ডব্লিউটির পথ চলা।
মুখ রার জন্য ৭ম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হয়ে গেল জেনেভায়। আগেই কথা ছিল কোনো ঘোষণা থাকবে না। এমনকি পরবর্তী বৈঠক কোথায় ও কবে হবে তাও ঠিক করা যায়নি। তবে ২০১০ সালের মধ্যে দোহা আলোচনা শেষ করার একটা প্রতিশ্রুতি এসময় পাওয়া গেছে।
দর কষাকষির বৈঠক ছিল না বলে এবারে জেনেভায় তেমন কোনো উত্তেজনা ছিল না। দরকষাকষির বৈঠকের যে উত্তেজনা তা কোনো অংশেই একটি জমজমাট থ্রিলারের চেয়ে কম না। সেটা এবার পাওয়া গেল না। সবাই ছিল অনেকটা সফরের মুডে। বিক্ষোভও এবার ধারাবাহিকভাবে হয়নি। কেবল ২৮ নভেম্বর বিক্ষোভ মিছিল চলার সময় জেনেভার রাস্তায় বেশ কিছু দামী গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। এর বাইরে সম্মেলনের তিন দিন সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে মৎস্য খাতের ভর্তুকি নিয়ে খানিকটা বিক্ষোভ করতে দেখেছি।
আর ডেলিগেট হিসেবে আসা কিছু এনজিও কর্মী সম্মেলন কেন্দ্রের মধ্যে পথ নাটক ও গানের মাধ্যমে খানিকটা বিক্ষোভ দেখানোর চেষ্টা করেছে।
এবার সুইজারল্যান্ডে সম্মেলনের বাইরে সফরের আর কিছু ছিলই না বলতে গেলে। সব আকর্ষন আমি জমিয়ে রেখেছিলাম প্যারিসের জন্য।
🙂
:clap:
সিরাম হইছে
কিনতু প্রেরণা ভাবীর লেখা পড়ে এখন মনটা ভারী
:hatsoff:
এশিয়ানদের অতিথেয়তা কিছুটা হইলেও শিখছে 😛
:clap:
চমৎকার ব্লগ মাসুম ভাই। ছবিসহ বর্ণনা- দারুণ! :thumbup:
দারুন লাগলো...চমৎকার বর্ণনা ও ছবি...
জেনেভার রাস্তায়ও গাড়ি ভাংচুর হয়!!!!!!!!!!!!!
গত পর্বটা একটু ফাঁকিবাজি ছিল, এবার একদম পোষায় গেছে! সাথে আছি।
পড়ছি শওকত ভাই। প্যারিসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই ফাঁকে সুইজারল্যান্ডও হয়ে গেল। ডব্লিউটিও নিয়েও কিছু জানলাম। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই সংস্থাগুলো (IMF, WTO, WB) কিভাবে ট্রিট করে তা নিয়েও জানার আগ্রহ থাকলো।