বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাস লিখতে হলে স্যার আলফ্রেড জোসেফ হিচককের নামটি চলে আসবে সবার আগে। খুব বেশি পুরস্কার তার ভাগ্যে জোটেনি, সমালোচকরাও শুরুতে তার প্রতি সদয় ছিলেন না। কিন্তু হিচকক এখন সবারই প্রিয় একজন পরিচালক।
রহস্য তাঁর তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর মূল সুর। বলা যায় রহস্য সিনেমা জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিচালক তিনি। বহু পরিচালক এখনো তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছেন। রোমান পোলানস্কির মতো পরিচালকও ফ্রান্টিক নামের একটি চলচ্চিত্র তৈরি করে হিচকককে অনুসরণের চেষ্টা করেছিলেন। তার অনুরসরণ করার তালিকায় আছে ব্রায়ান ডি পালমার মতো পরিচালকও।
হিচকক জন্মে§ছিলেন লন্ডনে, ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। মারা যান ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল। ১৯২২ সালে তিনি লন্ডনেই চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেছিলেন। ১৯৩৯ থেকে হিচকক হলিউডমুখী হন এবং ১৯৫৬ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব নেন। তার চলচ্চিত্র জীবন ছিল ৬ দশকের। নির্বাক যুগ থেকেই তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন আর সবাক যুগে হয়ে উঠেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব।
সেরা চলচ্চিত্রের তালিকা করতে হলে হিচকককে বাদ দিয়ে কোনো তালিকাই করা সম্ভব না। সম্প্রতি আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিউট সর্বকালের সেরা ১০০ ছবির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে স্থান পেয়েছে হিচককের চারটি ছবি। এর আগে টাইম ম্যাগাজিন, সাইট অ্যান্ড সাউন্ড কিংবা চ্যানেল ফোর সর্বকালের সেরা ছবির যে তালিকা করেছিল তাতেও হিচককের ছিল অনিবার্য উপস্থিতি।
হিচকক ৫৯টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে তার নির্বাক ছবির সংখ্যা ১১টি। ১৬টি ছবি তৈরি করেছেন লন্ডনে। বাকিগুলো পরিচালনা করেন হলিউডে। তার ভালছবিগুলো হলিউডেই তৈরি। হিচকক সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়েন ১৯৫০ দশকে এসে। ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ সমালোচকরা প্রথমে হিচককের কাজ নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। তারপরেই শুরু হয় হিচকক বন্দনা।
কিন্তু তার সেরা পাঁচটি ছবি কি কি? উত্তর দেওয়াটা সহজ নয়। তারপরেও তার যে পাঁচটি ছবি বিভিন্ন তালিকায় বার বার উঠে আসে সেগুলোর কথা বলা যেতে পারে। এই ৫টি একদমই ব্যক্তিগত পছন্দ।
১। সাইকো– এক মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনির গল্প। সেরা ছবির যে কোনো তালিকায় এটি থাকবেই। ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় সাইকো। এন্থনি পারকিনস ও জেনেট লেই ছবির মূল অভিনেতা-অভিনেত্রী। সাইকোর বিখ্যাত গোসলের দৃশ্য এখনও চলচ্চিত্র ছাত্রদের পাঠ্য বিষয়। কিভারে এর দৃশ্যায়ন হয়েছিল, দৃশ্যটি কিভাবে এতোটা আতঙ্কজনক ভাবে তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে এখনো বিতর্ক হয়। হিচককের ছেলে বেলা সুখের ছিল না। সামান্য অপরাধে তার মা তাকে নানা ধরণের শাস্তি দিতেন। মা-ছেলের এই সম্পর্ক অনেকটাই জুড়ে ছিল সাইকোতে।
২। ভার্টিগো– ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায়। একধরণের মাথা ঘুরানো রোগ। ছবির নায়ক জেমস স্টুয়ার্ট উচুঁতে উঠলে এই রোগ পেয়ে বসতো। ছবিতে আরো আছেন কিম নোভাক। ছবিটি প্রথমে সমালোচক বা দর্শকদের আনুকূল্য পায়নি। কিন্তু এখন এটিকে ধরা হয় সর্বকালের সেরা ছবির একটি হিসাবে। ১৯৮৩ সালে ছবিটিকে পুনরায় মুক্তি দেওয়া হলে সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল।
