মেজর ম্যাক্স : অভ্যস্ততা ও অন্যান্য

মেজর ম্যাক্স : নাম রহস্য

দিন যায়, আমরা স্যারের সাথে অভ্যস্ত হতে থাকি।

ইত্যবৎসরে স্টাফদের রুমের চারপায়ার নিচটা ভাঙ্গা গাছের ডালে ভর্তি হয়ে গেছে। ওগুলো ক্যাডেটের পশ্চাৎদেশে প্যাদানির কাজে চাহিবামাত্র সরবরাহ করা হত মাকসুদ স্যারকে। একদিন আমাদের কয়েকজন দুপুরের কড়া রোদ্রে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে শুয়ে মাছ ভাজা হল (পরে বিএমএ’তে শুনেছি এটাকে বলে “জিসি ফ্রাই”)। ফুটবল খেলতে নেমে কিছু হলেই ফ্রন্টরোল দেয়া অভ্যাস হল। পরে এমন হয়েছিল যে মির্জাপুরে আইসিসি ফুটবলে আমাদের ছেলেরা গোল দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করত ফ্রন্টরোল দিয়ে। এগারোটা প্লেয়ার আনন্দে একত্রে ফ্রন্টরোল দিচ্ছে – দৃশ্যটা নিশ্চয়ই দেখার মতোন। একদিন সন্ধ্যায় স্যারের সাথে মুখে মুখে তর্ক করার অপরাধে পাভেলকে ঢাকার বাসে তুলে দেয়া হবে বলে কলেজের মেইন গেটে বসিয়ে রাখা হল আধা ঘন্টা (কিন্তু ঐ পর্যন্তই)। এরকম টুকিটাকি আরও অনেক।

মজার কিছু অভ্যাসও হল আমাদের। আমরা মোটর সাইকেলকে বলা শুরু করলাম ‘মটরবাইক’। কারও কারও মাথার চুলে এ্যাডজুট্যান্টকে ফলো করার নমুনা দেখা গেল। তারা ক্ষণে ক্ষণে আঙ্গুল চালিয়ে কপাল থেকে চুল সরায়। স্যার কলেজ গেমস প্রিফেক্টকে বলতে বাধ্য হলেন, “ডোন্ট ফলো ইওর এ্যাডজুট্যান্ট। গেট আ হেয়ার কাট”। আর সবচেয়ে বড় কথা আমরা কথায় কথায় বলতে থাকলাম, “ওহ্ মাই গাড”। লাই দিলে বান্দর মাথায় ওঠে। আমরা মনে হয় সেই রকমই করতে থাকলাম।

আমাদের মুভি দেখানো হতো ভিসিআর দিয়ে। বরিশাল শহর থেকে প্রতি এক বা দুই সপ্তাহান্তে আমাদের ডিম্যান্ড অনুযায়ী মুভি আসত – বেশির ভাগই হিন্দী। মাকসুদ স্যার এই পুরো ব্যাপারটাতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসলেন। স্যার ঢাকার লাভা ভিডিও থেকে চমৎকার প্রিন্টের বিখ্যাত সব ইংলিশ মুভি আনালেন আমাদের জন্য। প্রথম ধাক্কাতেই প্রায় চল্লিশটার মতোন। সেগুলো রাখলেন তার অফিসের শেলফে। আমরা শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে কোনটা রেখে কোনটা নিই করে করে কনফিউজড হয়ে যেতাম। “বেবি’স ডে আউট”, “হানি আই শ্রিঙ্ক দ্যা কিডস” সিক্যুয়েলের মতোন মজাদার মুভি যেমন দেখেছি তেমন দেখেছি “গানস অফ নাভারন”, “টেন কমান্ডসমেন্ট”, “দ্যা কিলিং ফিল্ডস” এর মতোন মুভিও। তখন নতুন নতুন রিলিজ হওয়া মুভি ব্রেভহার্ট, টাইটানিক ইত্যাদি স্যারের এই অনন্য ইনিশিয়েটিভের কারণে দেখতে পেরেছি যা আগে আশাও করতে পারতাম না। স্যার আমাদের কাউকে কাউকে টাইটানিকের কোয়ালিটি প্রিন্ট ভিডিও ক্যাসেট কালেক্ট করে দিয়েছিলেন পর্যন্ত।