৩। রিয়ার উইন্ডো-জেমস স্টুয়ার্ট ও গ্রেস কেলি এই ছবির মূল দুই চরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রী। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায়। একজন ফটো সাংবাদিক পা ভেঙ্গে ঘরে বসে থাকেন আর ক্যামেরা দিয়ে চারদিকের ছবি তোলা বা গোয়েন্দাগিরি করার চেষ্টা করেন। এভাবেই এক খুনের আলামত পান জেমস স্টুয়ার্ট। বলা হয় রিয়ার উইন্ডো হিচককের সবচেয়ে থ্রিলিং মুভি। ছবিটির জন্য সেরা চরিচালকের মনোনয়ন পেয়েছিলেন হিচকক।
৪। নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট– হিচককের ছবির বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার ছবির নায়ক বা নায়িকারা সাধারণ মানুষ হিসাবেই থাকেন, কিন্তু তারাই পড়ে যার ভীতি ও রহস্যের মধ্যে। যেমন ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি। ক্যারি গ্রান্ট ছবির মূল অভিনেতা। ভুলে আরেক দেশের সিক্রেট এজেন্টরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপরেই ঘটতে থাকে একের পর এক রহস্যজনক ঘটনা।
৫। রেবেকা-হলিউডে হিচককের প্রথম ছবি। ১৯৪০ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটি সেরা ছবির অস্কার জিতে নেয়। এটিও একটি মনস্তাত্বিক থ্রিলার। উপন্যাস থেকে নেওয়া। স্যার লরেন্স অলিভিয়ের ও জন ফনটেইন মূল চরিত্রে ছিলেন।
হিচককের প্রতিটি ছবিই দেখা যায়। এই পাঁচটির বাইরেও তার লাইফবোট, স্পেলবাউন্ড, নটোরিয়াস, রোপ, স্ট্রেনজারস অন ও ট্রেইন, ডায়াল এম ফর মার্ডার, দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ, দি বার্ডস, টন কার্টিন কিংবা ফ্রেনজি-প্রতিটিই ঢুকতে পারে সে কারোরই প্রিয় ছবির তালিকায়। সবশেষে বলে রাখি, হিচকক প্রায় ছবিতেই নিজেকে রাখতেন। হয়তো দেখা যাবে রাস্তা দিয়ে হাটছেন হিচকক কিংবা ট্রেন থেকে নামছেন। তার ছবির এটিও একটা বড় আকর্ষন। যাকে বলা হয় হিচকক ক্যামিও। অনেক পরিচালকই এটা অনুসরণ করেণ। যেমন ভারতে সুভাস ঘাই।
লেখাটি প্রথম আলোতে প্রকাশিত। হিচককের প্রতি ভালবাসা থেকেই এখানে দিলাম।
২৯ টি মন্তব্য : “মুভি: হিচককের রহস্য জগতে স্বাগতম”
মন্তব্য করুন
😀
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
1st
Amar chesta ta ekke bare jol kore dilen diki akashda
আরে ব্যাপার না... আমরা আমরাই তো... বেটার লাক নেক্সট টাইম 🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
সেইটাই। কোনো ব্যাপার না। আমরা আমরাই তো
রিয়ার উইন্ডো ছোটবেলায় দেখছিলাম বিটিভির মুভি অব দ্যা উইকে... চরম লাগছিল... (আগে মুভি অব দ্যা উইকে কি ভাল ভাল সব মুভি দেখাইতো :dreamy: )
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আসলেই এক সময় মুভি অব দ্য উইকে অনেক ভাল ভাল ছবি দেখাতো। আমিও এই ছবিটা প্রথম দেখি বিটিভিতে । আর এখন বিটিভি ভাল কোনো ছবিই দেখায় না।
আমি মুভি দ্য উইকে একবার লরেন্স অব এরিবিয়া দেখছিলাম। এরকম ছবি এখন আর দেখায় না! :no: :no:
Akta Cameo boroi mojar silo. Kon ekta movie te bechara tram e uthte gia parena. Mukhta hoy dekhar moto. :p
মনে আঝছ্র দৃশ্যটা তুহিন।
শরীর কেমন?
হিচককের মুভির আর একটা দিক খুব ভালো লাগে। গল্প রহস্যের কিন্তু ডয়লগ থাকে অসম্ভব স্মার্ট আর ফানি..............
জয়তু হিচকক :boss: :boss: :boss: :boss:
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
পুরাই একমত। আমার ভীষণ পছন্দের।
৫টার মধ্যে ৫টাই আমার সাথে মিলছে। এটাই আমার হিচককের সেরা ৫। তবে 'রোপ' না রাখতে পেরে খুব মন খারাপ। তবে সেরা ১০ করলে 'রোপ' থাকবে অবশ্যই।
হিচককের প্রায় সবই দেখেছি, অদেখা কিছু পেলে এখনো সাথে সাথে দেখে ফেলি।
হিচকক এক অদ্ভুত প্রতিভা... উনাকে নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই... আমার ওর সব মুভিই প্রিয় ..