কলেজের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের লাগোয়া একটা লন টেনিস গ্রাউন্ড ছিল। সেটাতে কোনদিন কাউকে খেলতে দেখেছি কিনা মনে পড়ে না। স্যার প্রতিদিন গেমস টাইমে আমাদের নিয়ে শুরু করলেন লন টেনিস খেলা। খেলা জমজমাট করার জন্য নিয়ম বেঁধে দিলেন যার শট দুই পাশের উঁচু নেট পার হয়ে বাইরে চলে যাবে সে উপস্থিত সবাইকে কোক খাওয়াবে। আমরা খেলতে থাকি আর কোক খাওয়াতে থাকি। কোন কোন দিন ডবল ইস্যুও হয়ে যেত! স্যারের বল নেটের বাইরে যাবার জন্য দোয়া, চেষ্টা চরিত্র কম করিনি কিন্তু শকুনের দোয়ায় গরু মরেনি। স্যারের সাথে সাথে আস্তে আস্তে আমাদের সবারই খেলা বেশ ডেভেলপ করেছিল।

স্যারের রুমে সারা দিনমান অন্যান্য শিক্ষকদের আনাগোনা। স্যার সবাইকেই বসিয়ে চা বিস্কিট অফার করতেন। আমাদের প্রিফেক্টরা কাজে কর্মে অথবা নানান আব্দার করার জন্য স্যারকে একা পেত না বললেই চলে। বেগের খুব আপত্তি ছিল এই ব্যাপারটাতে। ওর মতে স্যার তার অফিসকে একটা টি স্টল বানিয়ে ফেলেছেন। স্যারকে ও একবার বলেওছিল এই কথা। স্যার শুধু ছোট্ট করে হেসেছিলেন মাত্র, কিছু বলেননি। তখন কৈশোরের চঞ্চল, অস্থিরমতি মনে বেগের কথাই ঠিক মনে হত। কিন্তু এখন বুঝি স্যার কেন সবাইকেই আপ্যায়ন করতেন। কলেজ থেকে বের হবার পর সার্টিফিকেট তোলার জন্য কলেজে গেলে সেই আপ্যায়ন আমিও পেয়েছিলাম।

স্যার ছোটখাট অনেক কিছু ওভারলুক করতেন। একদিন দুপুর বেলা ধুম বৃষ্টির মধ্যে আমাদের পোলাপান হাউস – ডাইনিং হল কানেক্টিং শেডের উপর দাবায়ে ভিজছে। ঐ সময়েই আমি স্যারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি কি একটা কাজে। স্যার প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হতেই প্রথমে দেখলেন বৃষ্টির ভিতরে নগ্নগাত্র নৃত্যরত আমার ক্লাসমেটদের। তারপরই দেখলেন আমাকে। চোখ পাকিয়ে বললেন, “ওগুলো তোমার ক্লাসমেট না”? আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাব, দেখি স্যার তার রুমে সেঁধিয়ে গেছেন। বেমালুম ভুলে গেছেন সেই চ্যাপ্টার।

“এই পোলাপানগুলি আর কয়েকদিন পরেই আমার কলিগ হয়ে যোগ দিবে বাংলাদেশ ডিফেন্স সার্ভিসে” – বোধ করি এইরকম একটা মানসিকতা স্যার পুষে রাখতেন মনে মনে। তা না হলে এমন বন্ধুত্বসুলভ আচরণ কেন? শাহআলম স্টাফ অবশ্য বলেছিলেন, “স্যার তোমাদের সাথে যতই ফ্রেন্ডলি ব্যবহার করুক না কেন তোমরা তাকে তার প্রাপ্য সম্মান অবশ্যই দিবা। মনে রাখবা উনি এ্যাডজুট্যান্ট আর তোমরা তার ক্যাডেট”। আমরা মনে রেখেছিলাম।

স্যারের সবকিছু আমরা পর্যবেক্ষণ করতাম। কথা বলা, হাঁটা চলা, পোষাক পরিচ্ছদ কি নয়? একদিন কোন এক ফেয়ার ওয়েল ডিনারে মাকসুদ স্যার মেসকিট (কালো ট্রাউজারের সাথে সাদা ড্রেস – বাইরের ব্যান্ড পার্টির ড্রেসের সাথে বেশ মিলে যায়) পড়ে এলেন। এরকম একটা জলজ্যান্ত ব্যতিক্রম দেখে তো আমাদের হাসি একান ওকান হয়ে গেল। ডিনারের পর স্যারের সাথে ক্লাস টুয়েলভের কয়েকজন বসে গেলাম আড্ডা মারতে। কথায় কথায় বললেন, “দেখ, এই দুনিয়াটা কয়দিনের? কতদিন একটা মানুষ বেঁচে থাকে বল? সো হোয়াই নট টু মেক ইওরসেল্ফ এ্যাভেলএবল টু এভরি ওয়ান? সবার সাথে মিলে মিশে নিজেকে একাকার করে দাও। হাসি আনন্দে মেতে থাক। নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে জীবনের রংকে সাদায় আর কালোতে সীমাবদ্ধ রাখবে কেন”?

স্যারের সবার সাথে মিলেমিশে থাকা, সবসময় অন্তরঙ্গ ব্যবহার করার একটা ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। স্যারের মোটর সাইকেল আর কেউ (কোন শিক্ষক বা কলেজের কোন ড্রাইভার) ব্যবহার করছে এটা আমাদের কেন জানি পছন্দ হোত না। কিন্তু একদিন যখন সারা দেশে সড়ক অবরোধ, কোন গাড়ীঘোড়া চলছে না এবং ঐ একই দিনে আমাদের জুনিয়র ব্যাচের একজনের বাবার মৃত্যু সংবাদ আসল তখন এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে কার্যকর প্রতীয়মান হলো। মোস্তফা ভাই (কলেজের সবচেয়ে দক্ষ ড্রাইভার) সেই ক্যাডেটকে মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে এই অবরোধের মধ্যে বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালে নামিয়ে দিয়ে আসলেন।

স্যারের স্মৃতিশক্তি অসম্ভব রকম ভালো। গত বছর এরকম সময় দেখা হলে টুকটুক করে অনেক কথা বললেন। আমাদের সবার ঠিক ঠিক নাম ধাম ধরে বর্তমান অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। আমার আব্বা একবার ফোনে কথা বলেছিলেন স্যারের সাথে। স্যার সেটা পাই পাই করে মনে রেখছেন। এও জানালেন যে এখন যদি আব্বার সাথে তার কথা হয় তবে তিনি ঠিক আব্বার কন্ঠস্বর চিনতে পারবেন। আমি শুনে অবাক।

(চলবে…)

২,৬০৫ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “মেজর ম্যাক্স : অভ্যস্ততা ও অন্যান্য”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    এই দুনিয়াটা কয়দিনের? কতদিন একটা মানুষ বেঁচে থাকে বল? সো হোয়াই নট টু মেক ইওরসেল্ফ এ্যাভেলএবল টু এভরি ওয়ান? সবার সাথে মিলে মিশে নিজেকে একাকার করে দাও। হাসি আনন্দে মেতে থাক। নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে জীবনের রংকে সাদায় আর কালোতে সীমাবদ্ধ রাখবে কেন”? :boss:
    ভালো লাগতাছে মামা। :salute:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমাগো কপাল খারাপ আছিল, আমরা কোন ভাল পাগলা এডু পাই নাই... :((
    যেগুলো পাইছি সেগুলান ছিল খারাপ পাগলা... x-(

    সায়েদ ভাই, আপনারা লাকি... :clap:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. আরিফ (৯৫-০১)

    ভাই, স্যারকে আমার সবসময় ভালো লাগত, কিন্তু স্যার আমার ১১/১২ লাইফটা হেল করার অনেক চেষ্টা করছে..কিন্তু সফল হয় নাই...থাক এই বিষয়টা শেয়ার না করাই ভাল...হাজার হোক সে একজন ক্যাডেট.

    জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    তুইযে খালি বিয়া বিয়া করতাছোস, তাইলে কবীরের পিছনেরগুলা থেইকা সুন্দর কান্ড-বল্লরী ওলা একটারে বাইছা নিলেই পারোস :grr: :grr:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    @ ফৌজিয়ান,
    দোস্ত থ্যাংকস 🙂 ।

    @ জুনায়েদ কবীর,
    থ্যাংকস। আমরা সত্যিই লাকি মনে হয় যে এইরকম একজন "ভালো পাগলা" 😛 😛 এডু পাইছিলাম।

    @ আরিফ,
    😕 😐 😕 😐

    @ সামিয়া,
    পরবর্তী পর্ব শিঘ্রই আসিতেছে..... ;;) ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  6. মেক ইওরসেল্ফ এ্যাভেলএবল টু এভরি ওয়ান? সবার সাথে মিলে মিশে নিজেকে একাকার করে দাও

    কথাটা দারুন।
    মেজর ম্যাক্স ভাইয়ের গল্প শুনতে ভালো লাগছে।
    সায়েদ ভাই জলদি।

    জবাব দিন
  7. তানভীর (৯৪-০০)

    "সবার সাথে মিলে মিশে নিজেকে একাকার করে দাও। হাসি আনন্দে মেতে থাক। নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে জীবনের রংকে সাদায় আর কালোতে সীমাবদ্ধ রাখবে কেন?"

    খুব ভালো লাগল এই কথাটা।
    এইরকম পাগলা এডু পাইলে আমাদের কলেজ লাইফটাও মনে হয় ভাল হইত!
    সিরিজটা বেশ প্রাণবন্ত হচ্ছে। পরবর্তী পর্বের জন্য আমিও অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পলাশ (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।