সাসপেন্স ও ফ্যান্টাসিতে হিচকক যেমন সেরা ভরা তেমনি রসবোধ এবং বিদ্রুপেও কম যায় না। ছবি বানানোয় তার টেকনিক ও সিনেমাটোগ্রাফি অন্য নির্রমাতাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভার্টিগো ছবিতে তিনি যে ক্যামেরা টেকনিক ব্যবহার করেছেন পরবর্তী সময়ে বহু চলচ্চিত্রকাররা সেটি অনুসরণ করেছেন, যেটাকে ‘হিচকক জুম’ নাম দেয়া হয়েছে পরে।
দু:খ একটাই, সেরা পরিচালক হিসেবে কখনই একাডেমি পুরস্কার পাননি। রেবেকা, সাইকো, রিয়ার উইন্ডো, স্পেলবাউন্ড, লাইফবোট'র জন্য পাঁচবার সেরা পরিচালক নমিনি হয়েছিলেন।
মাসুম ভাইয়ের সিনেমা নিয়ে লেখা, সব সময়ের মতই সুন্দর।
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
হিচককে মূল্যায়ন না করায় হিচককের কিছুই হয়নি, অস্কারের গ্রহণযোগ্যতা আরো একবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যেমন পড়েছিল স্করিসজকে নিয়ে।
রোপ আমারও ভীষণ প্রিয়। একটা ঘরে, অল্প কয়েকিট চরিত্র নিয়ে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা অসাধারণ একটা কাজ। আমি সবাইকে এই ছবিটা দেখতে বলি।
একটা সেটেও যে ছবি হয় তার প্রমান এই ছবি।
রোগ ভাল হইছে শওকত ভাই 🙂
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
সাইকো ছবিটা যতবার দেখি, একটুও পুরানো হয় না।
সালাম ভাইয়া। সাইকো আর নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট শুধু দেখেছি। দেখি আজকে বাকিগুলো ডাউনলোডে দিয়ে দিব। ধন্যবাদ ভাইয়া, আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। 🙂
অফটপিকঃ এখন কেমন আছেন?
আবারও দারুণ একটা সিনেমা নিয়ে সিনেম্যাটিক পোস্ট।
হিচকক খুবই জাদুকরি পরিচালক। আমি তাঁর মুছি দেখতে বসে ভাবি এমন সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকে, কী করে এমন সেলুলয়েড জাদু তৈরি করা যায়? তাও একটার চেয়ে আরেকটা মুভি আলাদারকমের ভাল, ভিন্ন!
যেগুলো এখনও দেখা হয়নি, সেগুলোও দেখে ফেলবো। 😀
কার ক্ষমতা সীমিত বললা, হিচককের? 😮
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
না, সেই সময়ের প্রযুক্তি সীমিত ছিল। এখনকার মত স্পেশাল ইফেক্ট আর সিজি থাকলে হইছিল!
আমার আগের কমেন্টের বাক্যটা একটু মিসলীডিং হয়ে গেছে। 😕
বলতে লজ্জা লাগতেছে, আমি হিচককের কোন ছবিই এখনও দেখি নাই। 🙁
তবে অতি শীঘ্রই দেখে ফেলব সবগুলা। 🙂
আমিও দেখিনাই এইটা কোন ব্যাপার না । বেশি আগের মুভি দেখতে ইচ্ছা করেনা । শওকত ভাই মুভি গুলোর রিভিউ আরেকটু বড় করে দিলে ভাল হত । আমাদের মত কেউ হয়ত দেখার আগ্রহ পেত ।
আমার কাছে আছে অনেকগুলি, নিয়া যাইস।
শর্ত একটাই, সময় মতো ফেরত দিবি। 😀
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
আমি দেশে আসলে তুই আমাকে রাইট করে দিবি 😀
তোর যে এমন মুভি কালেকশন আগে জানলে আরো হামলা চালাইতাম ।
The Wrong Man (1956)
Dial M For Murder (1954)
I Confess (1953)
Under Capricorn (1949)
Jamaica Inn (1939)
কামরুল এই ছবিগুলা আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। থাকলে আওয়াজ দাও।
আমিও হিচককের ভক্ত। আপনের সেরা পাঁচের শুধু রেবেকা-টা দেখি নাই। আমার সেরা পাঁচে বোধহয় তাই রেবেকার বদলে থাকবে "ডায়াল এম ফর মার্ডার"- এটা আমার দেখা সেরা গোয়েন্দা সিনেমা। সিনেমার মূল সেট শুধু একটা রুম। এক রুমের মধ্যেই প্রায় সবকিছু, মাঝেমাঝে বাইরের কিছু সিন দেখানো হয়, খুবই কম। এইটার কথা জীবনে ভুলতে পারবো না। সিনেমায় কাঁচি দিয়ে মারার একটা দৃশ্য আছে- সাইকোর গোসল দৃশ্যের উত্তেজনার প্রায় কাছাকাছি।
ডায়াল এম ফর মার্ডার মাত্র দেখা শেষ করলাম।
অ - সা -ধা - র - ণ !!
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
হিচককের প্রথম দেখছিলাম, the man who knew too much-
জানতামই না যে- এটা হিচককের মুভি।
এরপর প্রায় সব দেখা হয়েছে। কোনটা রেখে কোনটার কথা বলা যায়?
তবে তালিকাটা এরকম হইতে পারে
সাইকো
নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট
রিয়ার উইন্ডো
ফ্রেন্জি
স্ট্রেঞ্জার অন এ ট্রেন
সিনেমাটিক লেখার জন্য শওকত ভাইকে ধন্যবাদ। 🙂
হিচকক এর ছবি আমারো খুব একটা দেখা হয় নাই। থিরলার সব সময়ই পছনদ করি। bird & psycho একটু দেখা হইসিলো। শওকত ভাই এর preview পড়ে বাকি গুলা দেখবই। তানভির তুই collect করে আমাকে জানাবি। ধননোবাদ শওকত ভাই